যুক্তরাজ্যের কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা ছিল “খুব কম এবং খুব দেরিতে”—সরকারি তদন্ত কমিটির দ্বিতীয় খণ্ডের বিশদ প্রতিবেদনে এমন কঠোর ভাষায় মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র এক সপ্তাহ আগেও যদি লকডাউন ঘোষণা করা হত, তাহলে ২০ হাজারের বেশি মানুষের জীবন রক্ষা করা যেত।
ডাউনিং স্ট্রিটে ‘বিষাক্ত ও বিশৃঙ্খল’ পরিবেশ
প্রতিবেদনটি ডাউনিং স্ট্রিটের ভেতরের পরিবেশকে “বিষাক্ত ও বিশৃঙ্খল” বলে আখ্যা দিয়েছে, যা সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নিজেই প্রশ্রয় দিতেন। সেখানে সবচেয়ে উচ্চস্বরে কথা বলা ব্যক্তিরাই সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখতেন, আর নারীরা নিয়মিতভাবে উপেক্ষিত হতেন। কঠোর মন্তব্যে আরও বলা হয়েছে, লকডাউন সম্পূর্ণভাবে না দিলে যুক্তরাজ্যে মৃত্যু “অচিন্তনীয় ও অগ্রহণযোগ্য” মাত্রায় পৌঁছাত।
৭৫০ পৃষ্ঠার বিশদ তদন্ত: বিলম্ব আর ভুল সিদ্ধান্তের দীর্ঘ তালিকা
দুই খণ্ডে ৭৫০ পৃষ্ঠার বেশি জুড়ে থাকা এই প্রতিবেদনে সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়েছে—অকারণ বিলম্ব, সিদ্ধান্তহীনতা এবং আগের ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়ার ধারাবাহিকতার কথা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসকে প্রতিবেদনে “একটি হারানো মাস” বলা হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে কেন বরিস জনসন ফেব্রুয়ারিতে কোবরা জরুরি কমিটির একটিও বৈঠকে সভাপতিত্ব করেননি। অর্ধ-বার্ষিক ছুটির সপ্তাহে তো কোভিড প্রতিক্রিয়াই কার্যত থেমে গিয়েছিল।
এক সপ্তাহের লকডাউন দেরিতে ২৩ হাজার মৃত্যু
তদন্তকারীদের মতে, ১৬ মার্চ লকডাউন দিলে প্রথম ঢেউয়ে ইংল্যান্ডে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নামত। মডেলিং হিসাব অনুযায়ী প্রায় ২৩ হাজার মানুষের জীবন বাঁচানো যেত।
শোকাহত পরিবারের ক্ষোভ
Covid-19 Bereaved Families for Justice গ্রুপ বলেছে, প্রতিবেদন প্রমাণ করেছে যে বরিস জনসন পরামর্শ উপেক্ষা করেছেন, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছেন এবং রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকে জননিরাপত্তার ওপরে রেখেছেন। গ্রুপটি বলেছে, “এই বিপর্যয়কর ব্যর্থতার দায় কালো-সাদা অক্ষরে জনসনের ওপর চাপানো হলেও, যে মানুষগুলোকে বাঁচানো যেত—সেটা ভাবলেই হৃদয় ভেঙে যায়।”
বরিস জনসন ও ডমিনিক কামিংস: ভয় ও বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দু
সবচেয়ে তীক্ষ্ণ সমালোচনা বরিস জনসন ও তাঁর প্রধান উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংসকে ঘিরে। কামিংসকে “ভয়ের সংস্কৃতি” প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রে বলা হয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের তিনটি স্বায়ত্তশাসিত সরকারের নেতৃত্ব এবং বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টারাও সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: “চারটি সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল বারবার একই ভুল—‘খুব কম, খুব দেরি’। হুমকির গুরুত্ব বা জরুরিতা উপলব্ধি না করায় বাধ্যতামূলক লকডাউন বিবেচনায় আনতেই দেরি হয়ে যায়।”
অতিরিক্ত দেরি, ভুল পুনরাবৃত্তি
২০২০ সালের মাঝামাঝি বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর নতুন সংক্রমণ যখন বাড়তে থাকে, তখন আবারও দেরিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যা প্রতিবেদনের ভাষায় “ক্ষমার অযোগ্য।”

প্রতিবেদনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন শীর্ষ আমলা ক্রিস ওয়ার্মোল্ডের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। তিনি মন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও তা তদন্ত করেননি।
লকডাউন প্রয়োজনীয় ছিল, তবে তা সমাজে “স্থায়ী দাগ” রেখে গেছে, বিশেষ করে শিশুদের জীবনে।• দ্রুত অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে পূর্ণাঙ্গ লকডাউন হয়তো এড়ানো সম্ভব হতো বা অন্তত সংক্ষিপ্ত করা যেত।
চার জাতির মধ্যে সমন্বয় ছিল দুর্বল, এবং প্রত্যেকেই কিছু না কিছু গুরুতর ভুল করেছে।
মহামারির সূচনায় প্রস্তুতির অভাব
প্রতিবেদনের প্রথম খণ্ডে জানুয়ারি ২০২০ থেকে শেষ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার পর্যন্ত সময়রেখা তুলে ধরে বলা হয়েছে—ইতালিতে ভয়াবহ সংকট দেখা দেওয়ার পরও যুক্তরাজ্য জরুরি প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা বোঝেনি। ফেব্রুয়ারিকে তাই “হারানো মাস” বলা হয়েছে।
বরিস জনসনের নেতৃত্বের অভাব
আইনপ্রণেতা হিদার হলেটের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি লিখেছে, “বরিস জনসনের আরও আগে বুঝতে উচিত ছিল এটি একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নেতৃত্ব জরুরি ছিল।”
ফেব্রুয়ারির অর্ধ-বার্ষিক ছুটির সপ্তাহে জনসন চেভনিং-এ কাটালেও কোভিড নিয়ে তাঁকে কোনো নিয়মিত ব্রিফিং দেওয়া হয়নি।
মার্চে পরিস্থিতি ছিল “প্রায় বিপর্যস্ত”
দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে ওঠে যে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না, পরীক্ষা ছিল না—ফলে সংক্রমণের প্রকৃত বিস্তার নিয়েই কোনো ধারণা ছিল না।
তারপরও লকডাউন ঘোষণা করতে দেরি হয়, আংশিকভাবে প্রধান চিকিৎসা ও বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টাদের “বিহেভিয়ারাল ফ্যাটিগ” তত্ত্বের কারণে—যা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়।
উঠানামার ভুল—ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রীষ্মে অসাবধানীভাবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া ছিল “অবিবেচক”—এতে রিশি সুনাকেরও ভূমিকা ছিল।
দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে আবারও একই ভুল হয়—চারটি সরকারই বড়দিনে বিধিনিষেধ শিথিলতার ভুল বার্তা দেয়, যা জনগণকে “মিথ্যা আশা” দেয়।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের নেতা এড ডেভি বলেন, “কনজারভেটিভদের এই ভয়াবহ ব্যর্থতা ব্রিটিশ জনগণ কখনও ক্ষমা করবে না।”
প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সংসদে লিখিত বিবৃতিতে সরকারের ব্যর্থতা স্বীকার করে বলেন, “এরপর থেকে সংকট মোকাবিলার পদ্ধতিতে উন্নতি আনা হয়েছে।”
#কোভিড #যুক্তরাজ্য #টোরি #বরিসজনসন #লকডাউন #তদন্তপ্রতিবেদন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















