রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল: নারীর জীবনের ঝুঁকি
আফগানিস্তানে মাতৃমৃত্যুর হার বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি এক লক্ষ জন্মে ৬৩৮ জন মা মারা যাচ্ছেন। দ্য ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, আফগান নারীরা বর্তমানে দক্ষ সহায়তা ছাড়াই সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, যার ফলে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
তিনজন ক্লিনিশিয়ান তাঁদের প্রতিবেদনে লিখেছেন, “আফগানিস্তানে এখনকার মাতৃস্বাস্থ্য সংকট শুধুমাত্র চিকিৎসাগত নয়, এটি রাজনৈতিকও। যখন নারীদের ষষ্ঠ শ্রেণির পর পড়াশোনা নিষিদ্ধ করা হয়, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, এবং মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়, তখন ফলাফলটি অনিবার্যভাবে মর্মান্তিক হয়।”
শিক্ষা ও কর্মসংস্থান বন্ধের মারণ প্রভাব
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নারীদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আফগানিস্তানে “প্রাণঘাতী পরিণতি” ডেকে এনেছে। কারণ, সাংস্কৃতিক কারণে নারী রোগীরা পুরুষ চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা নিতে পারেন না। এর ফলে জরুরি প্রসূতি সেবা না পাওয়ায় অনেক মা রক্তক্ষরণ, এক্ল্যাম্পসিয়া, সেপসিস বা প্রসব জটিলতায় মারা যাচ্ছেন।
ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও বিপুল চাহিদা
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (UNHCR) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন ভঙ্গুর ও অপ্রতুল সম্পদনির্ভর। ২০২৪ সালে ১৭.৯ মিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। এছাড়াও দেশে এখনো রয়েছে অসম স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব, অপুষ্টি এবং মাতৃ-শিশু মৃত্যুহার অত্যন্ত বেশি।

মাতৃস্বাস্থ্য সেবায় ভয়াবহ ঘাটতি
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, মাত্র ৬.২ শতাংশ আফগান নারী গুণগত মানের অ্যান্টেনাটাল (গর্ভকালীন) সেবা পেয়েছেন। ২০২২–২৩ সালের আফগানিস্তান মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে জানায়, মাত্র ৩৬.৩ শতাংশ মা সন্তান জন্মের দুই দিনের মধ্যে পোস্টনাটাল পরীক্ষা করাতে পেরেছেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কর্তৃপক্ষ নারীদের উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ করে: যার মধ্যে নার্সিং ও মিডওয়াইফারিও ছিল। এর ফলে দক্ষ নারী স্বাস্থ্যকর্মী তৈরির শেষ পথটিও বন্ধ হয়ে যায়। নারীদের জন্য বিশেষ ক্লিনিক ও মানবিক সংস্থার সেবা স্থগিত করা হয়েছে, কারণ সেখানে নারী কর্মী নিয়োগের অনুমতি নেই।
অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় গভীর প্রভাব
ল্যানসেটের আরেকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু মাধ্যমিক শিক্ষায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে ২০২২ সালে আফগান অর্থনীতি অন্তত ৫০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যদি ওই বছরের ৩০ লাখ মেয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারত, তবে তা দেশের অর্থনীতিতে ৫.৪ বিলিয়ন ডলার অবদান রাখতে পারত। এই সিদ্ধান্ত কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং দেশের দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরও আরও চাপ সৃষ্টি করেছে।
মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষায় চারটি সুপারিশ
দ্য ল্যানসেটের প্রতিবেদনে আফগান মাতৃস্বাস্থ্য রক্ষায় চারটি কৌশল প্রস্তাব করা হয়েছে:
১. নারীর কাজ ও শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা, বিশেষত মিডওয়াইফারি ও নার্সিং খাতে, অবিলম্বে প্রত্যাহার করা।
২. বর্তমান নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা ও সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং মিডওয়াইফারি স্কুল পুনরায় চালু করা।
৩. আন্তর্জাতিক দাতাদের নিশ্চিত করতে হবে যে নারীদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসেবা অপরিবর্তনীয় একটি শর্ত।
৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণে তথ্য ও পরিসংখ্যানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যাতে সঠিক পরিকল্পনা ও সম্পদ বণ্টন সম্ভব হয়।

নারীরা হারাচ্ছেন শেষ আশাও
ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবার অভাব এখন “অপ্রশিক্ষিত হাতে বাড়িতে প্রসব, জটিলতার সময় জরুরি চিকিৎসা না পাওয়া এবং প্রতিরোধযোগ্য মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যুর” কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি, সেপ্টেম্বর মাসে বিবিসি জানায় যে, তালেবান এখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে নারীদের শেষ শিক্ষার সুযোগটিও কেড়ে নিয়েছে।
মানবাধিকারের সঙ্কট
প্রতিবেদনের শেষে লেখকরা বলেছেন, “নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা কোনো ঐতিহ্য নয়; এটি একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত, যার মাশুল প্রাণহানিতে পরিণত হচ্ছে। আফগান নারীদের শেখার, কাজ করার ও নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দিন। মায়েদের স্বাস্থ্য, নবজাতকের টিকে থাকা, এবং পুরো সমাজের মঙ্গল এর ওপরই নির্ভর করে। এটি কেবল স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নয়—এটি মানবাধিকারের এক গভীর সঙ্কট।”
#আফগানিস্তান #মাতৃস্বাস্থ্য #নারীশিক্ষা #স্বাস্থ্যসংকট #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















