০৯:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫
দিল্লি বিস্ফোরণ: আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেটওয়ার্কে পাকিস্তান-যোগ ও ২৬ লাখ টাকার তহবিল ঢাকায় কমনওয়েলথ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টির বৈঠক স্যানিটেশন ব্যবস্থার সুফল উন্মোচন: স্বাস্থ্য, মর্যাদা ও সমৃদ্ধি পাকিস্তানে নতুন ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট নিয়ে তীব্র বিতর্ক: পাঁচ বিচারকের দাবি—শুনানি সুপ্রিম কোর্টেই হোক জি–২০ সম্মেলনে মোদির ছয় দফা এজেন্ডা, জলবায়ু চুক্তি ও যুক্তরাষ্ট্রের বয়কট: দক্ষিণ আফ্রিকা বৈঠকের পাঁচ প্রধান বিষয় বেলেঁমের কোপ৩০ সমঝোতা: অর্থ প্রতিশ্রুতি বাড়ল, কিন্তু জ্বালানি কাটছাঁট নেই বাংলাদেশে ভূমিকম্পে সতর্কতা: ফায়ার সার্ভিসের ৮টি নিরাপত্তা নির্দেশনা শাহরিয়ার কবিরের আটক ‘অবৈধ ও ইচ্ছামূলক’: অবিলম্বে মুক্তির আহ্বান জাতিসংঘের খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্যে আজ হাসপাতালে ভারত–কানাডা–অস্ট্রেলিয়ার নতুন প্রযুক্তি জোট ঘোষণা

বাংলাদেশে স্থিতিশীল সরকার ছাড়া মানুষের জীবনের ও অর্থনীতির নিরাপত্তা সম্ভব নয়

বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূস পরিচালিত ইন্টারিম ব্যবস্থার সরকারের প্রায় ১৪ মাস পার হতে চলেছে। ১৪ মাস কোনো সরকারের জন্য কম সময় নয়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় যে দুটি বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে তাহলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তৈরি করতে না পারা ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া।
মুহাম্মদ ইউনূস যে সময়ে বাংলাদেশের ইন্টারিম ব্যবস্থার দায়িত্ব নেন তখন বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৬.৫, কোনো কোনো সংস্থার মতে ৬.৭। বর্তমানে আইএমএফ-এর মতে এটা ৩.৩ যা বাস্তবে আরও নেমে আসতে পারে বছর শেষে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মুডি বাংলাদেশকে নেগেটিভ মার্ক বি-২ এ নামিয়ে দিয়েছে। যা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মতে, দেশের অর্থনীতিকে টেনে তোলার কফিনে পেরেক মেরে দেওয়ার মতো।
বাংলাদেশের জিডিপি, আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থায় তার অবস্থান এমনকি গভর্নরের অবস্থান “সি” তে নামিয়ে দেওয়া সব মিলে এটা স্পষ্ট যে, এই ইন্টারিম ব্যবস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে সমর্থ নয়।
তাছাড়া গত ১৪ মাসে এই ইন্টারিম ব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে যে রাজনৈতিক দলের সরকারকে হটিয়ে তারা ক্ষমতা দখল করেছে সেই আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার কাজে যত বেশি ব্যস্ত, তার শতভাগের একভাগও তারা দেশের অর্থনীতির দিকে মনোযোগী হতে পারেনি।
তাদের এ ব্যর্থতার বা ভুল পথে হাঁটার মূল কারণ এই সরকারে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই। সকলেই অরাজনৈতিক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন নন-গর্ভমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান ছিলেন, যারা স্বভাবতই রাজনীতিকে ভুল বা বাঁকা চোখে দেখেন। তাছাড়া পূর্ববর্তী সরকার প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল। যেহেতু শেখ হাসিনা তাকে অনেকগুলো মামলায় জড়িত করেছিলেন এবং সাজাও দিয়েছিলেন।
যার ফলে গত চৌদ্দ মাসের তাদের কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তারা বেশি সময় ব্যয় করেছে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার কাজে।

মব জাস্টিস কী? এর কারণ ও পরিণতি
তারা একবারও চিন্তা করেনি, সবচেয়ে অজনপ্রিয় ও কম জনভিত্তির রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাকে দুর্বল করতে হলে তা রাজনৈতিকভাবে করতে হয়, প্রশাসনিকভাবে নয়। এমনকি তারা শেখ হাসিনার ভুল থেকেও শিক্ষা নেয়নি, শেখ হাসিনা রাজনৈতিক পথে রাজনীতিকে মোকাবিলার পথ বাদ দিয়ে যখনই প্রশাসনিক পথে মোকাবিলার পথ ধরেছিলেন তখন থেকেই দুর্বল হতে শুরু করেন।
অন্যদিকে যে আন্দোলনের মাধ্যমে এই ইন্টারিম ব্যবস্থা ক্ষমতা দখল করে ওই আন্দোলনের সময় ও আন্দোলন-উত্তরকালে আন্দোলনকারীদের হাতে অনেক পুলিশ ও সরকারের এলিট পুলিশ “র‍্যাব”-এর সদস্য নিহত হয়। যার মধ্যে অনেক সেনাসদস্যও ছিলেন। বিপুল সংখ্যক সরকারি স্থাপনা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়।
যে কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা যেই করুক না কেন, তাকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হয়। এবং রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী এ বিচার করতে সরকার বাধ্য।
কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের ইন্টারিম ব্যবস্থা, হত্যাকারীদের বিচার করার পরিবর্তে তাদের জন্য ইনডেমনিটি দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যাকারীদের বিচার করার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও এই বিচারের পথ বন্ধ করা বাংলাদেশের সংবিধানের আওতার বাইরে। সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
যাহোক, পুলিশ ও এলিট পুলিশ র‍্যাব সদস্যদের হত্যার বিচার বন্ধ করার ফলে সরকারকে কিছু ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে—আইনের বাইরে গিয়ে। বর্তমান সরকার যদিও পুলিশ প্রশাসনে তার প্রতি সমর্থন আছে এমন সদস্যদের উচ্চপদে বসানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ সত্য তো সকলকেই মানতে হবে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট সংখ্যক সদস্য যা সরকারি হিসেবে ৪৪ জন এবং বেসরকারি নানান সংস্থা ও রাজনৈতিক দল বলছে নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে—তারা নিহত হয়েছেন। কারণ, আন্দোলনকারীরা ৪৬০টির বেশি পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করে এবং সেগুলো পুড়িয়ে দেয়। সেখানে যথেষ্ট সংখ্যক হতাহত হয়। এ সত্য তো মানতে হবে এ ধরনের হত্যার ও পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হলে ওই বাহিনীর সদস্যদের মানসিক অবস্থা বদলে যায়।
যাহোক, কোনো বিবেচক ব্যক্তির পক্ষে পুলিশ হত্যাকারীদেরকে ইনডেমনিটি দেওয়ার পরে আর ওই পুলিশের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার চেষ্টা করার কোনো যুক্তি থাকে না। মুহাম্মদ ইউনূস যথেষ্ট বুদ্ধিমান মানুষ। তিনিও সেই ভুল পথে হাঁটেননি।

চট্টগ্রামে বিএনপি প্রার্থী গুলিবিদ্ধ, কড়া বার্তা সরকারের
বরং তিনি যে ছাত্ররা চাকরির দাবিতে আন্দোলন করেছিল—তাদের চাকরি বা পড়াশোনায় ফিরতে না দিয়ে তাদেরকে দিয়ে দ্রুত একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করানোর কাজে হাত দেন। এবং সফল হন। এ ধরনের রাজনৈতিক দল যে জনভিত্তি পায় না তা মোহাম্মদ ইউনূসের না বোঝার কোনো কথা নয়। তবে এর মধ্যে দিয়ে তার মূল উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। অর্থাৎ তিনি ছাত্রদেরকে রাজপথে একটি প্রাইভেট বাহিনী হিসেবে রাখতে পেরেছেন। তারা তাদের প্রতিপক্ষ এবং সরকারের প্রতিপক্ষকে মব সৃষ্টি করে যে কোনো সময়ে প্রতিহত করতে এগিয়ে যায়।
আইনের বাইরে কোনো কিছুকে উৎসাহ দিলে তার গতি অনেক বেশি দ্রুত হয়। কারণ, কোনো একটি গাছে ওঠার থেকে নামার গতি সব সময়ই দ্রুত হয়। তাই যে কোনো সমাজে একটি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যত কঠিন তার থেকে শৃঙ্খলা ভাঙার কাজটি অনেক সহজ। এবং এটা সংক্রামক রোগের মতো।

বাংলাদেশে তাই মব ভায়োলেন্স সংক্রামক রোগের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এখন আর এই মব ভায়োলেন্স শুধুমাত্র ওই ছাত্রদের দিয়ে তৈরি প্রাইভেট বাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সারা দেশে নানান ধরনের মার্সেনারি গ্রুপের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এটা সরবে ও নীরবে চলছে।
আর এ ধরনের একটি সমাজ যখন কোনো রাষ্ট্রে তৈরি হয় তখন প্রথমেই আক্রান্ত হয় ওই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রথমে সরাসরি আক্রান্ত হয়েছিল এখন তাদের ওপর চলছে নীরব চাঁদাবাজি। ওই প্রাইভেট বাহিনীর সদস্য ও নানান মার্সেনারি গ্রুপকে নীরবে চাঁদা দিয়ে তাদেরকে টিকতে হচ্ছে।
এ ধরনের সংক্রামক রোগ যে কোনো সমাজে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। যার ফলে এখন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া একটি অলিখিত নীরব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকার ছোট ব্যবসায়ীরা ক্রমেই ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে সংকটে পড়ছে। সেবাখাতও এই চাঁদার বাইরে নয়।
স্বাভাবিকভাবে যেখানে অর্থ সংশ্লিষ্ট স্বার্থ জড়িয়ে যায় এবং যারা অনেকটা আইনের ঊর্ধ্বে থাকে—সেখানে কখনই একটি গ্রুপ থাকে না। অনেকগুলো গ্রুপ তখন এই অবৈধ অর্থ রোজগারে নেমে যায়।

Bangabandhu's Dhanmondi 32 residence reduced to ruins
তাই দেখা যাচ্ছে গত অক্টোবর অবধি বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ১৪০ জনের বেশি স্থানীয় পর্যায়ের নেতা অজ্ঞাত হত্যাকারীর হাতে নিহত হয়েছে। নির্বাহী আদেশে বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক আদালতে যে অভিযোগ করেছে সেখানে তারা উল্লেখ করেছে, তাদের ৪ হাজারের মতো নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।
এই রাজনীতিকদের হত্যার পাশাপাশি এ মুহূর্তে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়,  নদী, খালে, হাওড়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। পত্রিকায় এসেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় একটি নদীতেই এক মাসে ৫৫টি অজ্ঞাত মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এই লেখা যেদিন লিখছি এদিনও ঢাকা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত একটি নদীতে একটি অজ্ঞাত লাশ পাওয়া গেছে। রাজধানীতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির গুলিতে নিহত হয়েছে আরও একজন বিএনপি নেতা।

তাছাড়া একটি সমাজে যখন বিচারের পাশাপাশি মব ভায়োলেন্স আরেকটি শক্তি হয়ে দাঁড়ায় তার প্রয়োগ তখন নানান ক্ষেত্রে দেখা যায়। যেমন ঢাকার অদূরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় জমি দখলকে কেন্দ্র করে দুই ব্যক্তির কোন্দলে ঘরবাড়ি পুড়েছে অনেক নিরীহ মানুষের। এ এক ভয়াবহতার ইঙ্গিত।

 

অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত পতনের ফলে এবং পুলিশকে কিছুটা কোণঠাসা করে রাখার ফলে রাজধানীও ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। একদিকে মৌলবাদীদের উত্থানের ফলে নারীরা যেমন সহজে চলাচল করতে এখন দ্বিধান্বিত। এমনকি যে ছাত্রীরা আন্দোলনে গিয়েছিল তারাও এখন বলছে, তারা আগের মতো নিঃসংকোচে চলাচল করতে পারে না। তেমনি রাজধানীর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত এলাকা এখন দিনে বা রাতে সকলেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। সেনাবাহিনী এসব এলাকা থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করছে ঠিকই তারপরেও এলাকাগুলো নিরাপদ নয়।


অর্থাৎ দিন ও রাতে নিরাপদে, নিশ্চিন্তে চলাচল করার সেই রাজধানী ঢাকার চরিত্র ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। মানুষ প্রতি নিয়ত শঙ্কিত থাকে পথে। এই শঙ্কা থেকে গত চৌদ্দ মাসে বাংলাদেশে মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। যা মিডিয়াতেও বারবার আসেছে।
এসব কারণে, গত চৌদ্দ মাসে এটা প্রমাণিত হয়েছে, একটি স্থিতিশীল শক্তিশালী ও জনসমর্থিত সরকার ছাড়া বাংলাদেশের এই অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। আর পরিস্থিতি থেকে উন্নতি ঘটানো দেশটির জন্য একান্ত জরুরি। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ যে একটি সম্ভাবনাময় দেশ তা গত কয়েক দশকে সারা বিশ্বে এমনকি পাকিস্তানেও কম আলোচিত হয়নি। সে দেশটি এ অবস্থায় চলতে পারে না।
লেখক: বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present Word.

(এই লেখাটি পাকিস্তানের The Daily News Lark  এ প্রকাশিত হয়। এটা তার বাংলা অনুবাদ। The Daily News Lark এর ই পেপার কপি লেখার ভেতরে দেয়া হলো এবং লেখার link https://www.thenewslark.com/archives/17941 )

 

জনপ্রিয় সংবাদ

দিল্লি বিস্ফোরণ: আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেটওয়ার্কে পাকিস্তান-যোগ ও ২৬ লাখ টাকার তহবিল

বাংলাদেশে স্থিতিশীল সরকার ছাড়া মানুষের জীবনের ও অর্থনীতির নিরাপত্তা সম্ভব নয়

০৭:১৬:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূস পরিচালিত ইন্টারিম ব্যবস্থার সরকারের প্রায় ১৪ মাস পার হতে চলেছে। ১৪ মাস কোনো সরকারের জন্য কম সময় নয়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় যে দুটি বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে তাহলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তৈরি করতে না পারা ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া।
মুহাম্মদ ইউনূস যে সময়ে বাংলাদেশের ইন্টারিম ব্যবস্থার দায়িত্ব নেন তখন বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৬.৫, কোনো কোনো সংস্থার মতে ৬.৭। বর্তমানে আইএমএফ-এর মতে এটা ৩.৩ যা বাস্তবে আরও নেমে আসতে পারে বছর শেষে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মুডি বাংলাদেশকে নেগেটিভ মার্ক বি-২ এ নামিয়ে দিয়েছে। যা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মতে, দেশের অর্থনীতিকে টেনে তোলার কফিনে পেরেক মেরে দেওয়ার মতো।
বাংলাদেশের জিডিপি, আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থায় তার অবস্থান এমনকি গভর্নরের অবস্থান “সি” তে নামিয়ে দেওয়া সব মিলে এটা স্পষ্ট যে, এই ইন্টারিম ব্যবস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে সমর্থ নয়।
তাছাড়া গত ১৪ মাসে এই ইন্টারিম ব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে যে রাজনৈতিক দলের সরকারকে হটিয়ে তারা ক্ষমতা দখল করেছে সেই আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার কাজে যত বেশি ব্যস্ত, তার শতভাগের একভাগও তারা দেশের অর্থনীতির দিকে মনোযোগী হতে পারেনি।
তাদের এ ব্যর্থতার বা ভুল পথে হাঁটার মূল কারণ এই সরকারে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই। সকলেই অরাজনৈতিক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন নন-গর্ভমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান ছিলেন, যারা স্বভাবতই রাজনীতিকে ভুল বা বাঁকা চোখে দেখেন। তাছাড়া পূর্ববর্তী সরকার প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল। যেহেতু শেখ হাসিনা তাকে অনেকগুলো মামলায় জড়িত করেছিলেন এবং সাজাও দিয়েছিলেন।
যার ফলে গত চৌদ্দ মাসের তাদের কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তারা বেশি সময় ব্যয় করেছে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার কাজে।

মব জাস্টিস কী? এর কারণ ও পরিণতি
তারা একবারও চিন্তা করেনি, সবচেয়ে অজনপ্রিয় ও কম জনভিত্তির রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাকে দুর্বল করতে হলে তা রাজনৈতিকভাবে করতে হয়, প্রশাসনিকভাবে নয়। এমনকি তারা শেখ হাসিনার ভুল থেকেও শিক্ষা নেয়নি, শেখ হাসিনা রাজনৈতিক পথে রাজনীতিকে মোকাবিলার পথ বাদ দিয়ে যখনই প্রশাসনিক পথে মোকাবিলার পথ ধরেছিলেন তখন থেকেই দুর্বল হতে শুরু করেন।
অন্যদিকে যে আন্দোলনের মাধ্যমে এই ইন্টারিম ব্যবস্থা ক্ষমতা দখল করে ওই আন্দোলনের সময় ও আন্দোলন-উত্তরকালে আন্দোলনকারীদের হাতে অনেক পুলিশ ও সরকারের এলিট পুলিশ “র‍্যাব”-এর সদস্য নিহত হয়। যার মধ্যে অনেক সেনাসদস্যও ছিলেন। বিপুল সংখ্যক সরকারি স্থাপনা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়।
যে কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা যেই করুক না কেন, তাকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হয়। এবং রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী এ বিচার করতে সরকার বাধ্য।
কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের ইন্টারিম ব্যবস্থা, হত্যাকারীদের বিচার করার পরিবর্তে তাদের জন্য ইনডেমনিটি দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যাকারীদের বিচার করার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও এই বিচারের পথ বন্ধ করা বাংলাদেশের সংবিধানের আওতার বাইরে। সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
যাহোক, পুলিশ ও এলিট পুলিশ র‍্যাব সদস্যদের হত্যার বিচার বন্ধ করার ফলে সরকারকে কিছু ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে—আইনের বাইরে গিয়ে। বর্তমান সরকার যদিও পুলিশ প্রশাসনে তার প্রতি সমর্থন আছে এমন সদস্যদের উচ্চপদে বসানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ সত্য তো সকলকেই মানতে হবে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট সংখ্যক সদস্য যা সরকারি হিসেবে ৪৪ জন এবং বেসরকারি নানান সংস্থা ও রাজনৈতিক দল বলছে নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে—তারা নিহত হয়েছেন। কারণ, আন্দোলনকারীরা ৪৬০টির বেশি পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করে এবং সেগুলো পুড়িয়ে দেয়। সেখানে যথেষ্ট সংখ্যক হতাহত হয়। এ সত্য তো মানতে হবে এ ধরনের হত্যার ও পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হলে ওই বাহিনীর সদস্যদের মানসিক অবস্থা বদলে যায়।
যাহোক, কোনো বিবেচক ব্যক্তির পক্ষে পুলিশ হত্যাকারীদেরকে ইনডেমনিটি দেওয়ার পরে আর ওই পুলিশের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার চেষ্টা করার কোনো যুক্তি থাকে না। মুহাম্মদ ইউনূস যথেষ্ট বুদ্ধিমান মানুষ। তিনিও সেই ভুল পথে হাঁটেননি।

চট্টগ্রামে বিএনপি প্রার্থী গুলিবিদ্ধ, কড়া বার্তা সরকারের
বরং তিনি যে ছাত্ররা চাকরির দাবিতে আন্দোলন করেছিল—তাদের চাকরি বা পড়াশোনায় ফিরতে না দিয়ে তাদেরকে দিয়ে দ্রুত একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করানোর কাজে হাত দেন। এবং সফল হন। এ ধরনের রাজনৈতিক দল যে জনভিত্তি পায় না তা মোহাম্মদ ইউনূসের না বোঝার কোনো কথা নয়। তবে এর মধ্যে দিয়ে তার মূল উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। অর্থাৎ তিনি ছাত্রদেরকে রাজপথে একটি প্রাইভেট বাহিনী হিসেবে রাখতে পেরেছেন। তারা তাদের প্রতিপক্ষ এবং সরকারের প্রতিপক্ষকে মব সৃষ্টি করে যে কোনো সময়ে প্রতিহত করতে এগিয়ে যায়।
আইনের বাইরে কোনো কিছুকে উৎসাহ দিলে তার গতি অনেক বেশি দ্রুত হয়। কারণ, কোনো একটি গাছে ওঠার থেকে নামার গতি সব সময়ই দ্রুত হয়। তাই যে কোনো সমাজে একটি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যত কঠিন তার থেকে শৃঙ্খলা ভাঙার কাজটি অনেক সহজ। এবং এটা সংক্রামক রোগের মতো।

বাংলাদেশে তাই মব ভায়োলেন্স সংক্রামক রোগের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এখন আর এই মব ভায়োলেন্স শুধুমাত্র ওই ছাত্রদের দিয়ে তৈরি প্রাইভেট বাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সারা দেশে নানান ধরনের মার্সেনারি গ্রুপের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং এটা সরবে ও নীরবে চলছে।
আর এ ধরনের একটি সমাজ যখন কোনো রাষ্ট্রে তৈরি হয় তখন প্রথমেই আক্রান্ত হয় ওই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রথমে সরাসরি আক্রান্ত হয়েছিল এখন তাদের ওপর চলছে নীরব চাঁদাবাজি। ওই প্রাইভেট বাহিনীর সদস্য ও নানান মার্সেনারি গ্রুপকে নীরবে চাঁদা দিয়ে তাদেরকে টিকতে হচ্ছে।
এ ধরনের সংক্রামক রোগ যে কোনো সমাজে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। যার ফলে এখন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া একটি অলিখিত নীরব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যন্ত এলাকার ছোট ব্যবসায়ীরা ক্রমেই ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে সংকটে পড়ছে। সেবাখাতও এই চাঁদার বাইরে নয়।
স্বাভাবিকভাবে যেখানে অর্থ সংশ্লিষ্ট স্বার্থ জড়িয়ে যায় এবং যারা অনেকটা আইনের ঊর্ধ্বে থাকে—সেখানে কখনই একটি গ্রুপ থাকে না। অনেকগুলো গ্রুপ তখন এই অবৈধ অর্থ রোজগারে নেমে যায়।

Bangabandhu's Dhanmondi 32 residence reduced to ruins
তাই দেখা যাচ্ছে গত অক্টোবর অবধি বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ১৪০ জনের বেশি স্থানীয় পর্যায়ের নেতা অজ্ঞাত হত্যাকারীর হাতে নিহত হয়েছে। নির্বাহী আদেশে বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক আদালতে যে অভিযোগ করেছে সেখানে তারা উল্লেখ করেছে, তাদের ৪ হাজারের মতো নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।
এই রাজনীতিকদের হত্যার পাশাপাশি এ মুহূর্তে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়,  নদী, খালে, হাওড়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। পত্রিকায় এসেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় একটি নদীতেই এক মাসে ৫৫টি অজ্ঞাত মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এই লেখা যেদিন লিখছি এদিনও ঢাকা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত একটি নদীতে একটি অজ্ঞাত লাশ পাওয়া গেছে। রাজধানীতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির গুলিতে নিহত হয়েছে আরও একজন বিএনপি নেতা।

তাছাড়া একটি সমাজে যখন বিচারের পাশাপাশি মব ভায়োলেন্স আরেকটি শক্তি হয়ে দাঁড়ায় তার প্রয়োগ তখন নানান ক্ষেত্রে দেখা যায়। যেমন ঢাকার অদূরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় জমি দখলকে কেন্দ্র করে দুই ব্যক্তির কোন্দলে ঘরবাড়ি পুড়েছে অনেক নিরীহ মানুষের। এ এক ভয়াবহতার ইঙ্গিত।

 

অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত পতনের ফলে এবং পুলিশকে কিছুটা কোণঠাসা করে রাখার ফলে রাজধানীও ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। একদিকে মৌলবাদীদের উত্থানের ফলে নারীরা যেমন সহজে চলাচল করতে এখন দ্বিধান্বিত। এমনকি যে ছাত্রীরা আন্দোলনে গিয়েছিল তারাও এখন বলছে, তারা আগের মতো নিঃসংকোচে চলাচল করতে পারে না। তেমনি রাজধানীর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত এলাকা এখন দিনে বা রাতে সকলেই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। সেনাবাহিনী এসব এলাকা থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করছে ঠিকই তারপরেও এলাকাগুলো নিরাপদ নয়।


অর্থাৎ দিন ও রাতে নিরাপদে, নিশ্চিন্তে চলাচল করার সেই রাজধানী ঢাকার চরিত্র ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। মানুষ প্রতি নিয়ত শঙ্কিত থাকে পথে। এই শঙ্কা থেকে গত চৌদ্দ মাসে বাংলাদেশে মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। যা মিডিয়াতেও বারবার আসেছে।
এসব কারণে, গত চৌদ্দ মাসে এটা প্রমাণিত হয়েছে, একটি স্থিতিশীল শক্তিশালী ও জনসমর্থিত সরকার ছাড়া বাংলাদেশের এই অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। আর পরিস্থিতি থেকে উন্নতি ঘটানো দেশটির জন্য একান্ত জরুরি। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ যে একটি সম্ভাবনাময় দেশ তা গত কয়েক দশকে সারা বিশ্বে এমনকি পাকিস্তানেও কম আলোচিত হয়নি। সে দেশটি এ অবস্থায় চলতে পারে না।
লেখক: বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present Word.

(এই লেখাটি পাকিস্তানের The Daily News Lark  এ প্রকাশিত হয়। এটা তার বাংলা অনুবাদ। The Daily News Lark এর ই পেপার কপি লেখার ভেতরে দেয়া হলো এবং লেখার link https://www.thenewslark.com/archives/17941 )