কয়েক দিনের ব্যবধানে ইউরোপে ইহুদি–ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট একাধিক অনুষ্ঠান নিরাপত্তা-ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে বাতিল করা হয়েছে। সুইডেনের মালমোতে নভেম্বরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল জিউইশ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল; জনমত ও নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কায় কোনো সিনেমা হলই আয়োজনের দায় নেয়নি, ফলে উৎসবটি বাতিল হয়েছে।
এরপর জানানো হয়েছে, ৬ নভেম্বর অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে ইউরোপা লিগের ম্যাচে মাকাবি তেল আবিবের সমর্থকেরা স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে পারবেন না। মালমোর ঘটনার মতোই ব্রিটিশ পুলিশ একই কারণ দেখিয়েছে।
ইউরোপজুড়ে ইহুদি বা ইসরায়েল–সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হওয়া নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক। বিষয়টি এত দূর গেল কীভাবে? উদারতাবাদ ও আইনের শাসনের আদর্শ নিয়ে গর্ব করা ইউরোপ কেমন করে নিজ আদর্শ রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে?
নিষেধাজ্ঞা কী বার্তা দিচ্ছে
গ্রেট ইয়ারমাউথের স্বতন্ত্র এমপি রুপার্ট লো লিখেছেন, “শুধু মুসলমানেরা অপমানিত হতে পারে বলে আমাদের ফুটবল সমর্থকদের ব্রিটেনে ঢুকতে বাধা দেওয়া উচিত নয়।” সন্দেহ নেই, এই নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিকভাবে প্রণোদিত এবং কথিত প্রো-ফিলিস্তিন শিবিরের সাজানো। ইসলামপন্থী ও অতিবামপন্থীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই শিবির সংগঠিত ও অর্থসামর্থ্যসম্পন্ন এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
‘গাজা’ ইস্যুকে হাতিয়ার করে এবং ইহুদিরা ‘শিশুহন্তা’, গাজায় ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে—এই প্রাচীন অপবাদকে পুঁজি করে তারা পশ্চিমা সমাজের রাজনৈতিক বাগবিতণ্ডা নিজেদের মতো করে ঘুরিয়ে দিতে পেরেছে। এই জোট ইহুদিবিদ্বেষকে সামাজিক প্রবণতায় রূপ দিয়েছে; পশ্চিমা সরকারগুলো যদি এখানে লাগাম না টানে, তাহলে এর শেষ কোথায়—আমি ভাবি।
অক্টোবর ৭–এর পর ঘৃণা–অপরাধের ঢেউ
অক্টোবর ৭–এর পর পশ্চিম ইউরোপে ইহুদিবিদ্বেষী হামলা তীব্রভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে গত কয়েক দশকের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষী ঘটনার সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। অক্টোবর ৭–এর আগে এই হামলাগুলোর বেশিরভাগেরই অভিযুক্ত হিসেবে ‘শ্বেতাঙ্গ, অমুসলিম’ ব্যক্তিদের বর্ণনা করা হতো।
হামাসের সন্ত্রাসী হামলার পর লন্ডন, প্যারিস, আমস্টারডামের মতো ইউরোপের বড় বড় রাজধানীতে অপরাধীর চেহারায় স্পষ্ট পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। পুলিশ রেকর্ড বলছে, অধিকাংশ অপরাধী অশ্বেতাঙ্গ; বিশেষত মুসলিম অভিবাসী পটভূমির মানুষের সংশ্লিষ্টতা বেশি। রাজনীতিক, পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও সিভিল সোসাইটির অনেকে স্বীকার করতেই কুণ্ঠাবোধ করেন যে যুক্তরাজ্যে ইহুদিবিদ্বেষ এখন মহামারীর মতো, এবং তা ব্রিটিশ মুসলমানদের একটি অংশের ইসরায়েল ও ইহুদিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে বাতাস পাচ্ছে।
অনেকেই প্রকাশ্যে বলতে ভয় পান—ইসলামপন্থী গোষ্ঠী এবং তাদের সংখ্যা-স্বল্প কিন্তু উচ্চকণ্ঠ অতিবাম ‘ওয়োক’ সমর্থকেরা যে পশ্চিমা সমাজের জন্য—শুধু ইহুদি সম্প্রদায় নয়, সবার জন্য—হুমকি তৈরি করছে। তাঁরা আশঙ্কা করেন, ‘বর্ণবিদ্বেষী’, ‘ইসলামবিদ্বেষী’ তকমা জুটে যাবে, কিংবা ‘ক্যানসেল’ করা হবে।
ব্রিটেনে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
অক্টোবর ৭–এর কয়েক সপ্তাহ আগে আমি ইসরায়েলে আল জাজিরা চ্যানেলের এক তথ্যচিত্র—“আভ্রাহাম স্টার্ন: মানুষটি, সংগঠন ও রাষ্ট্র”—এর প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছি। পুরো টিম ও পরিচালক—সকলেই আরব মুসলমান—এর সঙ্গে আমার কাজের সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো।
কিন্তু অক্টোবর ৭–এর পর যুক্তরাজ্যে ফিরে আমি ঘৃণা ও হুমকির ঢেউয়ে আক্রান্ত হই। আমাকে “অপরাধী জায়নিস্ট” বলা হয়েছে; এক্স ও ফেসবুকের মতো উন্মুক্ত ফোরামে আমাকে “মিথ্যাবাদী” ও “দেশদ্রোহী” আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এমনকি যেসব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছি, তাদের কাছে আমার ‘আইডিএফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ আছে—এমন মিথ্যা অভিযোগ পাঠিয়ে আমাকে কাজ না দেওয়ার অনুরোধও করা হয়েছে।
আজ ব্রিটেনজুড়ে ছোট-বড় বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইহুদিদের সঙ্গে ব্যবসা করতে কুণ্ঠাবোধ করছে—অত্যন্ত সুসংগঠিত ও অর্থসচ্ছল প্রো-ফিলিস্তিন গোষ্ঠীর ভয়ে। আমি নিজ চোখে দেখেছি—ইসরায়েলি পণ্য রাখে এমন দোকানে হামলে পড়া, ক্রেতাদের গলায় গলায় পড়ে ভয় দেখানো, জনসমাবেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, ব্যস্ত রেলস্টেশনে ঢুকে চিৎকার-চেঁচামেচি করা; লন্ডনসহ শহরজুড়ে মিছিল করে প্ল্যাকার্ডে ইসরায়েলিদের নাৎসিদের সঙ্গে তুলনা, ইসরায়েল ধ্বংসের ডাক, হামাসকে প্রকাশ্যে মহিমান্বিত করা এবং ‘অক্টোবর ৭–এর বিজয়’ উল্লাসে নাচানাচি—সবই দেখেছি।
রাজনীতিবিদদের ভূমিকা ও প্রভাব
ইসরায়েলি সমর্থকদের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তটি সামনে এগিয়ে নিয়েছেন ব্রিটিশ–মুসলিম স্বতন্ত্র এমপি আয়ুব খান। সিদ্ধান্তের পরপরই তিনি ভিডিও বার্তায় বলেছেন, “বার্মিংহামের মানুষের জন্য—বিশেষ করে অ্যাস্টনের বাসিন্দাদের জন্য—এটি দারুণ খবর। মাকাবি তেল আবিবের সমর্থকদের এখানে আসার বিরুদ্ধে আমি একটি পিটিশন শুরু করেছিলাম।”
আরেক ব্রিটিশ–মুসলিম এমপি জারা সুলতানা তার আনন্দ প্রকাশ করে লিখেছেন, “এরপর উয়েফাকে সব ইসরায়েলি দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে। গণহত্যা ও বর্ণবৈষম্যের সঙ্গে কোনো স্বাভাবিকীকরণ চলতে পারে না।” আজ ব্রিটেনে ২০–এর বেশি এমপি—লেবারের কয়েকজন ব্যাকবেঞ্চারসহ—‘গাজা এজেন্ডা’কে ভর করে নির্বাচিত হয়েছেন। আয়ুব খানও প্রো–গাজা প্ল্যাটফর্মে লড়ে জিতেছেন।
ইসরায়েলি ফুটবল সমর্থকদের নিষেধাজ্ঞা দেখিয়ে দিচ্ছে—ব্রিটেন শুধু তার ইহুদি নাগরিকদেরই নয়, বরং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় ব্রিটিশ জনগণকেও হতাশ করেছে। এই সিদ্ধান্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর—পুলিশসহ—হতশ্রী অবস্থার মুখোশ খুলে গেছে। বার্তাটি অত্যন্ত স্পষ্ট: ইসলামপন্থী এজেন্ডা জিতে গেছে; আমরা ইহুদি ফুটবল দর্শকদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না—দুঃখিত।
ইউরোপের গভীরতর সংকট
শুধু যুক্তরাজ্যই নয়, ইউরোপের বড় বড় দেশও বহু বছর ধরে ইসলামপন্থী ও অতিবাম উগ্রতার গুরুতর সমস্যায় ভুগছে। তাদের সহিংস আচরণ ও ইহুদিবিদ্বেষী ঘৃণাভাষণ বছরের পর বছর অবহেলিত থেকে পচন ধরেছে।
গত বছর হেনরি জ্যাকসন সোসাইটি “ব্রিটিশ মুসলিম ও সাধারণ জনগণের মনোভাব: জরিপ” শীর্ষক ৫০ পৃষ্ঠার একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, ‘পুরোনো’ ইহুদিবিদ্বেষী ধাঁচের বহু বক্তব্য ব্রিটিশ মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। অধিকাংশই নিজেদের ইহুদিবিদ্বেষী নয়, ‘কেবল’ ইসরায়েলবিরোধী বলে দাবি করলেও তথ্যের গভীর বিশ্লেষণ দেখায়—ইসরায়েলের প্রতি ঘৃণা বা বিরোধিতা অনেক সময় ইহুদিবিদ্বেষকে খোরাক জোগায়। প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে—রাজনীতি, ব্রিটিশ সমাজ, ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত ও ইহুদিবিদ্বেষ বিষয়ে সাধারণ ব্রিটিশ জনগণ ও ব্রিটিশ মুসলমানদের মনোভাবের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে।
আইনের শাসনের স্বার্থে আহ্বান
আইনের শাসনের নীতির খাতিরে আমি আশা করি—জনপ্রতিনিধিত্বমূলকভাবে নির্বাচিত ব্রিটিশ সরকার এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে এবং এই প্রহসনের ইতি টানবে—এবারের মতো চূড়ান্তভাবে।
লেখক পরিচিতি: সুজান কুইতাজ—কুর্দি–সুইডিশ সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক।