মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনা আংশিক হোক বা পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়িত হোক—শেষ খেলা এখন দোরগোড়ায়। যেভাবেই চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছানো হোক না কেন, তাঁর ২০ দফা পরিকল্পনার ৯ ও ১০ নম্বর ধারা দ্রুতই কার্যকর হতে চলেছে। সেখানে বলা আছে:
“৯. গাজা একটি অস্থায়ী রূপান্তরকালীন শাসনের অধীনে পরিচালিত হবে, যা একটি প্রযুক্তিনির্ভর, অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটি দ্বারা গঠিত হবে। এই কমিটি দৈনন্দিন সেবা ও পৌরব্যবস্থা দেখভাল করবে।
“এই কমিটিতে যোগ্য ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ থাকবেন। এটির তদারকিতে থাকবে একটি নতুন আন্তর্জাতিক ‘বোর্ড অব পিস’, যার চেয়ারম্যান হবেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প; অন্যান্য সদস্যদের—যাদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও থাকবেন—নাম পরে ঘোষণা করা হবে।
“১০. এই ‘বোর্ড অব পিস’ গাজার পুনর্গঠনের জন্য কাঠামো নির্ধারণ করবে, অর্থায়ন সামলাবে এবং তদারকি করবে—যতদিন না ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) তাদের সংস্কার কর্মসূচি সম্পন্ন করে নিরাপদভাবে দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম হয়।”
সংক্ষেপে, যুদ্ধ যেভাবেই শেষ হোক না কেন, ‘বোর্ড অব পিস’ গাজায় অস্থায়ী রূপান্তরকালীন শাসনের জন্য ঘোষিত “প্রযুক্তিনির্ভর, অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটি”তে যোগদানের উপযুক্ত প্রার্থীদের খুঁজবে। একই সময়ে সংস্কার-পরবর্তী পিএ পরিচালনায় এবং শেষ পর্যন্ত “দায়িত্ব গ্রহণে” উপযুক্ত ফিলিস্তিনিও প্রয়োজন হবে। ৮৯ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের উত্তরসূরি নিয়োগ—অথবা অন্তত ঘোষণা—হতে পারে।
প্রশ্ন হলো: হামাস, অন্য কোনো জিহাদি মতাদর্শ বা পূর্বতন প্রত্যাখ্যানবাদী রাজনীতির ছোঁয়ামুক্ত, ভবিষ্যতের সেই সম্ভাব্য ফিলিস্তিনি নেতারা কারা?
সম্ভাব্য ফিলিস্তিনি নেতারা
সবচেয়ে আগে যে নামটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে—মোহাম্মদ দাহলান। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত দাহলানকে পশ্চিমা ও ইসরায়েলি বিশ্লেষকেরা যুদ্ধ-পরবর্তী সম্ভাব্য নেতা হিসেবে দেখেন। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে এই সত্য যে তিনি গাজারই সন্তান—১৯৬১ সালে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্ম। কিশোর বয়সে তিনি ফাতাহ যুব আন্দোলন (ফাতাহ হকস) গঠনে ভূমিকা রাখেন।
বিশের কোঠায় রাজনৈতিক সক্রিয়তার জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাঁকে একাধিকবার গ্রেপ্তার করে, তবে কখনো সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে নয়। বন্দিদশায় তিনি হিব্রু শেখেন এবং সাবলীলভাবে বলতে পারেন। ১৯৯০-এর শুরুর দশকে ওসলো চুক্তির আলোচনায় তিনি সহায়ক ভূমিকা রাখেন বলে নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যায়। ১৯৯৩ সালের প্রথম চুক্তির বিরোধিতা করে হামাস ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
আরাফাত তাঁকে গাজায় প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান করেন। নতুন ভূমিকায় হামাসবিরোধী পদক্ষেপে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। প্রায় ২০ হাজার সদস্যের বাহিনী গড়ে তিনি এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন যে গাজাকে কেউ কেউ রসিকতা করে “দাহলানিস্তান” বলতে শুরু করে।
২০০১ সালে দাহলান পিএ-র দুর্নীতির সমালোচনা করে সংস্কারের ডাক দেন। ২০০৬ সালের নির্বাচনে গাজায় হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। দাহলান একে বিপর্যয় বলে উল্লেখ করে হামাসকে “ঘাতক ও চোরের দল” বলে আখ্যা দেন। ছয় মাসের মধ্যে হামাস রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং যাদের হত্যা করেনি—সেসব ফাতাহ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করে। পরবর্তীতে প্রকাশ হয়, হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে ব্যর্থ এক মার্কিন পরিকল্পনায় দাহলান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
২০০৭ সালের অক্টোবরে বুশ প্রশাসন নাকি আব্বাসকে দাহলানকে ডেপুটি নিয়োগের জন্য চাপ দিয়েছিল। সেখান থেকে আব্বাস তাঁকে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেন। ২০১১ সালের জুনে আব্বাস দাহলানের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও খুনের অভিযোগ আনেন—এমনকি ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার অভিযোগও তোলেন। ওই বছরই দাহলানকে ফাতাহ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে ২০১৫ সালে ফরাসি তদন্তে সিদ্ধান্ত আসে—আরাফাত স্বাভাবিক কারণে মারা গেছেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে দাহলান তখনকার ক্রাউন প্রিন্স (বর্তমান প্রেসিডেন্ট) মোহাম্মদ বিন জায়েদের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত না হলেও, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত আব্রাহাম চুক্তির পথে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে অন্তরাল থেকে দাহলানের ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়।
দাহলানের পর সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে উঠে আসেন ৭৩ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী সালাম ফায়াদ। প্রযুক্তিনির্ভর, পশ্চিমমুখী প্রশাসক হিসেবে পরিচিত ফায়াদ প্রথমে অর্থমন্ত্রী ও পরে পিএ-র প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আর্থিক ও প্রশাসনিক সংস্কারকর্মে খ্যাতি অর্জন করেন। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ‘কোয়ার্টেট’-এর বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে তিনি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গঠনে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। বিশেষত “ফায়াদ পরিকল্পনা” নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রোডম্যাপে তাঁদের সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য। ট্রাম্পের ‘বোর্ড অব পিস’-এ ব্লেয়ার যে আছেন, তা বিবেচনায় ফায়াদকে প্রযুক্তিনির্ভর কমিটির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সমর্থন পাওয়ার সুযোগ বেশি।
অতিরিক্ত সম্ভাব্য প্রার্থীরা
আরেকজন সম্ভাব্য প্রার্থী মোহাম্মদ মুস্তাফা—প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদ—যিনি মার্চ ২০২৪-এ পিএ-র প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ পান। প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কারক হিসেবে খ্যাত মুস্তাফার কর্মজীবনে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা আছে; পাশাপাশি কুয়েত ও সৌদি আরব সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
৭৯ বছর বয়সী হানান আশরাওয়িও সম্ভাব্য প্রার্থী। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিনি পিএলও-র নির্বাহী কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন—কারণ হিসেবে নেতৃত্বে নারী ও তরুণদের উপেক্ষার কথা বলেন। আনুষ্ঠানিক পদে আগের মতো সক্রিয় না থাকলেও তিনি জনপরিসরে সংস্কার ও জবাবদিহির পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরও দুজন নাম উঠে আসে—হুসেইন আল-শেইখ (বর্তমানে পিএলও-র সেক্রেটারি-জেনারেল) ও মাজেদ ফারাজ (পিএ-র গোয়েন্দা প্রধান)। পশ্চিমা মহলে আল-শেইখকে বাস্তবানুগ কূটনৈতিক বক্তা হিসেবে দেখা হয়, যিনি নিরাপত্তা সমন্বয় ও কূটনৈতিক সম্পৃক্ততায় গভীরভাবে যুক্ত। অন্যদিকে ফারাজকে পশ্চিম তীরে স্থিতিশীলতা রক্ষায় ও সন্ত্রাসবাদ দমনে ফিলিস্তিনি প্রচেষ্টার নেতৃত্বদানকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি নিয়মিতভাবে ইসরায়েলি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করেন এবং বহু পরিকল্পিত হামলা নস্যাৎ করেছেন। দু’জনেরই ফাতাহের সশস্ত্র রাজনীতির সঙ্গে অতীত যোগ থাকলেও, পশ্চিমা দৃষ্টিতে তারা নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
জনসমর্থনের চিত্র
তবে দাহলান ছাড়া এদের কেউই ফিলিস্তিনি জনমতের শীর্ষে নেই। সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, জনসমর্থনে সবার ওপরে রয়েছেন ৬৬ বছর বয়সী মারওয়ান বারঘুতি—যিনি দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ২০০২ সালের এপ্রিলে ইসরায়েলের হাতে গ্রেপ্তার হন। ২০০৪ সালে পাঁচটি হত্যাকাণ্ড ও হত্যাচেষ্টার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ অতিরিক্ত ৪০ বছরের সাজা হয়। ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ব্যবস্থার আওতায় যেসব দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দি ও আটক ব্যক্তিকে ফেরত দেওয়ার কথা—সেই তালিকায় তিনি থাকবেন না।
জরিপে উচ্চস্থানে আছেন খালেদ মেশাল (পুরোদস্তুর হামাস নেতা) এবং আরও বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা হিসেবে মুস্তাফা বারঘুতি—একজন চিকিৎসক, কর্মী ও বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি রাজনীতিক—যিনি ধর্মনিরপেক্ষ ও সংস্কারপন্থী অবস্থানের জন্য পরিচিত।
ফিলিস্তিনি নেতার অভাবে ট্রাম্প পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে হবে—এমন নয়। সম্ভাব্য নেতৃত্ব খোঁজার ক্ষেত্র হিসেবে রয়েছে ফিলিস্তিনি প্রবাসী সমাজও, যেখান থেকে এমন ব্যক্তিদের পাওয়া যেতে পারে—যারা গাজা পুনর্গঠন ও সমগ্র অঞ্চলের জন্য আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ নির্মাণে সক্ষম এবং ইচ্ছুক। এখন প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা—শুরুটা করার জন্য।