বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও মানবাধিকারকর্মী শাহরিয়ার কবিরের আটকে গুরুতর অনিয়ম, আইন লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আচরণের অভিযোগ তুলে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আর্বিট্রারি ডিটেনশন’। সংস্থাটি বলেছে—তার গ্রেপ্তার, প্রি-ট্রায়াল আটক, আদালত প্রক্রিয়া ও চিকিৎসা বঞ্চনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ ও মতামত
আগস্ট ২০২৫-এ অনুষ্ঠিত ১০৩তম অধিবেশনে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ জানায়, শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেপ্তার এবং প্রায় এক বছর ধরে প্রি-ট্রায়াল আটক রাখার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। ফেব্রুয়ারিতে জমা দেওয়া অভিযোগ ও মে মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দেরিতে পাঠানো প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেই এ সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তার ও অসঙ্গতি
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ মধ্যরাতে ৭৪ বছর বয়সী ও গুরুতর অসুস্থ শাহরিয়ার কবিরকে গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা গ্রেপ্তার করে। চারটি থানার পুলিশ উপস্থিত থাকলেও কেউ গ্রেপ্তারের কারণ ব্যাখ্যা করেনি। কেবল “একটি হত্যা মামলার” সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হলেও বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
পরিবারকেও জানানো হয়নি তিনি কোথায় আছেন। পরে আদালতের নথিতে জানা যায়, মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল এবং রমনা থানার একটি মামলায় আসামি দেখানো হয়।
ওয়ার্কিং গ্রুপ মন্তব্য করেছে—সরকার তার গ্রেপ্তারের পক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য বা বিশ্বাসযোগ্য কারণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আদালতে হামলা ও নিরাপত্তাহীনতা
গ্রেপ্তারের পরদিন সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে আনা হলে তার ওপর প্রকাশ্য হামলা হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, হাতকড়া পরা অবস্থায় তাকে লক্ষ্য করে বস্তু নিক্ষেপ ও গালাগাল করা হচ্ছে।
পুলিশ হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট দিলেও যথেষ্ট সুরক্ষা দেয়নি। হুইলচেয়ার বা লিফট ব্যবহারের সুযোগ না দিয়ে তাকে সিঁড়ি বেয়ে টেনে তোলা হয়—যদিও তার পায়ে ধাতব ইমপ্লান্ট রয়েছে।
ভবনের ভেতরেও হামলা হয়। আইনজীবীরা তার কাছে পৌঁছাতে পারেননি এবং আদালত তার জন্য কোনো আইনজীবী নিয়োগ করেনি। জাতিসংঘ বলছে—এটি ন্যায়বিচার পাওয়ার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন।
একাধিক মামলা ও দীর্ঘ প্রি-ট্রায়াল আটক
মোট ৯টি হত্যা-সংক্রান্ত মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই জুলাই–আগস্ট ২০২৪-এর আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে ৬টি মামলায় তিনি আগে থেকেই আটক থাকা অবস্থায় “দেখানো গ্রেপ্তার” হন—যা আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত একটি প্রক্রিয়া।
তার আইনজীবী বয়স, অসুস্থতা, প্রমাণের অভাব ও টার্গেট হওয়ার অভিযোগ তুলে একাধিকবার জামিন আবেদন করলেও সবগুলো আবেদন খারিজ করা হয়। প্রায় এক বছর পার হলেও কোনো চার্জশিট জমা হয়নি।
চিকিৎসা বঞ্চনা
হেফাজতে থাকা অবস্থায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবারের দেওয়া ওষুধ দেওয়া হয়নি।
তিনি মিনি-স্ট্রোক, কিডনিতে পাথর, বুকের সংক্রমণ এবং শীতের রাতে মেঝেতে ঘুমানোর কারণে তীব্র ব্যথায় ভুগেছেন।
কারাগারের চিকিৎসকেরা আদালতে বারবার আনা-নেওয়া বন্ধের পরামর্শ দিলেও তা মানা হয়নি। বিশেষ চিকিৎসার আবেদনও কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই খারিজ করা হয়।
জাতিসংঘ বলছে—এগুলো নেলসন ম্যান্ডেলা রুলসসহ আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আটক
ওয়ার্কিং গ্রুপের মতে, শাহরিয়ার কবিরকে মূলত তার রাজনৈতিক অবস্থান, মতপ্রকাশ এবং মানবাধিকারকর্মী হিসেবে ভূমিকার কারণে টার্গেট করা হয়েছে।
তিনি বহু বছর ধরে জঙ্গিবাদবিরোধী প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সক্রিয় ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রস্তুত করছিলেন—এমন অভিযোগও রয়েছে।
একজন সরকারি কৌঁসুলি আদালতে বলেন—একটি টকশোতে ধর্মীয় ব্যক্তির সঙ্গে বিতর্কই তার আটকের কারণ।
জাতিসংঘ বলেছে, এসব তথ্য তার রাজনৈতিক মতামত ও ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে কেন্দ্র করে চাপ প্রয়োগের ইঙ্গিত দেয়।
ন্যায়বিচারের অধিকার লঙ্ঘন
জাতিসংঘ যে বিধিগুলো লঙ্ঘিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে, সেগুলো হলো:
- নিজের পছন্দের আইনজীবী থেকে বঞ্চনা
- হামলার আশঙ্কায় নিরাপত্তাহীন পরিবেশে আদালতে আনা
- আইনজীবীদের ওপর ভয়ভীতি
- চার্জশিটে অযৌক্তিক বিলম্ব
- আত্মপক্ষ প্রস্তুতির সময় না দেওয়া
- দীর্ঘ ও অযৌক্তিক প্রি-ট্রায়াল আটক
সংস্থার মতে—এগুলো মিলিয়ে পুরো প্রক্রিয়াই “ইচ্ছামূলক আটক” হিসেবে গণ্য।
মূল পর্যবেক্ষণ
- গ্রেপ্তারের আইনি ভিত্তি নেই
- অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
- জনতার হামলা ন্যায়বিচারের পরিবেশ নষ্ট করেছে
- চিকিৎসা বঞ্চনা মানবাধিকার লঙ্ঘন
- মতপ্রকাশ ও মানবাধিকার রক্ষাকারী কর্মকাণ্ড দমন উদ্দেশ্যে আটক
জাতিসংঘের সুপারিশ
জাতিসংঘ বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছে—
- শাহরিয়ার কবিরকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে
- ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে
- গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি দিতে
- মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী আইন ও প্রথা সংস্কার করতে
সরকার পরিবর্তনের পর ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাতে তাকে আটক করা হয়। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৪ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর সভাপতি হন এবং ২০২৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন—পরে উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান হন।
১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৯২ পর্যন্ত নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া ১৯৭৬–১৯৮০ পর্যন্ত বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















