দীর্ঘ যুদ্ধের অবসানে নতুন আইনি পরিকল্পনা
তুরস্ক এমন একটি আইন প্রণয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে যার মাধ্যমে হাজার হাজার পিকেকে (কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি) যোদ্ধা ও বেসামরিক নাগরিকদের উত্তর ইরাকের পাহাড়ি ঘাঁটি থেকে দেশে ফেরার সুযোগ দেওয়া হবে। এই পদক্ষেপটি দেশটিতে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতের অবসান ঘটানোর আলোচনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
একজন জ্যেষ্ঠ মধ্যপ্রাচ্য কর্মকর্তা এবং তুরস্কের একটি কুর্দি রাজনৈতিক দলের সূত্র জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত আইনে ফেরত আসা ব্যক্তিদের সুরক্ষা দেওয়া হবে, তবে এটি কোনো সাধারণ ক্ষমা (amnesty) নয়। অর্থাৎ, অতীতে সংঘটিত অপরাধের দায় থেকে সবাই মুক্তি পাবেন না। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কিছু শীর্ষস্থানীয় যোদ্ধাকে তৃতীয় দেশে পাঠানো হতে পারে।
আলোচনার সংবেদনশীলতা ও শান্তি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি
এক বছর আগে শুরু হওয়া শান্তি প্রক্রিয়ার অন্যতম চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে পিকেকে সদস্য ও তাদের পরিবারকে দেশে ফিরিয়ে আনার এই প্রচেষ্টা। এই যুদ্ধ ইতোমধ্যেই প্রায় ৪০ ০০০ মানুষের প্রাণ কেড়েছে।
এখন পর্যন্ত তুরস্ক সরকার পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু কথা বললেও, এইবার প্রথমবারের মতো জানা গেছে যে ফেরত প্রক্রিয়াটি দুই ধাপে হতে পারে—প্রথমে বেসামরিকদের, পরে যোদ্ধাদের। শীর্ষ কমান্ডারদের তৃতীয় দেশে পাঠানোর বিষয়েও আলোচনা চলছে।

গোপন আলোচনার বিষয়ে অবগত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই ফেরত প্রক্রিয়ার আইন নভেম্বরের শেষ নাগাদই তুরস্কের পার্লামেন্টে আনা হতে পারে।
ধাপে ধাপে প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা
তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা এমআইটি, যারা পিকেকের সঙ্গে আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
১৯৮৪ সালে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে শুরু হওয়া বিদ্রোহ তুরস্ক ও প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করেছে। এই সংঘাতের অবসান তুরস্কের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ বছর মে মাসে, বন্দি নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের আহ্বানে, সাড়া দিয়ে পিকেকে অস্ত্র পরিত্যাগ ও বিলুপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। জুলাইয়ে তারা প্রতীকীভাবে অস্ত্র দাহ করে এবং অক্টোবর মাসে তুরস্ক থেকে যোদ্ধা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। সংগঠনটি আনকারাকে আহ্বান জানায় তাদের সদস্যদের “গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে” অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে।
তুরস্কের শর্ত ও সতর্কতা
তবে পুনর্মিলনের শর্তগুলো বেশ সংবেদনশীল। তুরস্ক কোনোভাবেই অতীতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনতে চায় না।

তুরস্কের পুনর্মিলন কমিশনের প্রধান নুমান কুরতুলমুশ বলেছেন, “যখন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হবে যে পিকেকে সম্পূর্ণভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেছে এবং বিলুপ্ত হয়েছে, তখনই আমরা সন্ত্রাসমুক্ত তুরস্ক গঠনের জন্য নতুন আইনি ধাপে প্রবেশ করব।”
সূত্র জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম ধাপে প্রায় এক হাজার বেসামরিক ব্যক্তি ও অযোদ্ধা ফিরবেন। এরপর প্রায় আট হাজার যোদ্ধা ব্যক্তিগত যাচাই-বাছাইয়ের পর দেশে ফিরতে পারবেন। তবে প্রায় এক হাজার শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের নেতাকে তৃতীয় দেশে, পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে।
তৃতীয় দেশে পাঠানো নিয়ে বিতর্ক
এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে, কারণ অনেকে আশঙ্কা করছেন—শীর্ষ নেতাদের ফিরিয়ে না নিলে ভবিষ্যতে আবার নতুন বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। তবে তুরস্কের অবস্থান স্পষ্ট—এই ব্যক্তিরা ইউরোপের কোনো দেশে স্থানান্তরিত হোক।
ডিইএম পার্টির ভূমিকা ও ওজালানের প্রস্তাব
প্রো-কুর্দি ডিইএম পার্টির সহ-সভাপতি তাইয়েপ তেমেল জানিয়েছেন, আলোচনার মূল কাঠামোটি ওজালানের প্রস্তাব অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, “পিকেকের সদস্যদের সমাজে ও রাজনীতিতে পুনঃএকীভূত করার জন্য একটি বিশেষ আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। এই আইনটি বেসামরিক ও যোদ্ধা, সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করবে। কোনো ধাপে ধাপে ফেরত নয়; বরং একটি সার্বিক কাঠামোই প্রণয়ন করা হচ্ছে।”

তেমেল আরও জানান, কিছু নেতাকে তৃতীয় দেশে পাঠানোর বিষয়টি তুরস্ক তুলেছে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সম্ভাব্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন পড়বে।
ভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য ভিন্ন প্রক্রিয়া
ডিইএম পার্টির আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবিত আইনটি সাধারণ ক্ষমার ভাষা এড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণির ফেরত আসা সদস্যদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইনি প্রক্রিয়া প্রযোজ্য হবে—কারও বিরুদ্ধে তদন্ত বা বিচার হতে পারে।
সূত্রটি যোগ করেছে, “কমিশনের মধ্যে ঐকমত্য আনতে গেলে সবার জন্য একই নিয়ম কার্যকর করা সম্ভব নয়।”
কমিশনের কাজ শেষ হলে এটি পার্লামেন্টে সুপারিশ আকারে জমা দেওয়া হবে, যা পরবর্তীতে বিশেষ পিকেকে আইন হিসেবে গৃহীত হতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠনের আহ্বান
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তুরস্কের আইনপ্রণেতাদের আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা এই শান্তি প্রক্রিয়াকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে সেইসব দমনমূলক আইন বাতিল করেন, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে অহিংস কুর্দি কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সংস্থার ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া পরিচালক হিউ উইলিয়ামসন বলেছেন, “এই কমিশনের সামনে এক অনন্য সুযোগ এসেছে যুদ্ধ-পরবর্তী সমাজ গঠনের জন্য। সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে এমন আইন বাতিল করা উচিত যা বছরের পর বছর মানুষকে নীরব ও প্রান্তিক করে রেখেছে।”
#তুরস্ক #পিকেকে #শান্তি_প্রক্রিয়া #কুর্দি_সংঘাত #আন্তর্জাতিক_রাজনীতি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















