ইসরায়েল ও রাশিয়ার দ্বৈত নাগরিক এলিজাবেথ সুরকভ প্রায় আড়াই বছর ইরাকে বন্দিদশায় কাটিয়েছেন।
ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী কাতায়েব হিজবুল্লাহ তাকে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন করেছে।
সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ মুক্তি পাওয়ার পর তিনি প্রথমবারের মতো নিজের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
অপহরণ ও প্রথম দিকের নির্যাতন
সুরকভ জানান, অপহরণের পর প্রথম কয়েক মাস তাকে সবচেয়ে বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
কীভাবে অপহরণ
২০২৩ সালের ২১ মার্চ বাগদাদের কেন্দ্রস্থলে এক নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা ছিল তার।
নারীটি গবেষণার অজুহাতে যোগাযোগ করেছিল।
দেখা করতে এলে আর কাউকে পাওয়া যায়নি।
ফেরার পথে একটি কালো এস-ইউ-ভি এসে তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়।
তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করেছিলেন, কিন্তু অপহরণকারীরা সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পিটিয়ে ও যৌন নির্যাতন করে চুপ করিয়ে দেয়।
হাত বেঁধে, চোখ ঢেকে, ফোন নিয়ে তাকে গাড়ির ট্রাঙ্কে ফেলে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বড় বাড়িতে—যেখানে পরবর্তী সাড়ে চার মাস তাকে বন্দি থাকতে হয়।

নির্যাতনের ধরন
শুরুতে অপহরণকারীরা জানত না তিনি ইসরায়েলি নাগরিক।
তখন তারা তাকে মুক্তিপণের জন্য ধরে রেখেছে বলে মনে হয়েছিল।
পরবর্তীতে তার ফোনে ইসরায়েলি পরিচয়ের প্রমাণ পেয়ে তারা তাকে “ইসরায়েলি গুপ্তচর” বলে আখ্যা দেয় এবং নির্মম নির্যাতন শুরু হয়।
তাকে হাতকড়া পরিয়ে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হতো।
তাকে অবিরাম পেটানো হতো।
তার শরীরে বিদ্যুৎ-শক দেওয়া হতো।
তাকে এমন সব শারীরিক অবস্থানে থাকতে বাধ্য করা হতো যা তার পিঠ ও কাঁধে গুরুতর ক্ষতি করত।
তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে আবার নির্যাতন শুরু করা হতো।
তার ভাষায়—“তারা আমাকে যেন জীবন্ত পাঞ্চিং ব্যাগের মতো ব্যবহার করত।”
মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হওয়া
টানা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি নিজের সুরক্ষার জন্য বানানো কিছু ‘স্বীকারোক্তি’ দিতে শুরু করেন।
লক্ষ্য ছিল—কোনো নির্দোষ ইরাকি নাগরিক যেন তাদের সন্দেহের তালিকায় না পড়ে।

প্রথমে তিনি ফরাসি এক সাংবাদিকের সঙ্গে নাকি আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন—এমন মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলেন।
এতে নির্যাতন কিছুটা থেমে যায়।
কিন্তু জুলাই ২০২৩-এ সামরিক সেবার ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠে।
শুরুতে তিনি হাসপাতালে কাজ করেছিলেন বলে মিথ্যা বলেন, পরে নির্যাতনের তীব্রতায় সত্য বলতে বাধ্য হন।
সেই নির্যাতনে তার একটি দাঁত পর্যন্ত ভেঙে যায়।
একাকী বন্দিদশা: “আমি কখনও সূর্য দেখিনি”
ইসরায়েল সরকার জুলাই ২০২৩-এ প্রকাশ্যে তার অপহরণের কথা জানায়।
এরপর হঠাৎ এক সময়ে তাকে স্থানান্তর করা হয়।
নতুন স্থানে—সম্ভবত ইরাক–ইরান সীমান্তের কাছে কাতায়েব হিজবুল্লাহর ঘাঁটিতে—তাকে আর নির্যাতন করা হয়নি।
একজন পুরুষ নার্স তার যত্ন নিত, তাকে বই, নোটবই, টেলিভিশন ও অভিধান এনে দেওয়া হয়।
খাবারও আগের তুলনায় ভালো ছিল।
এমনকি ২০২৪ সালের জুনে তার থাকার জায়গা কিছুটা সংস্কার করা হয়।

তবুও তিনি সম্পূর্ণ একা, জানালাবিহীন একটি কক্ষে বন্দি ছিলেন দুটি পূর্ণ বছর।
তিনি বলেন, “আমি কখনও সূর্য দেখিনি।”
এই সময় ইরানের ওপর ইসরায়েলের বিমান হামলার ঢেউ তার অবস্থানকৃত ভবনকে কাঁপিয়ে দিত।
নিজেকে বাঁচাতে গোপন সংকেত
নভেম্বর ২০২৩-এ ইরাকি টিভিতে প্রচারিত এক ভিডিওতে তাকে “স্বীকারোক্তি” দিতে বলা হয়।
তিনি হিব্রু ভাষায় বলেছিলেন যে তিনি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ও সিআইএ-র হয়ে কাজ করতেন।
কিন্তু সেই বক্তব্যে গোপনে তিনি নির্যাতনের সংকেত গেঁথে দিয়েছিলেন—
‘তড়িৎ-শক’ বোঝাতে তিনি “গান-হাশমাল” নামে একটি জায়গায় থাকার ভুয়া দাবি করেন।
বিভিন্ন গোয়েন্দা কর্মকর্তার জন্য এমন সব নাম বানান যা বিভিন্ন ভাষায় “নির্যাতন” শব্দের ওপর শব্দখেলা।
মুক্তি
২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর—৯০৩ দিন বন্দিদশায় থাকার পর—একদিন হঠাৎ তাকে চোখ বেঁধে নতুন জায়গায় নেওয়া হয়।
পরদিন বাগদাদের একটি গ্যারেজে তাকে একজন ইরাকি কর্মকর্তার গাড়িতে হস্তান্তর করা হয়।

সেখান থেকে তাকে একটি অভিজাত গেস্টহাউসে নেওয়া হয়, যেখানে ইরাকি মহিলা চিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা করেন—অপহরণের পর প্রথমবার কোনো নারীর সঙ্গে তার যোগাযোগ।
সেখানে এসে মার্ক সাভায়া নামের এক ব্যক্তি—ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু—নিজেকে তার সহায়তাকারী হিসেবে পরিচয় দেন।
তিনি ইরাকি প্রধানমন্ত্রীকে চাপ দিয়ে তার মুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে জানা যায়।
পরবর্তীতে মার্কিন দূতাবাসে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ভিডিও কলে তিনি তার বোনদের সঙ্গে কথা বলেন।
ইসরায়েলে পৌঁছে তাকে চিকিৎসার জন্য সরাসরি গার্নিতে করে নিতে চাইলেও চিকিৎসকরা তাকে হেঁটে ঢোকার অনুরোধ করেন—যাতে তিনি নিজেকে ভাঙা নয় বরং দৃঢ় অবস্থানে ফিরে আসার অনুভূতি পান।
মুক্তির পর প্রতিক্রিয়া
মুক্তির কিছুদিন পর কাতায়েব হিজবুল্লাহর নামে পরিচালিত একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে তার “স্বীকারোক্তি” নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়।
সেখানে তারা তার বানানো কোডনেম “ইথান নুইমা”-কে বাস্তব গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে—যা সুরকভের কাছে প্রমাণ হিসেবে মনে হয়েছে যে সত্যিই তারাই তাকে বন্দি রেখেছিল।
এলিজাবেথ সুরকভ এখন দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক পুনর্বাসন ও মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তার গল্প ইরাকের ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অবাধ ক্ষমতা এবং অপহৃত ব্যক্তিদের অমানবিক বাস্তবতার এক নির্মম চিত্র তুলে ধরে।
#ইসরায়েল #ইরাক #সুরকভ #অপহরণ #নির্যাতন #কাতায়েব_হিজবুল্লাহ #মুক্তি #গোয়েন্দা #মধ্যপ্রাচ্য #সারাক্ষণরিপোর্ট #FeatureStory
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















