চীনের বেসরকারি মহাকাশ শিল্পে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। ডিসেম্বর দুই হাজার পঁচিশকে অনেকেই মনে করছেন এমন এক সময়, যখন হঠাৎ করেই বহু বছরের পরিবর্তন একসঙ্গে ঘটে গেল। সেই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে চীনের দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ল্যান্ডস্পেস ও স্পেস পাইওনিয়ার, যারা পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট প্রযুক্তিতে আমেরিকার দীর্ঘদিনের আধিপত্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
চীনের নতুন মুখ, নতুন স্বপ্ন
পশ্চিমা বিশ্বে ইলন মাস্ক বা জেফ বেজোসের নাম যতটা পরিচিত, ঝাং চাংউ ও কাং ইয়ংলাই ততটা নন। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে পারে। ঝাং চাংউ ল্যান্ডস্পেসের প্রধান নির্বাহী আর কাং ইয়ংলাই স্পেস পাইওনিয়ারের কর্ণধার। দু’টি প্রতিষ্ঠানই এখনো প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতায় আমেরিকার শীর্ষ কোম্পানিগুলোর অনেক পেছনে। তবু চীনের সাম্প্রতিক ইতিহাস বলে দেয়, দীর্ঘ নীরবতার পর হঠাৎ করেই নাটকীয় অগ্রগতি সম্ভব।

ড্রাগনের উড্ডয়ন ও বিস্ফোরণ
ডিসেম্বরেই ল্যান্ডস্পেস প্রথমবারের মতো একটি রকেটের প্রথম ধাপ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। এই পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয় ঝুছুয়ে থ্রি নামের রকেট। অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া ও গানসুর সীমান্তে জিউকুয়ান উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণের পর রকেটের দ্বিতীয় ধাপ কক্ষপথে পৌঁছাতে সক্ষম হলেও প্রথম ধাপ অবতরণের সময় তীব্র বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়। বাইরে থেকে দেখলে এটিকে ব্যর্থতা মনে হলেও, প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য অনুযায়ী বাস্তব উড্ডয়ন পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশল তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
রাষ্ট্রের গণ্ডি পেরিয়ে বেসরকারি দৌড়
মাত্র এগারো বছর আগে পর্যন্ত চীনে রকেট ও উপগ্রহ শিল্প ছিল পুরোপুরি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। দুই হাজার চৌদ্দ সালে বেসরকারি উদ্যোগের দরজা খোলার পর শুরু হয় এক ধরনের সৃজনশীল ভাঙাগড়া। অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, কেউ সফল হয়, কেউ ভুল পথে এগিয়ে যায়। তবু সবাই চেষ্টা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত লং মার্চ রকেটগুলোর আধিপত্যের বাইরে নিজেদের জায়গা তৈরি করতে।
ক্ষমতা ও প্রতিযোগিতার হিসাব
এখনো পর্যন্ত লং মার্চ রকেটই চীনের মহাকাশ অভিযানের মূল ভরসা। দুই হাজার চব্বিশ সালে এসব রকেট প্রায় পঞ্চাশবার উৎক্ষেপণ হয়েছে। তবে ল্যান্ডস্পেসের ঝুছুয়ে থ্রি ও স্পেস পাইওনিয়ারের তিয়ানলং থ্রি রকেট নিম্ন কক্ষপথে প্রায় একুশ থেকে বাইশ টন পর্যন্ত বহন করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ক্ষমতা আমেরিকার বহুল ব্যবহৃত পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেটের কাছাকাছি।
মিথেন জ্বালানি ও প্রযুক্তির নতুন দিক
ল্যান্ডস্পেস ইতিমধ্যেই ইতিহাস গড়েছে। দুই হাজার তেইশ সালে তাদের ঝুছুয়ে টু রকেট প্রথমবারের মতো মিথেন ও তরল অক্সিজেন জ্বালানিতে কক্ষপথে পৌঁছায়। এই জ্বালানি তুলনামূলকভাবে পরিষ্কারভাবে জ্বলে, ফলে পুনর্ব্যবহারের জন্য রকেট ধাপ দ্রুত প্রস্তুত করা যায়। আধুনিক মহাকাশ প্রতিযোগিতায় এই দিকটি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

উপগ্রহ নক্ষত্রমালার বড় বাজার
আমেরিকার সাফল্যের বড় অংশ এসেছে বিপুল সংখ্যক ইন্টারনেট উপগ্রহ উৎক্ষেপণ থেকে। চীনেও এখন একই ধরনের দুটি বিশাল প্রকল্প সামনে আসছে। একটি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে, অন্যটি সাংহাই শহরের উদ্যোগে। এই দুই নক্ষত্রমালার জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় আটাশ হাজারের বেশি উপগ্রহ। পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন কার্যত অসম্ভব। আর এই বাজারে বিদেশি কোম্পানির প্রবেশের সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
ভবিষ্যতের দিগন্ত
এই প্রকল্পগুলোতে সফলতা পেলে ল্যান্ডস্পেস ও স্পেস পাইওনিয়ার শুধু অর্থনৈতিক শক্তিই পাবে না, আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। তখন তারা আরও বড় রকেট তৈরির পথে এগোতে পারবে, যা ভবিষ্যতে সবচেয়ে ভারী বহনক্ষম রকেটের সঙ্গেও পাল্লা দিতে সক্ষম হতে পারে। আপাতত এই দৌড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাই এগিয়ে থাকলেও, চীনের নতুন এই বেসরকারি উদ্যোক্তারা যে শেষ সীমান্তে নিজেদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছেন, তা স্পষ্ট।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















