টেরোরিজম যে একটি বিশাল আকারের বানিজ্য এ নিয়ে এ মুহূর্তের পৃথিবীতে কোন সন্দেহ থাকার কারণ নেই। কারণ এর নেতৃত্বে এখন আর শুধুমাত্র ধর্মান্ধ অশিক্ষিত গোষ্টি জড়িত নয়।
বরং শিল্প-ব্যবসা পরিমন্ডলে বর্তমান যেমন সব থেকে দক্ষ ও শিক্ষিত মানুষরা। এমনকি এ বড় বড় রাষ্ট্রের সরকার প্রধানরা এখন নিরাপত্তার পাশাপাশি আরো বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন শিল্প বানিজ্যে। ঠিক তেমনি টেরোরিজমে একটা পরিবর্তন ধীরে ধীরে গত দুই দশক ধরে হচ্ছে। শিল্প ও বানিজ্য’র মালিকরা যেমন অশিক্ষিত, শিক্ষিত, দরিদ্র, ও দরিদ্র নয় এমন শ্রমিক বা মানুষকে উৎপাদন থেকে এক্সপোর্ট পর্যন্ত ব্যবহার করে—টেরোরিজমও ঠিক একই পথ নিয়েছে।
আবার শিল্পপতি বা বানিজ্য অধিকারীরা যেমন বড় বড় রাষ্ট্রগুলো বা স্থিতিশীল রাষ্ট্রগুলোকেই বেছে নেয়—তাদের শিল্প বানিজ্য’র প্রসার ঘটাতে।
টেরোরিজম সেক্ষেত্রে বেছে নেয় ধর্মান্ধ, দরিদ্র জনগোষ্টি বহুল ও দুর্বল কাঠামোর রাষ্ট্রগুলোকে।
এই টেরোরিজম বানিজ্যে শুধু একটাই পার্থক্য থাকে, প্রকৃত বানিজ্যের সব কিছু থাকে স্বচ্ছ, মালিকানা থেকে রাষ্ট্রীয় সহায়তা সবই। বিপরীতে টেরোরিজমে সব কিছুই অস্বচ্ছ। এমনকি বড় জঙ্গী সংগঠন বা কোন মৌলবাদী সংগঠনের দৃশ্যত যাকে প্রধান হিসেবে দেখা যায়, সে ব্যক্তিই যে মূলত ওই জঙ্গী সংগঠনের মূল ব্যক্তি তা নিয়ে এখন যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। গত কয়েক দশকের একের পর এক ঘটনা—আমেরিকার ৯/১১, ভারতের মুম্বাই হামলা, সুইডেন ও ফ্রান্সের হামলা, বাংলাদেশের হোলি আর্টিজান হামলা, ভারতের পহেলগাম, রেড ফোর্ট হামলার চরিত্রগুলো ভিন্ন দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য করে। এবং ওই হামলাগুলোকে কেন্দ্র করে পরবর্তী ঘটনা পর্যালোচনা করলে এই টেরোরিজম ঘিরে একটি প্রশ্ন আরো বড় হয়ে সামনে আসে—আসলে এই জঙ্গী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রিয় চরিত্র কারা?
.jpeg.webp)
জঙ্গী কোন কোন রাষ্ট্রে তৈরি হচ্ছে তা ইতোমধ্যে পৃথিবীতে স্পষ্ট হয়ে আসছে। এগুলো হয় রোগ স্টেটে, না হয় কোন শক্তি এই রাষ্ট্রগুলোকে রোগ স্টেটে পরিণত করতে সহায়তা করছে। ভেঙে ফেলা হচ্ছে অনেক স্থিতিশীল রাষ্ট্রের কাঠামো।
রাষ্ট্রগুলোকে এভাবে ভেঙে ফেলা বা ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাবার, এমনকি ওই রাষ্ট্রের শক্তিশালী নেতৃত্বকে হত্যা বা উৎখাত করার পেছনে থাকে মূলত সেখানে জঙ্গী ব্রিডিং গ্রাউন্ড তৈরি করা।
কোন রাষ্ট্রে সহজে এই জঙ্গী তৈরি হচ্ছে। আবার অন্য যে সকল স্থিতিশীল রাষ্ট্র বা কোন রাষ্ট্র যখন শক্তিশালী নেতা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে—তখনও সেখানে যে জঙ্গী তৈরি হচ্ছে—এদের পেছনে একটি বর্হিচক্রকে কাজ করতে দেখা যায়।
অন্তত গত দুই দশকের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সব জঙ্গী চক্র’র সঙ্গে আন্তর্জাতিক আর্মস এবং ড্রাগ স্মাগলার, হিউম্যান ট্রাফিকার থেকে শুরু করে অনেক ধরনের চক্র জড়িত।

আর এদেরকেও সহায়তা করার জন্যে অনেক রাষ্ট্রের শক্তিশালী সরকার পরিবর্তন করে দুর্বল সরকার বসানো হয়। ওই সব দুর্বল সরকার ও তার সদস্যরা মূলত এদের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের ননগর্ভমেন্ট অর্গানাইজেশন(NGO) প্রধান, বিশেষ টাইপের ইউনিভার্সিটি, এমনকি বিভিন্ন দেশের সরকারে থাকা ব্যক্তি ও সেনাবাহিনীতে থাকা, কূটনীতির ক্ষেত্রে থাকা ব্যক্তিরাও এখন এদের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
তাই আন্তর্জাতিক টেরোরিজম এখন আর শুধুমাত্র ধর্মীয় বা কোন গোষ্টির মতাদর্শ ভিত্তিক বিষয় নয়। এটা বিপুল অর্থে উপার্জনসহ নানান শক্তিকে সহায়তা করার একটি বড় অস্ত্র হিসেবে আবিভূত হয়েছে।
টেরোরিজমের এই কেন্দ্রিয় চরিত্র পরিবর্তন ও তার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির পরিবর্তনের ফলে টেরোরিজমও এখন হোয়াইট কলারদের হাতেও চলে গেছে। এখন ওই অশিক্ষিত ধর্মান্ধরাও যেমন টেরোরিজমের ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবহার হচ্ছে ঠিকই—তবে তার থেকে বেশি ভয়াবহ হচ্ছে হোয়াইট কলার জঙ্গীরা। যেমন বাংলাদেশে এ যাবত্কালে যত জঙ্গী হামলা হয়েছে তার ভেতর সব থেকে বড় হামলা ছিল ঢাকার “হোলি আর্টিজান” হামলা। ওটা ছিল সম্পূর্ণ হোয়াইট কলার জঙ্গীদের কাজ। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে বড় শিল্পপতিদের পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানদেরও দেখা যায়।

৯/১১ থেকে ভারতের সর্বশেষ রেড ফোর্ট হামলা সবই এই হোয়াইট কলার জঙ্গীদের কাজ। এবং এই জঙ্গীদের শিশুবেলা থেকে ভিডিও গেমের মাধ্যমে, পরবর্তীতে বিশেষ ধরনের নন গর্ভমেন্ট অর্গানাইজেশনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে ও সর্বোপরি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে এ কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হচ্ছে।
এমনকি উদারতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির নামেও এই জঙ্গী যেমন তৈরি হচ্ছে তেমনি প্রশ্রয় পাচ্ছে। আবার পশ্চিমা অনেক রাষ্ট্র তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে, বিশেষ করে একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে সেটাকে পুনর্গঠনের নামে তাদের এক্সপার্ট নিয়োগ ও বিভিন্ন ফান্ড আনার ভেতর দিয়ে বড় ধরনের বানিজ্য করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
তাদের এই কাজের গিনিপিগ মিডল ইস্ট থেকে শুরু করে আফ্রিকার অনেক দেশ আর দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ। এসব ক্ষেত্রে তারা টেরোরিজমকে কভারেজ দিয়েছে সব সময় উদার গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সম্প্রদায়ের অধিকারের নামে।
অন্যদিকে উল্লিখিত হাতিয়ারগুলোকে ব্যবহার করে যখনই হোয়াইট কলার টেরোরিস্টের জন্ম হয়ে গেছে, তখনই শুধু ৯/১১, লন্ডনে ট্রেন হামলা, সুইডেন বা ফ্রান্সে ও বাংলাদেশে হোলি আর্টিজান হামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। এবার প্রবল প্রতিরোধ করেও নিউইয়র্কে ট্রাম্প কিন্তু একটি বীজ বপনকে ঠেকাতে পারলেন না।

নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আমেরিকাতে হোয়াইট কলার টেরোরিজম না হোক, যে বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পশ্চিমারা মিডল ইস্ট থেকে সাউথ এশিয়া অবধি টেরোরিজমকে সহায়তা করে—ওই বিশৃঙ্খলার বীজ সেখানে রোপন হয়ে গেছে।
তাই স্বাভাবিকই এখন আর এই হোয়াইট কলার টেরোরিজম শুধু ভারতের সমস্যা নয়, ইন্দোনেশিয়ার সন্তানদের আইএস বানানোর জন্য ভিডিও গেম চালু করার সমস্যা নয়—এমনকি নাইজেরিয়ায় আইএস এর হাতে জেনারেলদের প্রতি নিয়ত নিহত হবার সমস্যা নয়। এটা খুব শীঘ্রই আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার মূল কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
আর এই হোয়াইট কলার টেরোরিজমই মূলত এগিয়ে চলেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কয়েকটি প্রজন্ম নিজেদেরকে নিঃশেষিত করে যে অর্থনীতি ও স্থিতিশীল অনেকগুলো রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলেছে—তাদের ধ্বংসের মূল কারণ হিসেবে।
তাই পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা নীতিতে যতই মতভেদ থাকুক না কেন, আগামী পৃথিবীর স্বার্থে, আগামী প্রজন্মের স্বার্থে বিশ্বের স্থিতিশীল বড় রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলোকে এক হতে হবে—হোয়াইট কলার জঙ্গী নির্মূলে। এর জন্যে এখন যত কঠোরতার দরকার হোক কেন, যে ধরনের অপারেশনের দরকার হোক না কেন—এ রাষ্ট্রগুলোকে মিলিতভাবে তা করতে হবে।
কারণ, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে আমেরিকা থেকে শুরু করে সবগুলো স্থিতিশীল অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের অর্থনীতি ধ্বংস ও রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ হবে এই হোয়াইট কলার জঙ্গী।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

স্বদেশ রায় 


















