নতুন নীতির সূচনা
কর্ণাটক ভারতের প্রথম রাজ্য হিসেবে প্রতি মাসে একদিন করে বেতনসহ ‘মেনস্ট্রুয়াল লিভ’ বা পিরিয়ড ছুটির অনুমোদন দিয়েছে, যা সরকারি ও বেসরকারি উভয় কর্মক্ষেত্রের নারীদের জন্য প্রযোজ্য। এর ফলে বছরে মোট ১২ দিনের ছুটি পাবেন কর্মরত নারীরা। সরকারি দপ্তর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ও বেসরকারি সংস্থা–সব ক্ষেত্রেই এ নীতি কার্যকর হবে।
রাজ্য মন্ত্রিসভা সম্প্রতি এই প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়ার পর নীতিটিকে অনেকেই নারী স্বাস্থ্যের প্রতি সংবেদনশীল ও প্রগতিশীল পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন — একদিনের ছুটি কি সত্যিই যথেষ্ট? এবং এই নীতি কি বাস্তবে নারীদের কর্মক্ষেত্রে সহায়ক হবে, নাকি এটি শুধুই প্রতীকী উদ্যোগ?
কীভাবে তৈরি হলো এই নীতি
নীতিটি প্রণয়নের নেতৃত্ব দেন ড. সপনা এস., ক্রাইস্ট (ডিমড টু বি) ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহযোগী ডিন ও অধ্যাপক। তিনি ১৮ সদস্যের কমিটির প্রধান ছিলেন, যেখানে চিকিৎসক, মনোবিদ, অধ্যাপক, এনজিও প্রতিনিধি, ট্রেড ইউনিয়ন ও নিয়োগদাতারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
ড. সপনা বলেন, “আমরা ফিনল্যান্ড, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের নীতি পর্যালোচনা করেছি। কিছু প্রস্তাব ছিল অর্ধদিবস ছুটি বা নাম পরিবর্তনের, কিন্তু আমাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে সরকার ১২ দিনের পূর্ণাঙ্গ ছুটি অনুমোদন দিয়েছে।”
তিনি জানান, একটি উপকমিটি নীতির সঠিক বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করবে। তার মতে, “যে কোনো আইনেই অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু মাসিক ছুটি নারীর উৎপাদনশীলতা ও মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।”

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতামত
গাইনোকলজিস্টদের মতে, মাসিকজনিত শারীরিক অভিজ্ঞতা নারীদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন হয়, কারও ক্ষেত্রে হালকা অস্বস্তি, আবার কারও ক্ষেত্রে তীব্র ব্যথা, মাথাব্যথা, ক্লান্তি বা অতিরিক্ত রক্তপাত হতে পারে।
ড. হেমা দিবাকর, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব গাইনোকলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স (FIGO)-এর প্রতিনিধি, বলেন, “এন্ডোমেট্রিওসিস, অ্যাডেনোমাইওসিস বা হরমোনজনিত অসামঞ্জস্যতায় ভোগা নারীদের জন্য এই ছুটি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে কেবল ছুটি নেওয়ার চেয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে সমস্যার মূল কারণ নির্ণয় করা জরুরি।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “একদিনের পিরিয়ড ছুটি হয়তো বাস্তব প্রয়োজন মেটাবে না এবং এটি কখনও কখনও প্রতীকী পদক্ষেপ হয়ে থাকতে পারে। এছাড়া নিয়োগদাতাদের মধ্যে নারীদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে, যা নেতৃত্বের সুযোগে প্রভাব ফেলবে।”
প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক প্রেক্ষাপট
ড. সুহাসিনি ইনামদার, সিনিয়র গাইনোকলজিস্ট, মাদারহুড হাসপাতাল, বেঙ্গালুরু, বলেন, “প্রাচীনকালে নারীরা শারীরিক ও মানসিক বিশ্রামের জন্য কয়েকদিন গৃহকর্ম থেকে বিরতি নিতেন, যা তখন বিশ্রামের প্রতীক ছিল, অশুচিতা নয়। আজকের এই নীতি সেই ভুলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গিকেই ফিরিয়ে আনে।”
তিনি আরও বলেন, “তীব্র মাসিক ব্যথা বা ডিসমেনোরিয়া সব বয়সী নারীর মধ্যে দেখা যায়। স্ট্রেস, অনিয়মিত ঘুম, ব্যায়ামের অভাব উপসর্গ আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই দীর্ঘস্থায়ী বা অতিরিক্ত ব্যথাকে স্বাভাবিক ভেবে উপেক্ষা করা ঠিক নয়।”
তার পরামর্শ, হালকা অস্বস্তিতে গরম সেঁক, হাইড্রেশন, হালকা ব্যায়াম ও বিশ্রাম কার্যকর হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা থাকলে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা
ড. সুনীতা মহেশ, মিলান বার্থিং হাসপাতালের চিকিৎসা পরিচালক, বলেন, “এন্ডোমেট্রিওসিস, অ্যাডেনোমাইওসিস, ফাইব্রয়েড বা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে আক্রান্ত নারীদের জন্য মাসিক ছুটি বড় সহায়তা হতে পারে। এসব অবস্থায় প্রচণ্ড ব্যথা, ক্লান্তি বা অতিরিক্ত রক্তপাত হয়, যা দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত করে।”
তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এমন উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। শুধু ছুটি নয়, মূল সমস্যার সমাধান করাই দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “নীতিটি যেন নমনীয় ও কলঙ্কমুক্ত হয়। নারীদের যেন ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশে বাধ্য হতে না হয় এবং ছুটি নেওয়ায় কর্মদক্ষতা নিয়ে কোনো সন্দেহ না ওঠে।”
কর্ণাটকের এই নীতি নিঃসন্দেহে নারী স্বাস্থ্যের প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে বাস্তবায়ন ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর। সচেতনতা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সংবেদনশীল কর্মপরিবেশের মাধ্যমে এই নীতি নারীদের প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়নের পথ তৈরি করতে পারে।
#নারীস্বাস্থ্য #কর্মক্ষেত্র #পিরিয়ডলিভ #কর্ণাটক #সারাক্ষণরিপোর্ট #সমাজওনীতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















