ভেনেজুয়েলার মাটির নিচে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেলের মজুত থাকলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামোগত ভাঙন ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই সম্পদকে কার্যকর উৎপাদনে রূপ দেওয়া এখনো দূরাশা। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কড়া অবস্থান পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।
মার্কিন চাপ ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা
ভেনেজুয়েলার উপকূলে নিষেধাজ্ঞাভুক্ত একটি তেলবাহী জাহাজ জব্দ করার মধ্য দিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বন্দ্ব নতুন করে সামনে এসেছে। কিন্তু এই উত্তেজনা ভেনেজুয়েলার প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ব্যারেল তেলমজুতকে বাস্তব উৎপাদনে রূপ দিতে খুব একটা সহায়ক নয়। রাজনৈতিক পরিবর্তন এলেও বিনিয়োগকারীরা বৈশ্বিক তেলের সরবরাহ ও চাহিদা নিয়ে তাদের হিসাব-নিকাশ বদলানোর মতো কারণ এখনো দেখছেন না।
সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তন ও বাজারের হিসাব
মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বাড়ায় কিছু বিশ্লেষকের ধারণা, ২০২৬ সালের প্রথম প্রান্তিকে ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এমন কিছু ঘটলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হবে দেশের তেল খাতের ভবিষ্যৎ। একসময় ভেনেজুয়েলা দিনে ৩০ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল উৎপাদন করত। বৈশ্বিক দৈনিক প্রায় ১০ কোটি ব্যারেল সরবরাহের প্রেক্ষাপটে এটি বড় প্রভাব ফেলতে পারত। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা ধারণা করছে, ২০২৬ সালে অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে তেলের দাম কমতে পারে। তবে দশকের শেষ দিকে সরবরাহ ও চাহিদা ভারসাম্য হলে ব্যারেলপ্রতি দাম ৮০ ডলারে উঠতে পারে বলে কিছু বিশ্লেষকের অনুমান।

ধসে পড়া উৎপাদন বাস্তবতা
বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। গত মাসে ভেনেজুয়েলা দিনে মাত্র ৯ লাখ ব্যারেলের মতো তেল রপ্তানি করেছে। ২০০৬ সাল থেকে দেশটির উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পিডিভিএসএর হাজার হাজার কর্মী বরখাস্ত এবং বিদেশি অংশীদারদের সম্পদ দখলের মাধ্যমে খাতটিকে দুর্বল করে দেন। এর ফলে দক্ষতা ও পুঁজি দুইই হারায় তেল শিল্প। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তোলে।
নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও বাধা রয়ে গেছে
কিছু আশাবাদী মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে দ্রুত কয়েক লাখ ব্যারেল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন কোম্পানি বিশেষ অনুমতির আওতায় সীমিত সাফল্য দেখিয়েছে। তবে বড় পরিসরের উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ ও স্থিতিশীল পরিবেশ, যা ভেনেজুয়েলায় বহুদিন ধরেই অনুপস্থিত।
বিনিয়োগের ঘাটতি ও ভারী তেলের সমস্যা
বিশ্লেষকদের মতে, ওরিনোকো বেল্ট এলাকায় উৎপাদন বাড়াতে আগামী দশ বছরে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ দরকার, তাতেও বাড়বে দিনে মাত্র পাঁচ লাখ ব্যারেল। এর বড় অংশই ভারী বা অতিভারী তেল, যা উত্তোলন ও পরিশোধনে জটিল প্রযুক্তি প্রয়োজন। দ্রুত পুনরুদ্ধারযোগ্য হালকা তেলের পরিমাণ খুবই সীমিত।
সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ও বিনিয়োগ ঝুঁকি
ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনী পিডিভিএসএর কার্যক্রমে গভীরভাবে যুক্ত। কোনো রাজনৈতিক রূপান্তর হলে বিশৃঙ্খলার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও দীর্ঘমেয়াদি সামরিক উপস্থিতিতে আগ্রহী নয়। কম দামের তেলের বাজারে বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে ভেনেজুয়েলায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আকর্ষণীয় নয়, বিশেষ করে কানাডার মতো বিকল্প উৎস সহজলভ্য থাকায়।
সব মিলিয়ে বিশ্লেষকদের ধারণা, ভেনেজুয়েলার বিপুল তেলসম্পদ আপাতত মাটির নিচেই পড়ে থাকবে। রাজনৈতিক পরিবর্তন বা নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেও বাস্তব উৎপাদনে ফেরাতে সময়, অর্থ ও স্থিতিশীলতার যে প্রয়োজন, তা এখনো অধরা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















