আমাদের গ্রহের কিছু প্রাচীন গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে এমন সব জায়গায়, যেখানে আমরা সাধারণত খুঁজতে যাই না—গাছের বার্ষিক বলয়ে, গভীর সমুদ্রের তলদেশে, কিংবা ক্রাস্টেশিয়ান প্রাণীর খোলসে।
এই সবকিছু মিলেই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর এক বিশাল ‘জলবায়ু স্মৃতিভাণ্ডার’। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের প্যালিওক্লাইমেটোলজিস্ট, ভূ-বিজ্ঞানী ও গবেষণা অধ্যাপক পল পিয়ারসনের ভাষায়, “এই তথাকথিত ‘জলবায়ু প্রক্সি’গুলো আজ অধ্যয়ন করা যায়, যার মাধ্যমে অতীতের তাপমাত্রা কিংবা বায়ুমণ্ডলের গঠন সম্পর্কে জানা সম্ভব—যে তথ্য অন্যথায় আমাদের কাছে হারিয়েই যেত।”
কিন্তু এই প্রক্সিগুলো আসলে কী রকম, আর এগুলো কাজ করে কীভাবে?
সাধারণভাবে জলবায়ু প্রক্সিগুলো তিনটি ভাগে পড়েছে—ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক।
ভৌত প্রক্সির মধ্যে রয়েছে গাছের বলয়, বরফের স্তর বা আইস কোর এবং প্রবালপ্রাচীর। এগুলো অতীতের জলবায়ুর রাসায়নিক চিহ্ন ধরে রাখে এবং গবেষকদের সাহায্য করছে লক্ষ লক্ষ বছর আগের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার সময়রেখা পুনর্গঠনে। রাসায়নিক জলবায়ু প্রক্সির মধ্যে রয়েছে খোলস ও পলিতে পাওয়া নানা যৌগ, যেগুলো একই ধরনের তথ্য দেয়। একইভাবে, হ্রদ বা সমুদ্রের পলিতে পাওয়া পরাগকণা, স্পোর বা শৈবালের চিহ্নের মতো জৈবিক প্রক্সিগুলো প্রাচীন সমুদ্রের তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও গঠনের ইঙ্গিত দেয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ গোলার্ধের গাছের বলয় বিজ্ঞানীদের জানতে সাহায্য করেছে প্রায় ১১ হাজার বছর আগের জলবায়ু পরিবর্তনের কথা। তখন এক তীব্র শৈত্যপ্রবাহের পর দীর্ঘ সময় উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া ফিরে আসে, যা শেষ বরফযুগের অবসান নির্দেশ করে।
দীর্ঘমেয়াদি আর্দ্রতার পরিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে গাছের বলয় অত্যন্ত শক্তিশালী প্রক্সি। এগুলো ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগের খরার ইতিহাসও তুলে ধরেছে এবং ব্যাখ্যা করেছে কেন আজকের কলোরাডোর মেসা ভার্দের মতো প্রাচীন পাহাড়ি বসতিগুলো পরিত্যক্ত হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে রসায়নবিদ হ্যারল্ড ইউরি—যিনি পরে অন্য এক আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পান—প্রমাণ করেন যে সমুদ্রের তাপমাত্রা ক্রাস্টেশিয়ান প্রাণীর খোলসের রাসায়নিক গঠনকে প্রভাবিত করে

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দল এই তত্ত্ব প্রয়োগ করে ক্রিটেশিয়াস যুগের স্কুইডের মতো প্রাণী বেলেমনাইটের জীবাশ্মে। এর মাধ্যমে তারা প্রায় ১০ কোটি বছর আগের তাপমাত্রার তথ্য উদ্ধার করেন। গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও ডেনমার্ক অঞ্চলে তখনকার জলবায়ু আশ্চর্যজনকভাবে স্থিতিশীল ছিল, আনুমানিক তাপমাত্রা ছিল ১৫ থেকে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, পৃথিবী তখন ভাবনার চেয়েও বেশি উষ্ণ ছিল। পরবর্তী গবেষণায় অবশ্য দেখা গেছে, ইউরির পদ্ধতিতে সমুদ্রের তাপমাত্রা কিছুটা কম ধরা হয়েছিল। বাস্তবে কিছু অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।
সমুদ্রের তলদেশের পলি বা গভীর সমুদ্র কোর প্রায় ২০ কোটি বছর আগের ধারাবাহিক তথ্য তুলে ধরছে। এসব কোরে থাকা অণুজীবের জীবাশ্ম খোলস নাটকীয় জলবায়ু পরিবর্তনের সাক্ষ্য দেয়।
সে সময় সুপারমহাদেশ প্যাঞ্জিয়ার ভাঙন ব্যাপক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটিয়েছিল। আজ এসব অণুজীবের খোলসে থাকা আইসোটোপ বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা প্রায় দানাদার স্তর পর্যন্ত তথ্য পাচ্ছেন—কীভাবে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা, সমুদ্রের তাপমাত্রা, কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ও সমুদ্রের অম্লতা দ্রুত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
পিয়ারসনের মতে, পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক যুগে ঘটে যাওয়া বড় বড় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই তথ্যগুলো আধুনিক জলবায়ু সংকট বুঝতে অমূল্য সহায়তা দেয়। “এই প্রেক্ষাপট ছাড়া আমরা সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে যেতাম,” তিনি বলেন।
গভীর, গাঢ় নীল
এই প্রেক্ষাপট আমাদের কীভাবে সাহায্য করে—শুধু এই সাধারণ যুক্তির বাইরে যে তাপমাত্রার পরিবর্তনের প্রভাব যত বেশি জানব, তত ভালোভাবে আমরা মানবযুগের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে পারব?
একটি উদাহরণই ধরা যাক।
গভীর সমুদ্র কোরের তথ্য গালফ স্ট্রিমের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক স্রোতের আচরণ সম্পর্কে নতুন ধারণা দিচ্ছে। এই স্রোত উষ্ণ পানির এক ধরনের পরিবাহক হিসেবে কাজ করে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে।
চলতি বছরের জুলাইয়ে নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৮ হাজার বছর আগে শেষ বরফযুগের অবসানের সময় হিমবাহ ও বরফচাদর গলে সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ মিঠাপানি ঢুকলে এসব স্রোত দুর্বল হয়ে পড়ে। গবেষণার তথ্য আরও দেখায়, প্রায় ৬ হাজার ৫০০ বছর আগে স্রোত আবার স্থিতিশীল হতে শুরু করে। কিন্তু আজ আর্কটিকের বরফচাদর গলে আবারও বিপুল পানি নামায় স্রোত নতুন করে দুর্বল হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া দপ্তরের জলবায়ু প্রশমন গবেষক হেমন্ত খাত্রির ভাষায়, “জলবায়ু সংকটের সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার একটি হলো—সমুদ্রের প্রাণজগৎ, বিশেষ করে যে জৈব প্রক্রিয়াগুলো সমুদ্রকে কার্বন শোষণে সাহায্য করে, সেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি কীভাবে সাড়া দেবে।” তাঁর মতে, এসব প্রক্রিয়ার সূক্ষ্ম বোঝাপড়া ছাড়া উন্নত জলবায়ু মডেল ও নির্ভরযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস সম্ভব নয়।
রিড-অনলি মেমোরি
এই স্মৃতি-ব্যবস্থাগুলো কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার ক্ষেত্রে আক্ষরিক ও রূপক—দু’ভাবেই এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, সমুদ্রের স্মৃতি ‘ভ্রমণ’ও করতে পারে।
এটা বোঝার জন্য সমুদ্রকে একটি ধীরগতির স্পঞ্জ হিসেবে কল্পনা করা যায়। এটি বায়ুমণ্ডল থেকে তাপ ও অন্যান্য উপাদান শোষণ করে। কিন্তু সমুদ্র ও বায়ুমণ্ডলের অবিরাম পারস্পরিক ক্রিয়ার কারণে সমুদ্র এই তথ্য চিরকাল ধরে রাখতে পারে না; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলে যায় বা ধীরে ধীরে মুছে যায়।
খাত্রির গবেষণার লক্ষ্য হলো এই তাপ-সংকেতের সৃষ্টি ও বিলুপ্তির মধ্যবর্তী সময় নির্ভুলভাবে হিসাব করা, যাতে সমুদ্রের স্মৃতির পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। “সমুদ্রের তাপধারণ ক্ষমতা বাতাসের তুলনায় অনেক বেশি, আর সমুদ্রস্রোত বায়ুর তুলনায় অনেক ধীরে চলে। তাই তাপ ও জলবায়ু সংকেত সমুদ্রে দীর্ঘ সময় থেকে যেতে পারে এবং বছরের পর বছর আঞ্চলিক আবহাওয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। একে আমরা সমুদ্রের ‘দীর্ঘ স্মৃতি’ বলি,” বলেন খাত্রি, যিনি ২০২৪ সালে এ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্রের সহলেখক ছিলেন।
এই দীর্ঘ স্মৃতি কীভাবে কাজ করে, তা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর মাধ্যমে জানা যায়, এক জায়গায় সমুদ্র যে সংকেত শোষণ করে, তা কীভাবে অন্য জায়গায় পৌঁছে যায়—যা আমরা বহু দশক ধরেই জানি—এবং কীভাবে তা সেখানে কয়েক বছর ধরে টিকে থাকতে পারে—যা আমরা এখন মাত্র বুঝতে শুরু করেছি।
খাত্রি ও লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রিচার্ড জি উইলিয়ামস দেখেছেন, উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের স্মৃতি প্রায় এক থেকে দুই দশক দীর্ঘ, যা আগের ধারণা অনুযায়ী আট থেকে দশ বছরের চেয়ে অনেক বেশি। খাত্রির মতে, “এর অর্থ হলো, এই সমুদ্রের বর্তমান তাপমাত্রা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার জলবায়ু ও আবহাওয়াকে এতদিন ধরে প্রভাবিত করতে পারে।”

এতেই শেষ নয়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভৌত প্রক্রিয়া সমুদ্রের স্মৃতিকে নিজেই বদলে দিতে পারে।
খাত্রি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব প্রক্রিয়া বদলে যেতে পারে, যা সমুদ্রের স্মৃতি বাড়াতেও পারে, কমাতেও পারে। স্মৃতির মাত্রায় যে কোনো পরিবর্তন জলবায়ুর অস্থিরতায় রূপান্তর ঘটাতে পারে।”
ভবিষ্যৎ বছরগুলোতে আমরা যে জলবায়ু বৈচিত্র্যের মুখোমুখি হব, তা সঠিকভাবে বুঝতে হলে এসব প্রক্রিয়া বোঝা অপরিহার্য।
শীতল সত্য
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু মডেলগুলোকেও নতুন করে আঁকতে হতে পারে।
নতুন তথ্য সামনে এলে এবং প্রভাবশালী উপাদানগুলো আরও ভালোভাবে বোঝা গেলে, মডেলের নির্ভুলতা বাড়াতে সেগুলোকে হালনাগাদ করা জরুরি হবে।
খাত্রির ভাষায়, “সমুদ্রের স্মৃতি সম্পর্কে নতুন ধারণার ফলে এখনই আমরা জলবায়ু মডেলগুলো ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি। দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রক্রিয়া আছে যেগুলো বিদ্যমান মডেলে ঠিকভাবে অনুকরণ করা হয়নি। যত বেশি বিশ্লেষণ হবে, তত নির্ভুলভাবে আমরা জলবায়ুকে প্রভাবিত করা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াগুলো তুলে ধরতে পারব এবং আমাদের পূর্বাভাস মডেল আরও শক্তিশালী হবে।”
পিয়ারসনও একমত। তাঁর মতে, পৃথিবীর জলবায়ু ইতিহাসের ইতিহাসবিদ হিসেবে আমরা এখনও কেবল উপরিভাগ ছুঁয়ে দেখছি।
“এই ক্ষেত্রটি এখন এক আবিষ্কারের যুগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি কেন প্রায় ৩৬ লাখ বছর আগে উত্তর গোলার্ধে পৃথিবী বরফাচ্ছন্ন হতে শুরু করেছিল। আবার প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ বছর আগে অ্যান্টার্কটিকার বিশাল বরফায়ন ও তার ফলে ঘটে যাওয়া ইওসিন যুগের শেষভাগের বিলুপ্তির সঠিক কারণও আমরা জানি না।”
গালফ স্ট্রিমের মতো সমুদ্রস্রোতের পরিবর্তিত প্রবাহ যে এতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রেখেছিল, এখন তা মনে করা হচ্ছে।

মূল অন্তর্দৃষ্টি
যত বেশি তথ্য সামনে আসছে, ততই ছবিটি পরিষ্কার হচ্ছে।
নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির জলবায়ু বিজ্ঞানী পিটার কালমাস বলেন, “জলবায়ু ঘটনার কারণে পৃথিবীর ভূতত্ত্ব ও জীববৈচিত্র্যে যে বড় ধরনের বিপর্যয় ও বিলুপ্তি ঘটেছে, তার তুলনায় আমরা আজ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে যা করছি, তা অন্তত দশ গুণ দ্রুত ঘটছে।”
তিনি আরও বলেন, “আর সেই অতীত পরিবর্তনগুলোর প্রভাব টিকে ছিল লক্ষ লক্ষ বছর। আজ কী ঘটছে, তা বুঝতে এই বিষয়টি মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্যের হ্রাস—যে গতিতে এসব পরিবর্তন হচ্ছে, তার প্রভাব মানুষের অস্তিত্বের সময়কালকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।”
পিয়ারসনের মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে বড় ঘটনা বিরল নয়। তবে আধুনিক জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো পূর্বতন তুলনা নেই। “মানবসভ্যতার বিকাশের মতো কিছু আগে কখনও ঘটেনি। এর প্রভাব অতীতের অধিকাংশ পরিবর্তনের চেয়ে অনেক দ্রুত ও গভীর, তাই ভবিষ্যৎ এখন আমাদের হাতেই।”
কালমাস মনে করেন, সমাধানের একটি অংশ হতে পারে বিজ্ঞানকে মূল্য দেওয়া, একই সঙ্গে বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতার এক সামষ্টিক বোধে ফিরে যাওয়া। “আমরা এক নক্ষত্রের উষ্ণতায়, এক পাথুরে গ্রহে বাস করছি, যা প্রাণে ভরপুর। বিষয়টা কতটা অবিশ্বাস্য,” তিনি বলেন। “আমাদের অবস্থাকেও এভাবেই দেখা দরকার, তবেই আমরা একে ভালোভাবে বুঝতে পারব।”
গৌরী এস 

















