রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ঘোষণা করেছেন যে তিনি আর পুনর্নির্বাচনে অংশ নেবেন না এবং চলতি মেয়াদ শেষে কংগ্রেস থেকে অবসর নিচ্ছেন।
৮৫ বছর বয়সী এই ডেমোক্র্যাট নেত্রী যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে হাউস স্পিকার নির্বাচিত হন ২০০৭ সালে।
তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি স্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ঐতিহাসিক আইন পাসে নেতৃত্ব দেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দুবার অভিশংসন প্রক্রিয়া চালান।
ঐতিহাসিক নেতৃত্ব ও সংকট মোকাবিলা
পেলোসি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে বিবেচিত।
তার নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটরা ‘অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’ ও ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করে, যা স্বাস্থ্যখাত ও জলবায়ু ব্যয়ে বিশাল প্রভাব ফেলে।
তিনি কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মহামারি কোভিড-১৯-এর অস্থির সময় এবং ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল দাঙ্গার মধ্য দিয়েও।
নিজের শহরকে উদ্দেশ্য করে বার্তা
এক ভিডিও বার্তায় পেলোসি বলেন,
“আমার প্রিয় সান ফ্রান্সিসকোর মানুষদের জানাতে চাই—আমি কংগ্রেসে আর প্রার্থী হচ্ছি না।”
তিনি স্মরণ করেন ১৯৮৭ সালের প্রথম নির্বাচনী প্রচারের স্লোগান—“একটি কণ্ঠ, যা শোনা যাবে”—যা আজ ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মনে হয় বলে উল্লেখ করেন।
পেলোসি বলেন, জনগণের সমর্থনই তাকে ‘মার্বেল ছাদ’ ভেঙে প্রথম নারী স্পিকার হতে সাহায্য করেছে।
কঠোর নেতৃত্ব ও দলের ঐক্য
পেলোসির রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও দলের বিভিন্ন অংশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষমতা তাকে প্রশংসিত করেছে, এমনকি রিপাবলিকান বিরোধীরাও তার রাজনৈতিক দক্ষতাকে স্বীকার করেছেন।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অভ্যন্তরে কঠিন ভোটের সময়, তিনি বহু সদস্যের অবস্থান পরিবর্তনে পারদর্শী ছিলেন।
তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনে না দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়ে নিজের প্রভাব আবারও প্রমাণ করেন।
শ্রদ্ধা ও প্রশংসা
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সামাজিক মাধ্যমে এক বিবৃতিতে পেলোসিকে “মার্কিন ইতিহাসের সেরা স্পিকার” বলে উল্লেখ করেন এবং জানান, ২০২৪ সালে তিনি পেলোসিকে ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ প্রদান করেছিলেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাকে “হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্পিকার” বলে অভিহিত করেন।
অন্যদিকে, সাবেক স্পিকার নিউট গিংরিচ, যদিও পেলোসির সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে একমত নন, তবুও তাকে “অসাধারণ কার্যকর নেতা” হিসেবে স্বীকার করেন।
শিকড় থেকে উঠে আসা রাজনীতি
মারিল্যান্ডের এক ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান ও বাল্টিমোরের সাবেক মেয়রের কন্যা পেলোসি ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন।
কলেজ শেষে সান ফ্রান্সিসকোতে গিয়ে তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ১৯৮৭ সালে প্রথম কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হন।
দুই দশক পর তিনি স্পিকারের আসনে বসেন।
তার নেতৃত্বের সময়কাল দুই ধাপে—২০০৭ থেকে ২০১১ এবং ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত।
২০২২ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর তিনি দলীয় নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেও নিজের আসন ধরে রাখেন।
তার স্থলাভিষিক্ত হন নিউইয়র্কের হাকিম জেফরিস, যিনি কংগ্রেসে কোনো দলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নেতা।
ট্রাম্প যুগে মুখোমুখি সংঘর্ষ
ট্রাম্প প্রশাসনের সময় পেলোসি ছিলেন তার অন্যতম প্রধান সমালোচক।
২০১৯ সালে হোয়াইট হাউসে এক উত্তপ্ত বৈঠকে ট্রাম্পের দিকে আঙুল তুলে কথা বলার ছবি ভাইরাল হয়, যা পরবর্তীতে পেলোসির সমর্থকরা রাজনৈতিক প্রতীকে পরিণত করেন।
২০২০ সালে তিনি ট্রাম্পের ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণের কপি প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলেন—যা ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
তার নেতৃত্বেই ট্রাম্পকে দুবার অভিশংসন করা হয়—একবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ফোন করে বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্তের আহ্বানের ঘটনায়, আরেকবার ৬ জানুয়ারির দাঙ্গার ঘটনায়।
তবে দুই ক্ষেত্রেই সিনেট তাকে অব্যাহতি দেয়।
ট্রাম্প পরে মন্তব্য করেন, “তিনি অতিমূল্যায়িত রাজনীতিক, তার অবসর আমেরিকার জন্য ভালো।”
নারী নেতৃত্বের নতুন দিগন্ত
পেলোসির সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার হলো নারীদের রাজনীতিতে অগ্রযাত্রা।
১৯৮৭ সালে যখন তিনি কংগ্রেসে আসেন, তখন নারী সদস্য ছিলেন মাত্র ২৪ জন।
২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার স্পিকার হওয়ার সময় সেই সংখ্যা পেরিয়ে যায় ১০০-এর বেশি।
তিনি অসংখ্য নারী নেত্রীকে প্রার্থী হতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তহবিল সংগ্রহেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা
পেলোসির অবসরে সান ফ্রান্সিসকোর আসনটি এখন খোলা হয়ে পড়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে ডেমোক্র্যাটদের শক্ত ঘাঁটি।
রাষ্ট্রীয় সিনেটর স্কট উইনার ইতিমধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এবং সাবেক মেয়র লন্ডন ব্রিডও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে পারেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।
এক নারীর দৃঢ়তার প্রতীক
ন্যান্সি পেলোসির রাজনৈতিক জীবন শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও নারীর নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে থাকবে—এক নারীর দৃঢ়তা, নীতি ও নেতৃত্বের ইতিহাস হিসেবে।
#NancyPelosi #USPolitics #WomenInLeadership #Democrats #Congress #SarakkhonReport #PelosiRetirement #WorldPolitics
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















