নির্বাচনের আগের চিত্র: তরুণ ও প্রগতিশীল তরঙ্গে জোহরানের উত্থান
অক্টোবরের এক রৌদ্রোজ্জ্বল শনিবার বিকেলে ম্যানহাটনের আপার ওয়েস্ট সাইডে একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবক বেরিয়ে পড়েছিল দরজায় দরজায় প্রচার চালাতে। তাদের লক্ষ্য— ৩৪ বছর বয়সী প্রগতিশীল নেতা জোহরান মামদানিকে নিউইয়র্কের পরবর্তী মেয়র হিসেবে তুলে ধরা।
সাবেক কাউন্সিলওম্যান হেলেন রোজেনথাল তাদের উপদেশ দিচ্ছিলেন— “দরোয়ানের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ো না, বিরোধীদের সঙ্গে ঝগড়া কোরো না। কেবল বোঝাও যে মামদানির কর্মীরা মার্জিত।”
এই আত্মবিশ্বাসের কারণও স্পষ্ট— জরিপ ও বাজির বাজারের তথ্য বলছে, মামদানি ৪ নভেম্বরের নির্বাচনে সহজেই জয় পেতে পারেন। তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী, সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন, কিন্তু তাঁর পক্ষে ভোট ব্যবধান দুই অঙ্কে পিছিয়ে।
প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতীক: এক তরুণ সমাজতান্ত্রিকের দুঃসাহসী স্বপ্ন
জোহরান মামদানি যদি জয় পান, তবে সেটি হবে নিউইয়র্কের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। নির্বাহী অভিজ্ঞতা ছাড়াই একজন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট দেশের বৃহত্তম শহরের ৩ লক্ষ কর্মী ও ১১৬ বিলিয়ন ডলারের বাজেটের নেতৃত্ব নিতে যাচ্ছেন।
তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি সাহসী— ভাড়া স্থগিত রাখা, বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন বাসস্থান, বিনামূল্যে শিশুসেবা ও বাসযাত্রা। এই “অ্যাফোর্ডেবিলিটি” এজেন্ডাই তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছে তরুণ, বহুজাতিক ভোটারদের কাছে। মামদানি সংস্কৃতি যুদ্ধের ফাঁদে পা দেননি, এমনকি ট্রাম্পের “কমিউনিস্ট” তকমারও পাল্টা দেননি।

দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জনগণের হতাশা: মামদানির পক্ষে দুই বড় কারণ
বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পুনর্নির্বাচনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা ভোটারদের বিরক্ত করে। ট্রাম্পের সঙ্গে গোপন সমঝোতার পর তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি শেষ হয়। অন্যদিকে, কুয়োমো এখনো যৌন হয়রানির অভিযোগের ছায়া থেকে মুক্ত নন।
এই বিশৃঙ্খল প্রেক্ষাপটে মামদানির আবির্ভাব ভোটারদের কাছে এক নতুন আশার বার্তা। নাগরিক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ নিউইয়র্কবাসী মনে করেন তাঁদের জীবনমান ভালো, যা আট বছর আগের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। ফলে শহরের ধনী ব্যবসায়ীরা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন— এবং মামদানি ঠিক সেই ক্ষোভের মূলে আঘাত করছেন।
রাজনৈতিক বাস্তবতা: রাজ্য সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি
অক্টোবরের মাঝামাঝি মামদানি নিজের আসন অ্যাস্টোরিয়ায় রাজ্য গভর্নর ক্যাথি হোকুলের সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত হন। হোকুল ঘোষণা দেন— ৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে এলাকার বালক-বালিকা ক্লাবের উন্নয়ন ও ২০০টি সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হবে।
মঞ্চে এই সমঝোতা ছিল স্পষ্ট— মামদানির শিশু যত্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজ্যের সহায়তা প্রয়োজন, যার বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। হোকুলও পুনর্নির্বাচনের পথে রাজ্য তহবিল বা কর বাড়ানোর মাধ্যমে মামদানির সমর্থক ঘাঁটিতে প্রভাব ফেলতে চান।
আর্থিক বাস্তবতা: স্বপ্নের সঙ্গে ঘাটতির দ্বন্দ্ব
মামদানির ঘোষিত প্রতিশ্রুতিগুলির সবই বাস্তবায়ন কঠিন। বিনামূল্যে বাস ও সরকারি মুদি দোকান চালু করা তেমন ব্যয়বহুল না হলেও, শিশুসেবা ও আবাসন বিনিয়োগের মতো প্রকল্পগুলো শহরের একার পক্ষে সম্ভব নয়। নাগরিক বাজেট কমিশন (CBC) অনুমান করছে, নতুন মেয়রের হাতে ন্যূনতম ৬ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি থাকবে।

তার ওপর কেন্দ্র সরকার সাম্প্রতিক কংগ্রেস বিলের মাধ্যমে মেডিকেইড ও অন্যান্য কর্মসূচির তহবিল কেটে দেওয়ায় নিউইয়র্ক রাজ্য প্রতিবছর প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার হারাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে শহরের সরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থায়।
ট্রাম্প ফ্যাক্টর: হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সংঘাতের আশঙ্কা
যদি মামদানি জয়ী হন, তাহলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হতে পারে। বর্তমানে নিউইয়র্ক শহরের বাজেটের ৬.৪ শতাংশ (৭.৪ বিলিয়ন ডলার) আসে ফেডারেল অনুদান থেকে, যা মূলত শিক্ষা ও আবাসন খাতে ব্যবহৃত হয়। ট্রাম্প প্রশাসন যদি এই তহবিল কমায়, মামদানি রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে চাপে পড়বেন।
ম্যানহাটন ইনস্টিটিউটের গবেষক নিকোল গেলিনাস বলেন, “তাঁর প্রথম কাজ হবে ফেডারেল অনুদান রক্ষা করা— কিন্তু ট্রাম্পকে লাগাতার আক্রমণ করলে জনমত হারানোর আশঙ্কা থাকবে।”
প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ: অভিজ্ঞতার অভাব নাকি সুযোগ?
নিউইয়র্কের মেয়র হিসেবে মামদানির হাতে থাকবে বিপুল ক্ষমতা, কিন্তু আয়কর সমন্বয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজ্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হবে। তাঁর সুবিধা— কোনো পুরনো স্বার্থগোষ্ঠীর সঙ্গে জটিল সম্পর্ক নেই।
তিনি ইতিমধ্যেই বলেছেন, “আমি সেরা ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে চাই— ব্লুমবার্গের মতো বাস্তবধর্মী দল।” এমনকি তিনি বর্তমান পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশকেও রাখতে চান, যাকে প্রগতিশীলরা পছন্দ করেন না।
সম্ভাব্য সংঘাত, সম্ভাব্য ইতিহাস
ট্রাম্প প্রশাসন যদি নিউইয়র্কের ওপর চাপ বাড়ায়, তাতে জাতীয় রাজনীতিতেও প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। ফেডারেল তহবিল স্থগিত বা অবকাঠামো প্রকল্প বাতিল করলে ট্রাম্প নিজেও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়বেন। নিউইয়র্কের বিশাল পুলিশ বাহিনী ও শক্তিশালী ডেমোক্র্যাট প্রশাসন ফেডারেল হস্তক্ষেপ সহজে মেনে নেবে না।

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের নগরনীতি বিশারদ মিচেল মস মন্তব্য করেছেন, “ট্রাম্প জানেন না, কীভাবে জোহরান মামদানির মতো রাজনীতিকের সঙ্গে লড়তে হয়।”
নতুন যুগের সূচনা নাকি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?
যদি ৪ নভেম্বর নিউইয়র্কবাসী মামদানিকে নির্বাচিত করেন, তাঁরা কেবল এক তরুণ ও সাহসী সংস্কারকেই নয়, এক নতুন রাজনৈতিক নাটকের পর্দা উন্মোচন করবেন— যা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে যুগান্তকারী প্রভাব ফেলতে পারে।
#নিউইয়র্ক #জোহরান_মামদানি #মেয়র_নির্বাচন #ট্রাম্প #আমেরিকার_রাজনীতি #প্রগতিশীল_নীতি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















