০৪:০৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
নিভে আসা হলুদ বাতির নিচে: আমাদের সাহসের পরামর্শদাতা রকিব হাসান ইসলামী ব্যাংকিং শাসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের শরিয়াহ উপদেষ্টা বোর্ড: নীতিমালা–২০২৫ পাস বাংলাদেশে ভুয়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা—শিক্ষার্থীদের ভর্তি না হওয়ার আহ্বান ইউজিসির জাল নোট নিয়ে আতঙ্ক নয়—জনসচেতনতা বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী: ইঞ্জিনিয়ার্স ও সিগন্যালস কোরের ২০২৫ ব্যাচের রিক্রুট প্যারেড অনুষ্ঠিত প্রণয় ভার্মার বক্তব্যে ‘লালন সন্ধ্যা’: ভারতীয় হাইকমিশনের আয়োজনে লালন স্মরণ ও সুরের মিলন আফ্রিকাই আগামী বিশ্বে পরিবর্তন আনবে পাবনায় আধিপত্যের সংঘর্ষে ‘নকশাল’ নেতা গুলি ও ধারালো অস্ত্রে নিহত কাঠবিড়ালিদের ছবি তুলে কষ্ট ভুলে থাকেন নিকি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে বিপর্যয়ে সংঘাত মানুষ ও বন্যপ্রাণীর

নাৎসি জার্মানি থেকে অবাধ্যের পাঠ

গণতান্ত্রিক বিশ্বজুড়ে যখন কর্তৃত্ববাদী নেতারা প্রভাব বাড়াচ্ছেশুধু হাঙ্গেরি বা তুরস্কতেই নয়এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেওতখন বিংশ শতকের একটি প্রশ্ন একবিংশ শতকে আবার ফিরে এসেছে। প্রশ্নটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসবার জন্যই চাপ সৃষ্টি করে: কে স্বৈরশাসকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেআর কে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে?

এই প্রশ্নের একটি ইঙ্গিত মেলে তৃতীয় রাইখের ভেতরে ঘটে যাওয়া এক অসাধারণ ঘটনায়যা প্রায় ৮০ বছর ধরে প্রায় বিস্মৃত। ঘটনাটির কেন্দ্রে ছিলেন জার্মান উচ্চসমাজ থেকে আসা প্রায় দশজন বন্ধু ও পরিচিতঅভিজাত বংশ ও পেশাজীবী এলিট উভয়ই। তাদের বৃত্তে ছিলেন দুইজন কাউন্টেসএকজন রাষ্ট্রদূতের বিধবাএক কূটনীতিকবর্তমান ও সাবেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাএক চিকিৎসকএকজন অগ্রগামী নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং এক সাবেক মডেলপ্রমুখ। তাদের মিলিত বৈশিষ্ট্য ছিল হিটলারের বিরুদ্ধেবড় ও ছোটবিভিন্ন রকম অবাধ্যতা দেখানোর প্রস্তুতি।

কিন্তু তাদের সেই অভিন্ন উদ্দেশ্যের ধারণাটি মারাত্মকভাবে ভুল প্রমাণিত হয়। ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরের এক চা-আড্ডায় তারা মিলিত হননা জেনেই যে তাদেরই একজন বাকিদের বিরুদ্ধে গেস্টাপোর কাছে গোপনে খবর দিতে যাচ্ছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতা গ্রেপ্তার ও কারাবন্দিত্ব ডেকে আনেএবং সেদিন উপস্থিত কয়েকজনের পরিণতি হয় মৃত্যুদণ্ডেকারও গিলোটিনেকারও ফাঁসিতে। এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত নাৎসি রাষ্ট্রযন্ত্রের চূড়ান্ত শীর্ষে গিয়ে ঠেকে।

এই কাহিনির মূল রহস্য কেবল বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় নয়বরং কেন বিশেষ সুবিধা ও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষযারা চাইলে সহজেই মাথা নিচু করে থাকতে পারতসবকিছু ঝুঁকিতে ফেলেছিল। তারা যদি ধারা মেনে চলততাদের সম্পদপেশাজীবন ও দেশীয় সম্পত্তি সম্ভবত অক্ষুণ্ণ থাকত। যুদ্ধোত্তর সময়ও তারা অক্ষতভাবে পার করতে পারত। তবু তারা অন্য পথ নিয়েছিল।

ভাবুন অট্টো কিপকেচা-আড্ডার সময় যার বয়স ছিল ৫৭এক কূটনীতিকযিনি ওয়াইমার প্রজাতন্ত্রের শেষ বছরগুলোতে নিউ ইয়র্ক সিটিতে জার্মান কনসাল জেনারেলের মর্যাদাপূর্ণ পদে ছিলেন। ১৯৩৩ সালে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এক নৈশভোজেবিশিষ্ট স্বদেশী আলবার্ট আইনস্টাইনের সম্মানেতিনিই তখন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ইহুদি। আমন্ত্রণ গ্রহণ মানে সদ্য ক্ষমতায় বসা নাৎসি শাসকদের রোষ ডেকে আনাঅস্বীকার মানে তাদের ইহুদিবিদ্বেষী নিপীড়নের পাশে দাঁড়ানো। কিপ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং আইনস্টাইনের সম্মানে টোস্টও দেন। ফলততাকে বার্লিনে তলব করা হয়ফ্যুরারের সামনেই হাজিরা দিতে।

Sophie Scholl and the White Rose | The National WWII Museum | New Orleans

আরও দেখুন মারিয়া ফন মাল্টজানকেতরুণ কাউন্টেসযিনি নিজের বার্লিনের অ্যাপার্টমেন্টকে গোপন আশ্রয়ে পরিণত করেছিলেন সাবমেরিনদের” জন্যঅর্থাৎ যারা আড়াল-আবডালে বেঁচে থাকা বাধ্য ইহুদিযাদের নিরাপত্তা নির্ভর করত নীরব ও অদৃশ্য থাকার ওপর। (তাদের একজন ছিলেন মাল্টজানেরই নিষিদ্ধ ইহুদি প্রেমিক।) কিংবা তার সহকর্মী কাউন্টেস লাগি জল্‌ফতিনি ইহুদিদের সঙ্গে যোগাযোগে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তাদের জন্য বাজার-সদাই করতে যেতেন। দুই হাতে ঠাসা বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরোনো ছিল তার বহুদিনের অভ্যাসএভাবে পথে কারও সঙ্গে দেখা হলেও বাধ্যতামূলক হাইল হিটলার’ স্যালুট দিতে হাতে ফাঁকা থাকত না।

আর্কাইভ ঘেঁটেদলের সদস্যদের রেখে যাওয়া চিঠিডায়েরি ও আদালতের সাক্ষ্যএবং তাদের পরিবারের জীবিত সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেআমি কেন কয়েকজন মানুষ এক ভয়ংকর শক্তিশালী শাসনের সামনে না’ বলতে পেরেছিলেনআর তাদের অধিকাংশ প্রতিবেশী কেন মাথা নত করেছিলেনতার একটি উত্তরের খোঁজ পেয়েছি।

কয়েকজন ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ খ্রিস্টানবিশ্বাস করতেনশেষ বিচারে তারা জবাব দেবে হিটলারের কাছে নয়যিশু খ্রিস্টের সামনে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন সেই ভাগ্যনির্ধারক চা-আড্ডার আয়োজকউদ্ভাবনী শিক্ষাবিদ এলিজাবেথ ফন থাডেন। তার স্কুলতৃতীয় রাইখ শুরুর ছয় বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ইভানজেলিকাল রুরাল এডুকেশন হোম ফর গার্লসনিঃশব্দে ইহুদি ছাত্রীদেরও আশ্রয় দিতযখন তাদের পরিবার পাগলের মতো দেশ ছেড়ে পালানোর কাগজপত্র জোগাড়ে ব্যস্ত। ঈশ্বরের কাছেই যে তার জবাবদিহিএই বিশ্বাসই তাকে সাহস দিয়েছিলযখন এক গেস্টাপো পরিদর্শক স্কুলে এসে বিশ্বাসগত ঘাটতি” খুঁজতে শুরু করেছিলকারণ কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছিলতিনি একবার পুরাতন নিয়মের একটি গীতসংহিতা আবৃত্তি করেছিলেনতাদের কাছে যা হিব্রু ধর্মগ্রন্থের কলঙ্ক’ বহন করত। (১৩ বছর বয়সী এক ছাত্রীই ছিল তথ্যদাতা।)

দলের আরও কয়েকজন ছিলেন অভিজাত বংশোদ্ভূতযারা মনে করতেন তাদের সর্বোচ্চ আনুগত্য জাতীয় সমাজতন্ত্রের নয়বরং নিজেদের পূর্বপুরুষদের প্রতি। হিটলার হাজার বছরের রাইখের স্বপ্ন দেখলেওএসব পরিবার তো শতাব্দীর পর শতাব্দী জার্মানিকে শাসন করেছে। তাদের বিশ্বাস ছিলতাদের শ্রেণিই জার্মানির গভীর ও প্রকৃত সত্তাযার অংশ হলো দুর্বলদের প্রতি পিতৃতান্ত্রিক সদয়তা। নাৎসিবাদ এক ক্ষণস্থায়ী মোহটিকে থাকবে তারা এবং তাদের অভিজাত উত্তরাধিকার।

Rise Up Against Evil: 8 Tales of German Resistance in World War II - History  Collection

এই বিশ্বাস থেকেই মারিয়া ফন মাল্টজান এমন ঔদ্ধত্যভরা অস্থিরতায় গেস্টাপো কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেনযখন তারা তার অ্যাপার্টমেন্টে হানা দেয়। তারা যখন সোফা-বেডের নিচে কাঠের খোপটি খুলতে বলেনযার ভেতরে তার প্রেমিক নিঃশ্বাস বন্ধ করে লুকিয়ে ছিলেনতিনি জানানখোপটি খোলা যায় নাযদি সত্যিই সন্দেহ থাকেতবে গুলি চালিয়ে দেখুক। যেন প্রায় উস্কে দিলেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেনকোনো ক্ষতি হলে তাদের আগেভাগে লিখিতভাবে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তার এই কৌশলনিজ শ্রেণির অহংকারে মোড়াকাজ করে। তার প্রেমিক বেঁচে যায়।

এই নাটকের কয়েকজন মুখ্য নায়ক ছিলেন নারীযাদের বেড়ে ওঠায় আরেকটি মিল ছিল: দৃঢ়চেতা পিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এলিজাবেথ ফন থাডেনএবং দুই কাউন্টেসমারিয়া ও লাগিতিনজনের ক্ষেত্রেই দেখা যায়তারা শুধু পিতৃস্নেহ পাননিতাদের ওপর পিতার আস্থা ছিল অগাধ। আধুনিক নারীবাদের আগের যুগেই তাদেরকে কোনো পুরুষের সমান ধরে যেকোনো কাজের যোগ্য বলে মনে করা হতো। বহু বছর পরপিতারা মৃতকিন্তু সেই আত্মবিশ্বাস তারা বয়ে নিয়ে চলেছেন। নাৎসি শাসনের সময় সেই আত্মবিশ্বাসই সাহসে রূপ নেয়।

এই নারীদের শক্তি আরেক গভীর বিশ্বাসে বলীয়ান হয়যা সম্ভবত নির্ধারণ করে দেয় কে নিপীড়ক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে আর কে চাপের মুখে ভেঙে পড়বে: দিনের সরকারের ঊর্ধ্বে কোনো কর্তৃত্বে আস্থা। চা-আড্ডার বেশিরভাগ বিদ্রোহীই বুঝতে পেরেছিলেনএমন বিশ্বাস কেবল মনে রাখা নয়কাজেও প্রতিফলিত করতে হয়।

কারও ক্ষেত্রে তা ছিল ছোট ছোট অবাধ্যতালাগি জল্‌ফের বাজারের ব্যাগের মতো। আবার অট্টো কিপের মতো কারও ক্ষেত্রে তা ছিল দুর্দান্ত প্রতিরোধহিটলারকে হত্যার ষড়যন্ত্রের একেবারে নাগাল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া। বড় ও ছোট এসব কাজে তারা নিজেদের কাছে এবং একে অপরের কাছে প্রমাণ করেছেনআজ্ঞাপালনই একমাত্র বিকল্প নয়।

স্পষ্ট করে বলা দরকারঅভিজাত জার্মানদের অধিকাংশই হিটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি। উল্টোওয়াইমার যুগে বিলুপ্ত উপাধি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফ্যুরার যে টান দিয়েছিলেনতাতে জার্মান অভিজাত শ্রেণির বড় অংশ নাৎসিদের পাশেই দাঁড়ায়। আর অবশ্যইসেই সময় ও স্থান থেকে সরল রেখায় শিক্ষা নিয়ে আজকের যুগে বসিয়ে দেওয়াও যায় না।

তবু যদি ওই নারী-পুরুষদের প্রাণঘাতী পরিণতি থেকে কোনো শিক্ষা নিতে হয়তা হতে পারেস্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সুরক্ষা হলো এমন মানুষের বিস্তৃত বাহিনীযারা যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিরাজপুত্রঅথবা রাষ্ট্রপতির চেয়েও উচ্চতর এক কর্তৃত্বে বিশ্বাস করে।

জনপ্রিয় সংবাদ

নিভে আসা হলুদ বাতির নিচে: আমাদের সাহসের পরামর্শদাতা রকিব হাসান

নাৎসি জার্মানি থেকে অবাধ্যের পাঠ

০৮:০০:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

গণতান্ত্রিক বিশ্বজুড়ে যখন কর্তৃত্ববাদী নেতারা প্রভাব বাড়াচ্ছেশুধু হাঙ্গেরি বা তুরস্কতেই নয়এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেওতখন বিংশ শতকের একটি প্রশ্ন একবিংশ শতকে আবার ফিরে এসেছে। প্রশ্নটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসবার জন্যই চাপ সৃষ্টি করে: কে স্বৈরশাসকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেআর কে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে?

এই প্রশ্নের একটি ইঙ্গিত মেলে তৃতীয় রাইখের ভেতরে ঘটে যাওয়া এক অসাধারণ ঘটনায়যা প্রায় ৮০ বছর ধরে প্রায় বিস্মৃত। ঘটনাটির কেন্দ্রে ছিলেন জার্মান উচ্চসমাজ থেকে আসা প্রায় দশজন বন্ধু ও পরিচিতঅভিজাত বংশ ও পেশাজীবী এলিট উভয়ই। তাদের বৃত্তে ছিলেন দুইজন কাউন্টেসএকজন রাষ্ট্রদূতের বিধবাএক কূটনীতিকবর্তমান ও সাবেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাএক চিকিৎসকএকজন অগ্রগামী নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং এক সাবেক মডেলপ্রমুখ। তাদের মিলিত বৈশিষ্ট্য ছিল হিটলারের বিরুদ্ধেবড় ও ছোটবিভিন্ন রকম অবাধ্যতা দেখানোর প্রস্তুতি।

কিন্তু তাদের সেই অভিন্ন উদ্দেশ্যের ধারণাটি মারাত্মকভাবে ভুল প্রমাণিত হয়। ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বরের এক চা-আড্ডায় তারা মিলিত হননা জেনেই যে তাদেরই একজন বাকিদের বিরুদ্ধে গেস্টাপোর কাছে গোপনে খবর দিতে যাচ্ছে। সেই বিশ্বাসঘাতকতা গ্রেপ্তার ও কারাবন্দিত্ব ডেকে আনেএবং সেদিন উপস্থিত কয়েকজনের পরিণতি হয় মৃত্যুদণ্ডেকারও গিলোটিনেকারও ফাঁসিতে। এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত নাৎসি রাষ্ট্রযন্ত্রের চূড়ান্ত শীর্ষে গিয়ে ঠেকে।

এই কাহিনির মূল রহস্য কেবল বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় নয়বরং কেন বিশেষ সুবিধা ও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষযারা চাইলে সহজেই মাথা নিচু করে থাকতে পারতসবকিছু ঝুঁকিতে ফেলেছিল। তারা যদি ধারা মেনে চলততাদের সম্পদপেশাজীবন ও দেশীয় সম্পত্তি সম্ভবত অক্ষুণ্ণ থাকত। যুদ্ধোত্তর সময়ও তারা অক্ষতভাবে পার করতে পারত। তবু তারা অন্য পথ নিয়েছিল।

ভাবুন অট্টো কিপকেচা-আড্ডার সময় যার বয়স ছিল ৫৭এক কূটনীতিকযিনি ওয়াইমার প্রজাতন্ত্রের শেষ বছরগুলোতে নিউ ইয়র্ক সিটিতে জার্মান কনসাল জেনারেলের মর্যাদাপূর্ণ পদে ছিলেন। ১৯৩৩ সালে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এক নৈশভোজেবিশিষ্ট স্বদেশী আলবার্ট আইনস্টাইনের সম্মানেতিনিই তখন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ইহুদি। আমন্ত্রণ গ্রহণ মানে সদ্য ক্ষমতায় বসা নাৎসি শাসকদের রোষ ডেকে আনাঅস্বীকার মানে তাদের ইহুদিবিদ্বেষী নিপীড়নের পাশে দাঁড়ানো। কিপ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং আইনস্টাইনের সম্মানে টোস্টও দেন। ফলততাকে বার্লিনে তলব করা হয়ফ্যুরারের সামনেই হাজিরা দিতে।

Sophie Scholl and the White Rose | The National WWII Museum | New Orleans

আরও দেখুন মারিয়া ফন মাল্টজানকেতরুণ কাউন্টেসযিনি নিজের বার্লিনের অ্যাপার্টমেন্টকে গোপন আশ্রয়ে পরিণত করেছিলেন সাবমেরিনদের” জন্যঅর্থাৎ যারা আড়াল-আবডালে বেঁচে থাকা বাধ্য ইহুদিযাদের নিরাপত্তা নির্ভর করত নীরব ও অদৃশ্য থাকার ওপর। (তাদের একজন ছিলেন মাল্টজানেরই নিষিদ্ধ ইহুদি প্রেমিক।) কিংবা তার সহকর্মী কাউন্টেস লাগি জল্‌ফতিনি ইহুদিদের সঙ্গে যোগাযোগে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তাদের জন্য বাজার-সদাই করতে যেতেন। দুই হাতে ঠাসা বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরোনো ছিল তার বহুদিনের অভ্যাসএভাবে পথে কারও সঙ্গে দেখা হলেও বাধ্যতামূলক হাইল হিটলার’ স্যালুট দিতে হাতে ফাঁকা থাকত না।

আর্কাইভ ঘেঁটেদলের সদস্যদের রেখে যাওয়া চিঠিডায়েরি ও আদালতের সাক্ষ্যএবং তাদের পরিবারের জীবিত সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেআমি কেন কয়েকজন মানুষ এক ভয়ংকর শক্তিশালী শাসনের সামনে না’ বলতে পেরেছিলেনআর তাদের অধিকাংশ প্রতিবেশী কেন মাথা নত করেছিলেনতার একটি উত্তরের খোঁজ পেয়েছি।

কয়েকজন ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ খ্রিস্টানবিশ্বাস করতেনশেষ বিচারে তারা জবাব দেবে হিটলারের কাছে নয়যিশু খ্রিস্টের সামনে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন সেই ভাগ্যনির্ধারক চা-আড্ডার আয়োজকউদ্ভাবনী শিক্ষাবিদ এলিজাবেথ ফন থাডেন। তার স্কুলতৃতীয় রাইখ শুরুর ছয় বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ইভানজেলিকাল রুরাল এডুকেশন হোম ফর গার্লসনিঃশব্দে ইহুদি ছাত্রীদেরও আশ্রয় দিতযখন তাদের পরিবার পাগলের মতো দেশ ছেড়ে পালানোর কাগজপত্র জোগাড়ে ব্যস্ত। ঈশ্বরের কাছেই যে তার জবাবদিহিএই বিশ্বাসই তাকে সাহস দিয়েছিলযখন এক গেস্টাপো পরিদর্শক স্কুলে এসে বিশ্বাসগত ঘাটতি” খুঁজতে শুরু করেছিলকারণ কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছিলতিনি একবার পুরাতন নিয়মের একটি গীতসংহিতা আবৃত্তি করেছিলেনতাদের কাছে যা হিব্রু ধর্মগ্রন্থের কলঙ্ক’ বহন করত। (১৩ বছর বয়সী এক ছাত্রীই ছিল তথ্যদাতা।)

দলের আরও কয়েকজন ছিলেন অভিজাত বংশোদ্ভূতযারা মনে করতেন তাদের সর্বোচ্চ আনুগত্য জাতীয় সমাজতন্ত্রের নয়বরং নিজেদের পূর্বপুরুষদের প্রতি। হিটলার হাজার বছরের রাইখের স্বপ্ন দেখলেওএসব পরিবার তো শতাব্দীর পর শতাব্দী জার্মানিকে শাসন করেছে। তাদের বিশ্বাস ছিলতাদের শ্রেণিই জার্মানির গভীর ও প্রকৃত সত্তাযার অংশ হলো দুর্বলদের প্রতি পিতৃতান্ত্রিক সদয়তা। নাৎসিবাদ এক ক্ষণস্থায়ী মোহটিকে থাকবে তারা এবং তাদের অভিজাত উত্তরাধিকার।

Rise Up Against Evil: 8 Tales of German Resistance in World War II - History  Collection

এই বিশ্বাস থেকেই মারিয়া ফন মাল্টজান এমন ঔদ্ধত্যভরা অস্থিরতায় গেস্টাপো কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেনযখন তারা তার অ্যাপার্টমেন্টে হানা দেয়। তারা যখন সোফা-বেডের নিচে কাঠের খোপটি খুলতে বলেনযার ভেতরে তার প্রেমিক নিঃশ্বাস বন্ধ করে লুকিয়ে ছিলেনতিনি জানানখোপটি খোলা যায় নাযদি সত্যিই সন্দেহ থাকেতবে গুলি চালিয়ে দেখুক। যেন প্রায় উস্কে দিলেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেনকোনো ক্ষতি হলে তাদের আগেভাগে লিখিতভাবে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তার এই কৌশলনিজ শ্রেণির অহংকারে মোড়াকাজ করে। তার প্রেমিক বেঁচে যায়।

এই নাটকের কয়েকজন মুখ্য নায়ক ছিলেন নারীযাদের বেড়ে ওঠায় আরেকটি মিল ছিল: দৃঢ়চেতা পিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এলিজাবেথ ফন থাডেনএবং দুই কাউন্টেসমারিয়া ও লাগিতিনজনের ক্ষেত্রেই দেখা যায়তারা শুধু পিতৃস্নেহ পাননিতাদের ওপর পিতার আস্থা ছিল অগাধ। আধুনিক নারীবাদের আগের যুগেই তাদেরকে কোনো পুরুষের সমান ধরে যেকোনো কাজের যোগ্য বলে মনে করা হতো। বহু বছর পরপিতারা মৃতকিন্তু সেই আত্মবিশ্বাস তারা বয়ে নিয়ে চলেছেন। নাৎসি শাসনের সময় সেই আত্মবিশ্বাসই সাহসে রূপ নেয়।

এই নারীদের শক্তি আরেক গভীর বিশ্বাসে বলীয়ান হয়যা সম্ভবত নির্ধারণ করে দেয় কে নিপীড়ক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে আর কে চাপের মুখে ভেঙে পড়বে: দিনের সরকারের ঊর্ধ্বে কোনো কর্তৃত্বে আস্থা। চা-আড্ডার বেশিরভাগ বিদ্রোহীই বুঝতে পেরেছিলেনএমন বিশ্বাস কেবল মনে রাখা নয়কাজেও প্রতিফলিত করতে হয়।

কারও ক্ষেত্রে তা ছিল ছোট ছোট অবাধ্যতালাগি জল্‌ফের বাজারের ব্যাগের মতো। আবার অট্টো কিপের মতো কারও ক্ষেত্রে তা ছিল দুর্দান্ত প্রতিরোধহিটলারকে হত্যার ষড়যন্ত্রের একেবারে নাগাল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া। বড় ও ছোট এসব কাজে তারা নিজেদের কাছে এবং একে অপরের কাছে প্রমাণ করেছেনআজ্ঞাপালনই একমাত্র বিকল্প নয়।

স্পষ্ট করে বলা দরকারঅভিজাত জার্মানদের অধিকাংশই হিটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি। উল্টোওয়াইমার যুগে বিলুপ্ত উপাধি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফ্যুরার যে টান দিয়েছিলেনতাতে জার্মান অভিজাত শ্রেণির বড় অংশ নাৎসিদের পাশেই দাঁড়ায়। আর অবশ্যইসেই সময় ও স্থান থেকে সরল রেখায় শিক্ষা নিয়ে আজকের যুগে বসিয়ে দেওয়াও যায় না।

তবু যদি ওই নারী-পুরুষদের প্রাণঘাতী পরিণতি থেকে কোনো শিক্ষা নিতে হয়তা হতে পারেস্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সুরক্ষা হলো এমন মানুষের বিস্তৃত বাহিনীযারা যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিরাজপুত্রঅথবা রাষ্ট্রপতির চেয়েও উচ্চতর এক কর্তৃত্বে বিশ্বাস করে।