নৈতিক দায়িত্বের প্রশ্ন
সম্প্রতি ইসরায়েল সফরে গিয়ে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম—একজন নাগরিক হিসেবে নৈতিকভাবে কাজ করাটা কতটা জরুরি। একটি রাষ্ট্র যখন নির্মম নীতি অনুসরণ করে, তখন নাগরিকদের প্রশ্ন জাগে—আমাদের ভূমিকা কী? আমরা কি শুধু ‘এটা আমার নামে নয়’ বললেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?
যখন যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের জন্য নতুন আটককেন্দ্র নির্মাণ করে, শহরজুড়ে নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে, আন্তর্জাতিক জলে হত্যাকাণ্ড চালায় এবং নিজের গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করে—তখন “ভালো নাগরিক” হওয়ার মানদণ্ড নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়।
ইসরায়েলে নাগরিকদের নৈতিক সংকট
ইসরায়েলে আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা সবাই এক প্রশ্নের মুখোমুখি—একজন নাগরিক হিসেবে সরকারের অন্যায় কাজের জন্য তাদের দায় কতটা? কেউ কেউ দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন, কেউ আবার মনে করেন, এখানেই থেকে লড়াই করাই নৈতিক দায়িত্ব।
মানবাধিকার আইনজীবী মাইকেল স্ফার্ড বলেন, “আমি নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগ করছি—ট্যাক্স দিচ্ছি, আলোচনায় অংশ নিচ্ছি, মানে আমি অবচেতনে রাষ্ট্রের নীতির অংশ।” তেল আভিভের একটি আরামদায়ক ক্যাফেতে তিনি বসে বললেন, “আমাদের থেকে ৪০ মাইল দূরে মানুষ অনাহারে মরছে, অথচ এখানে কফির কাপে কোনো অস্বস্তি নেই।”

স্ফার্ড পরে হা’আরেতজ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখেন—“আমরা ইসরায়েলিরা এক মাফিয়া অপরাধচক্রের অংশ। আমাদের কাজ হলো ভেতর থেকে এর বিরুদ্ধে লড়াই করা।” তিনি বলেন, গাজায় যে গণহত্যা চলছে, তা শুধু সরকারের নয়, পুরো ইহুদি ইসরায়েলি সমাজের নীরব সহযোগিতার ফল।
সেনাবাহিনীতে যোগ না দেওয়া: প্রতিবাদের শক্তিশালী উপায়
ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদের উপায় হলো সামরিক সেবায় অস্বীকৃতি। ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিচারিক স্বাধীনতা বিলোপ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে হাজারো রিজার্ভ সৈনিক ও শতাধিক কিশোর-তরুণ ঘোষণা দেন যে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন না।
এলাহ কেদার গ্রিনবার্গ, যিনি ট্রান্সজেন্ডার এবং অন্যতম সাহসী প্রত্যাখ্যানকারী, বলেন, “আমি গাজার গণহত্যায় অংশ নিতে পারি না। অস্বীকার করাটাই আমার কর্তব্য।” তিনি সেনাশিবিরে উপস্থিত হওয়ার পরপরই কারাগারে পাঠানো হন এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এক মাস কাটান। পরে তিনি দক্ষিণ হেবরনের মাসাফের ইয়াত্তায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন, যেখানে ইসরায়েলি সেনা ও উপনিবেশকারীরা প্রায় প্রতিদিনই ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোতে হামলা চালায়।
গ্রিনবার্গ বলেন, “লজ্জা বা অপরাধবোধ নয়, দায়িত্ব ও ক্রোধই আমাকে কাজ করতে বাধ্য করে। নিষ্ক্রিয় দর্শক হওয়াটাও একধরনের কাজ—এটা হয় দমনযন্ত্র বজায় রাখা, না হয় তা ভাঙা।”
দেশত্যাগ না থেকে যাওয়ার দ্বন্দ্ব
স্ফার্ডের মতো অনেকেই দেশ ছাড়ছেন। কেউ ভাবছেন সন্তানদের এমন দেশে বড় করা উচিত কিনা, যেখানে সামাজিক বিভাজন, ধর্মীয় প্রভাব ও উগ্রতা বাড়ছে। কেউ কেউ আবার মনে করেন, ইউরোপে গেলে তাদের সন্তানরা চরম ইসরায়েলবিরোধী মনোভাবের মুখে পড়বে।
সবার মনে এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—তাদের সন্তানরা ১৮ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে কী হবে? ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় কাঠামোই এমনভাবে গঠিত, যেখানে প্রায় সবাইকে সামরিক নীতির অংশ হতে হয়।

নোয়াম শুস্টার-এলিয়াসি: ব্যঙ্গের মাধ্যমে প্রতিবাদ
কমেডিয়ান নোয়াম শুস্টার-এলিয়াসি ‘ওয়াহাত-আল-সালাম/নেভে শালোম’ নামের এক মিশ্র গ্রামে থাকেন, যেখানে ইহুদি ও ফিলিস্তিনি নাগরিকরা একসঙ্গে বসবাস করে। তিনি বলেন, “আমি হাসপাতালে যাই, দেখি কেউ তার সঙ্গিনীকে সহায়তা করছে—কাঁধে এম-১৬ ঝুলছে। এই দ্বৈত বাস্তবতাই ইসরায়েলের প্রতিচ্ছবি।”
তিনি জানান, এখন অনেক কৌতুকাভিনেতা গাজার দুর্ভিক্ষ বা সহায়তা প্যাকেটের নিচে মারা যাওয়া শিশুদের নিয়ে রসিকতা করেন। “তাদের সঙ্গে আমি একই মঞ্চে দাঁড়িয়েছি। এটাই আমাকে ভাবায়, আমি কেবল ভাগ্যবান যে ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছি।”
বিবেকের দায় ও প্রতিরোধের সাহস
চলচ্চিত্র নির্মাতা যোনাথন ডেকেল, যিনি প্রথমে সামরিক সেবায় অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, হামাসের ৭ অক্টোবর আক্রমণের পর আবার সেনায় যোগ দেন। কিন্তু পরে তিনি বুঝতে পারেন, যুদ্ধের ন্যায্যতা হারিয়ে গেছে। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন, যেন চিরস্থায়ী সক্রিয় দায়িত্ব থেকে মুক্তি পান।
তিনি বলেন, “আমেরিকানরাও দায়মুক্ত নয়। যারা গাজার ওপর বোমা ফেলার অর্থ জোগায়, তারাও এই সহিংসতার অংশ।”

ভালো নাগরিক হওয়ার আসল অর্থ
এই ইসরায়েলিদের গল্প একটাই শিক্ষা দেয়—খারাপ রাষ্ট্রে ভালো নাগরিক হতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়। সেটা হতে পারে সরকারের বিরুদ্ধে কলাম লেখা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রত্যাহার করা, কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে শরীর দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা।
ভালো নাগরিক হওয়া মানে শুধু নিয়ম মেনে চলা নয়—অন্যায়ের মুখে নীরব না থাকা।
#নৈতিকদায়িত্ব #ইসরায়েলসংকট #ভালোনাগরিক #মানবাধিকার #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















