বিশ্ব যখন নেট-শূন্য নির্গমনের দিকে দ্রুত এগোচ্ছে, ব্যাটারি জ্বালানি রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে—নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সঞ্চয়, শিল্প খাতের ডিকার্বনাইজেশনকে সহায়তা এবং বৈদ্যুতিক যান চালনা—সব কিছুর সেতুবন্ধন করছে ব্যাটারি। ইন্দোনেশিয়ার জন্য এটি কেবল প্রযুক্তিগত রূপান্তর নয়; বরং বৈশ্বিক ব্যাটারি ও ইভি (বৈদ্যুতিক যান) সাপ্লাই চেইনে নেতৃত্ব পাওয়ার কৌশলগত সুযোগ এবং দেশের উৎপাদন খাতের অর্থনৈতিক পরিসর ও জটিলতা বাড়ানোর সম্ভাবনা। নিকেল ও কোবাল্টের প্রাচুর্যে ইন্দোনেশিয়া বড় খেলোয়াড় হতে পারে। কিন্তু সত্যিকারের নেতৃত্বের জন্য নিকেলের বাইরে দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করতেই হবে।
ইন্দোনেশিয়ার ইভি বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে—এক বছরের সামান্য বেশি সময়ে ৪০,০০০-রও বেশি নতুন ইভি ব্যবহার শুরু হয়েছে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্রুততম প্রবৃদ্ধিগুলোর একটি। নিকেল এই শিল্পগুলোর দরজা খুলে দিলেও, বৈশ্বিক ইভি শক্তিকেন্দ্র হওয়ার ইন্দোনেশিয়ার লক্ষ্য নির্ভর করছে একটি স্থিতিস্থাপক, বহুমুখী ও উদ্ভাবননির্ভর সাপ্লাই চেইন গড়ে তোলার সক্ষমতার ওপর। অর্থাৎ বর্তমান নিকেল-কেন্দ্রিক সুড়ঙ্গদৃষ্টি ঝেড়ে ফেলতে হবে।
ব্যাটারি ও ইভি শিল্পকে ইন্দোনেশিয়া জাতীয় অগ্রাধিকারের শীর্ষে তুলেছে। সরকারের ইভি রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০৩৫ সালের মধ্যে ১০ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং ১ কোটি ২০ লাখ বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে। এই লক্ষ্য চাহিদা ও জোগান—উভয় দিকের নীতিগত প্রণোদনা দিয়ে শক্তিশালী করা হয়েছে; ব্যাটারি প্রস্তুতকারক, ইভি নির্মাতা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রণোদনা অন্তর্ভুক্ত আছে।
ইতিমধ্যেই চীনের হুয়ায়ো ও ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ‘টাইটান প্রকল্প’ এবং সিএটিএলের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ‘ড্রাগন প্রকল্প’-এর মতো বড় বিনিয়োগ এগোচ্ছে। দুটো উদ্যোগই খনন ও শোধন থেকে ব্যাটারি সেল উৎপাদন ও পুনর্ব্যবহার—সমন্বিত ইভি সাপ্লাই চেইন গড়ার ইন্দোনেশিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে।
সম্প্রতি সিএটিএল পশ্চিম জাভা ও পূর্ব হালমাহেরায় ৬ বিলিয়ন ডলারের ব্যাটারি মেগা-প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে—যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম সবুজ ব্যাটারি কমপ্লেক্স হতে যাচ্ছে। উল্লম্বভাবে একীভূত এই স্থাপনা বদ্ধচক্র ব্যবস্থায় নিকেল প্রক্রিয়াকরণ, উপকরণ উৎপাদন এবং ব্যাটারি পুনর্ব্যবহার একসঙ্গে করবে। উদ্বোধনে প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তোর উপস্থিতি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় সমর্থনকেও ইঙ্গিত করে।
ইন্দোনেশিয়া দ্রুতই বৈশ্বিক ব্যাটারির হটস্পটে পরিণত হচ্ছে—জাতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সম্পদ ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা—সবই রয়েছে। যদিও আধুনিক ইভি ব্যাটারি এখনো নিকেলনির্ভর লিথিয়াম-আয়ন প্রযুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে, ব্যাটারির রসায়ন দ্রুত বদলাচ্ছে। সলিড-স্টেট, সোডিয়াম-আয়ন এবং লিথিয়াম-আয়রন ফসফেটের মতো উদীয়মান প্রযুক্তি নিরাপত্তা, খরচ ও সম্পদ-দক্ষতার কারণে গতি পাচ্ছে। এসব রসায়ন লিথিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, গ্রাফাইট এবং ক্রমশ বেড়ে চলা সোডিয়াম—এই খনিজসম্ভারের মিশ্রণের ওপর নির্ভরশীল; প্রতিটিরই সাপ্লাই চেইনে স্বতন্ত্র প্রভাব রয়েছে। তাই প্রযুক্তি যেমন বদলাবে, ইন্দোনেশিয়ার কৌশলও তেমন বদলাতে হবে।
ব্যাটারি ও ইভি উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়া এবং ইভি ব্যবহারের প্রসারে পরিবহন খাতে নির্গমন কমানোর যে লক্ষ্য—সেটির জন্য কেবল নিকেল যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তি দ্রুত পাল্টাতে থাকায় ব্যাটারি শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক ও স্থিতিস্থাপক রাখতে খনিজ সুরক্ষা ও প্রক্রিয়াকরণে কৌশলগত পরিকল্পনা দরকার।
বৈশ্বিক ব্যাটারি শক্তিকেন্দ্রে রূপ নিতে—প্রতিযোগিতামূলক থাকা ও জলবায়ুসংগত পথ বজায় রাখতে—ইন্দোনেশিয়া পাঁচটি স্তম্ভভিত্তিক একটি সামগ্রিক কৌশল নিতে পারে।
প্রথমত, খনিজ উৎসের বৈচিত্র্যায়ন। এর অর্থ হলো চীন, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য খনিজসমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে কৌশলগত আমদানি ও বাণিজ্যচুক্তির মাধ্যমে লিথিয়াম ও গ্রাফাইটে প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত করা। সাপ্লাই চেইনের স্থিতিস্থাপকতা ও বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির সম্প্রসারণ এবং আমদানি-রপ্তানি বিধি শিথিল করাও বিকল্প হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ব্যাটারি শোধন ও প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতায় বিনিয়োগ। নিকেল শোধনে ইন্দোনেশিয়া এগিয়ে থাকলেও অন্যান্য খনিজ প্রক্রিয়াকরণে সক্ষমতা সীমিত। এখানে টাইটান প্রকল্পে নিকেল সালফেট প্রক্রিয়াকরণ ও ক্যাথোড উৎপাদন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, আর ড্রাগন প্রকল্প ব্যাটারি পুনর্ব্যবহার ও উন্নত উপাদান প্রক্রিয়াকরণে প্রসারিত হওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে।
তৃতীয়ত, উন্নত ব্যাটারি উৎপাদন গড়ে তোলা। বর্তমান ব্যাটারি উৎপাদন সক্ষমতা ইন্দোনেশিয়ার নিজস্ব ইভি লক্ষ্য পূরণ করতেই অপ্রতুল—আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক বাড়তি চাহিদা মেটানো তো আরও দূরের কথা। চলমান প্রকল্প ও পরিকল্পনা মিলিয়ে দেশের ইভি উৎপাদন লক্ষ্যের প্রায় ২৫ শতাংশই এখন পর্যন্ত আচ্ছাদিত।
চতুর্থত, ব্যাটারি গবেষণা-উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) ও উদ্ভাবনে সমর্থন। স্বল্প-কার্বন ব্যাটারি প্রযুক্তি, পুনর্ব্যবহার এবং দ্বিতীয় জীবন-প্রয়োগে বিনিয়োগে জোর দিতে হবে। উদ্ভাবনই শিল্পকে ভবিষ্যৎ-সহনশীল করে এবং পরিবেশগত প্রভাব কমায়। ক্লাইমেটওয়ার্কস সেন্টার ও পুরনোমো ইউসগিয়ান্তোরো সেন্টার এই খাতে ইন্দোনেশিয়ার সম্ভাবনা অন্বেষণে একটি নতুন ব্যাটারি গবেষণা নেতৃত্ব দিচ্ছে।
পঞ্চমত, সক্ষমতামূলক নীতি ও সমন্বিত বিনিয়োগ কাঠামো গড়ে তোলা। ইভি রোডম্যাপে টেকসই ব্যাটারি শিল্পের জন্য স্পষ্ট নীতির ঘাটতি রয়েছে। সংরক্ষণবাদী নীতি থেকে অধিক উন্মুক্ত বাজার-ভিত্তিক নীতিতে রূপান্তর, ব্যবসা সহজীকরণ এবং খনন খাতে পরিবেশগত সুরক্ষা কঠোরভাবে প্রয়োগ—এসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ইন্দোনেশিয়া শুধু নিকেল বা অন্যান্য খনিজ সরবরাহ করেই থেমে থাকতে পারে না। বরং দ্রুততার সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত ও বহুমুখীকরণ করে ইন্দোনেশিয়া কেবল প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখাই নয়, বৈশ্বিক নেতৃত্বও অর্জন করতে পারে।
লেখক: জান্নাতা “এগি” গিওয়াংকারা মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেটওয়ার্কস সেন্টারের ইন্দোনেশিয়া প্রোগ্রামের ইমপ্যাক্ট ম্যানেজার।