মধ্যপ্রদেশের পান্না জাতীয় উদ্যানে গিপস প্রজাতির শকুন। তথ্য বলছে, ভারতে শকুনেরা তাদের ঐতিহাসিক বাসাস্থানের প্রায় ৭৫ শতাংশ থেকেই হারিয়ে গেছে, যদিও কিছু নতুন এলাকায় তাদের দেখা মিলেছে।
আইইউসিএন-এর তালিকায় গিপস শকুন এখন ‘চরম বিপন্ন’ প্রজাতি। সংখ্যার বিচারে এদের অবস্থা আজ বাঘের চেয়েও খারাপ। অথচ শকুন না থাকলে আমাদের নিজেদের পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার মানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সে উড়ে চলে, উষ্ণ ঊর্ধ্ববায়ুর স্রোতে ভর করে মেলে ধরা ডানায় ভাসতে ভাসতে সূর্যের দিকে এগোয়। ডানার প্রান্ত থেকে প্রান্ত প্রায় সাত ফুট। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে সে আরও দূরে চলে যায়, যতটা যাওয়া উচিত ছিল তার চেয়েও বেশি। খুব দেরিতে সে টের পায় ভুলটা—সূর্যের তাপে তার পালক ঝলসে যেতে থাকে।
এটি ইকারাসের সতর্কতামূলক গল্প নয়। এটি এক ভারতীয় উপাখ্যান, যার নৈতিক শিক্ষা ভিন্ন।
সম্পাতি তার ছোট ভাইকে হোঁচট খেতে দেখে চিৎকার করে বলে থামতে, ফিরে আসতে। কিন্তু ভাই শোনে না। শেষমেশ ডানার প্রবল ঝাপটায় মহান শকুনটি এগিয়ে গিয়ে ভাইকে আগলে ধরে। সূর্যের তাপে তার পালক পুড়ে যায়, সে ডানাহীন, শক্তিহীন হয়ে পৃথিবীর দিকে আছড়ে পড়ে—শুধু এই ভেবে সান্ত্বনা পায় যে সে ভাইকে বাঁচাতে পেরেছে।
সম্পাতি এক উপদেবতা—এক শকুন, যার জন্ম নাকি খুব দূরে নয়, ঠিক সেই জায়গার কাছাকাছি, যেখানে আমরা মধ্যপ্রদেশের পান্না টাইগার রিজার্ভে দাঁড়িয়ে এক বিশাল পাহাড়ি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
শকুন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উড়ন্ত পাখিদের মধ্যে অন্যতম। লম্বা মানুষের চেয়েও বড় ডানার বিস্তারে তারা দিনে প্রায় একশ কিলোমিটারের বেশি উড়তে পারে, খাবারের খোঁজে। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে এই মৃতভোজীরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটি মৃতদেহ হাড় পর্যন্ত পরিষ্কার করে দিতে পারে। ভারতের স্বচ্ছ ভারত অভিযানে তাদের অবদান প্রায় অস্বীকৃতই থেকে গেছে। আমরা কি প্রকৃতির সেবাকে সবসময়ই অবমূল্যায়ন করি না?
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, গত তিরিশ বছরে ভারতে শকুনের সংখ্যা চার কোটির কাছাকাছি থেকে নেমে এসেছে প্রায় ত্রিশ হাজারে। এক ধরনের ‘অপিওয়েড মহামারি’র ফল এটি।

ডাইক্লোফেনাক ১৯৭৩ সালে বাজারে আসে এবং অল্প সময়েই এটি বিশ্বের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত নন-স্টেরয়েডাল ব্যথানাশক ওষুধগুলোর একটি হয়ে ওঠে। ১৯৯৩ সালে এর জেনেরিক সংস্করণ বাজারে আসে, পরে ভারতে পশুচিকিৎসায় ব্যবহৃত সংস্করণও চালু হয়। কৃষকেরা বয়স্ক গবাদিপশুর ব্যথা কমাতে এই ওষুধ দিতে শুরু করেন। সেই পশুগুলো মারা গেলে ওষুধটি শরীরে থেকে যায় এবং মৃতদেহ ভক্ষণকারী শকুনের শরীরে প্রবেশ করে।
ভারতে প্রচলিত গিপস শকুনদের শরীরে ডাইক্লোফেনাক ভাঙার জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম হয় অনুপস্থিত, নয়তো খুব দুর্বল। ফলে সামান্য মাত্রাও তাদের জন্য প্রাণঘাতী। এই ওষুধ দ্রুত তাদের কিডনি নষ্ট করে দেয়। ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গিয়ে পাখির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সাদা জমাটে ঢেকে যায়। অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যু আসে।
এত নীর কিছু একটি গোটা প্রজাতিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেবে—এটা ভাবাই অদ্ভুত।
ইওহান রকস্ট্রম প্রণীত প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি কাঠামোর ‘নতুন সত্তা’ সীমা আমাদের সতর্ক করে দেয়—এমন কৃত্রিম রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও প্রকৌশলজাত উপাদান নির্বিচারে ছাড়ার বিরুদ্ধে, যেগুলো পৃথিবীর প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নিরাপদে সামলাতে পারে না। এই ক্ষেত্রে শকুন যেন সেই কয়লা খনির ক্যানারি।
বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সাবেক উপপরিচালক বিভু প্রকাশ প্রথম দিকেই লক্ষ করেন যে ভারতের শকুনরা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাচ্ছে। ১৯৮০-এর দশকে কিওলাদেও জাতীয় উদ্যানে তরুণ গবেষক হিসেবে তিনি হাজার হাজার শকুন দেখেছিলেন। ১৯৯০-এর দশকে ফিরে এসে দেখেন, তারা প্রায় নেই বললেই চলে। যারা ছিল, তারা ঝুলে পড়া ঘাড়ে বসে থাকত, কয়েক দিন পরেই মরে পড়ত।
খাবারের অভাব ছিল না। তিনি বলেন, গবাদিপশু মারা গেলে মানুষ সেগুলো কাছেই ফেলে দিত, কারণ শকুন দ্রুত পরিষ্কার করে দিত। এখন মৃতদেহ খেতে দিনের পর দিন লেগে যেত।
যেহেতু মাছ ও পাখিভোজী শিকারি পাখিরা আক্রান্ত হচ্ছিল না, তাই কীটনাশককে কারণ বলে মনে হয়নি। তাহলে কি মৃতদেহই দায়ী?
এরপর বিজ্ঞানীরা পাকিস্তানেও একইভাবে শকুন মরতে দেখেন এবং তাদের শরীরে ডাইক্লোফেনাকের উপস্থিতি পান। পরীক্ষার জন্য বন্দী শকুনদের ডাইক্লোফেনাক মেশানো মহিষের মাংস খাওয়ানো হলে তারাও মারা যায়। প্রকাশের দল সারা ভারতে মৃত শকুনের টিস্যু পরীক্ষা করে দেখে, চার ভাগের তিন ভাগ শকুনের শরীরে ভিসেরাল গাউট ছিল এবং সব নমুনাতেই ডাইক্লোফেনাক পাওয়া গেছে। ২০০৪ সালে তারা এই গবেষণা প্রকাশ করেন।
২০০৬ সালে ভারতে পশুচিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু মানুষের ব্যবহারের ওষুধ থেকে বেআইনি সরবরাহ চলতে থাকে, ফলে ২০১৫ সালে প্যাকেটের আকার সীমিত করা হয়। শকুনের জন্য সমান বিষাক্ত আরও কিছু ওষুধ ছিল, যেগুলোর কিছু ২০২২ সালের পর নিষিদ্ধ হয়েছে।
গভীর পতন কিছুটা থামানো গেলেও সংকট এখনো কাটেনি।
ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার ২০২৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে শকুনেরা তাদের ঐতিহাসিক বাসাস্থানের প্রায় ৭৫ শতাংশ থেকেই হারিয়ে গেছে, যদিও কিছু নতুন জায়গায় তারা দেখা দিয়েছে। এখন মাত্র দুইটি রাজ্য—মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান—মিলে দেশের প্রায় অর্ধেক প্রজনন জনসংখ্যা ধারণ করে। মধ্যপ্রদেশের মধ্যেই ভারতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শকুনের প্রজনন বাসা পান্নায়।
পান্না—বন, তৃণভূমি আর গিরিখাত—আমি দেখা সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোর একটি।
এটি মালভূমির সারি হয়ে বিস্তৃত, তারপর হঠাৎ করেই কেন নদীর দিকে নেমে গেছে। এক সাফারি আমাদের নিয়ে গেল হিনৌতা অঞ্চলে, যা একটি হীরার খনির পাশে অবস্থিত। পান্না—এত সুন্দর, এত মূল্যবান—চারদিক থেকে যেন চেপে ধরা: খামার, গ্রাম, খনি আর নদী।
পরের গন্তব্য ধুন্ধুয়া সেহা বা শকুন পয়েন্ট। নিচে দেখা গেল স্তরবিন্যস্ত বাদামি পাথরের বিশাল অর্ধবৃত্তাকার প্রাকৃতিক মঞ্চ, শতাব্দীর পর শতাব্দী কেন নদীর খোদাইয়ে গড়া। আমি দেখলাম শকুন উড়ে যাচ্ছে—অনেকে একা, কেউ কেউ জোড়ায়—ঘাস আর ডালপালা নিয়ে পাহাড়ের খাঁজে বাসা বানাতে। তারা সামাজিক পাখি, কাছাকাছি বাসা করে। সেখানে উপস্থিত কতজনই বা বুঝেছিল আমাদের সামনে কী বিস্ময়—অবশেষের অবশেষ, বেঁচে থাকা সেই অল্প কজন, যারা পরের প্রজন্ম গড়ার দায়িত্বে।
বাঘ দেখার তাড়নায় আমরা এগিয়ে গেলাম।
আকর্ষণ বড় বিষয়। আইইউসিএনের লাল তালিকায় গিপস শকুন ‘চরম বিপন্ন’, আর বাঘ এখন ‘বিপন্ন’। তবু বাঘই দৃষ্টি কাড়ে, শ্রদ্ধা আদায় করে। তার উপস্থিতিতে সবাই নিঃশ্বাস আটকে রাখে, সময় যেন ধীরে চলে, ঝোপের ফাঁক দিয়ে কমলা ডোরা এগোয়।
শকুন তার উল্টো—টাকমাথা, মৃতদেহের ওপর অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে ভাসমান। প্রয়োজনীয়, কিন্তু ভালোবাসা কঠিন।
অক্ষত আবাসস্থল ও মৃতদেহ ফেলার জায়গায়ও এই পাখির অনুপস্থিতি উদ্বেগজনক। এতে বোঝা যায় সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, সম্ভবত শকুন-ক্ষতিকর ওষুধের অব্যাহত উপস্থিতির কারণে।

তাদের জীবনচক্র সমস্যাকে আরও বাড়ায়। প্রকাশ বলেন, শকুন বছরে একটি ডিম পাড়ে। তার মধ্যে মাত্র অর্ধেক ছানা প্রাপ্তবয়স্ক হয়। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে তারা প্রজনন শুরু করে। যদি প্রাপ্তবয়স্ক মৃত্যুহার পাঁচ শতাংশ ছাড়ায়, বিলুপ্তি সম্ভব। ডাইক্লোফেনাকের সময়ে মৃত্যুহার চল্লিশ শতাংশের বেশি ছিল—এটা ছিল ভয়াবহ।
তাদের হারানো আমাদেরও ক্ষতি।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় ১৯৮৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভারতের যেসব জেলায় আগে শকুন প্রচুর ছিল, সেখানে এই পাখির প্রায় বিলুপ্তির পর মানুষের সামগ্রিক মৃত্যুহার চার শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। এর মানে, নমুনা জনসংখ্যায় বছরে অতিরিক্ত এক লাখ চার হাজার তিনশ ছিয়াশি মানুষের মৃত্যু।
এই ‘পরিচ্ছন্নতা ধাক্কা’র কারণ হলো প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করে না। শকুনের জায়গা পূরণ হয়েছে কম স্বাস্থ্যকর উপায়ে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, শকুন-সমৃদ্ধ জেলাগুলোতে জলাতঙ্কের টিকার বিক্রি বেড়েছে, যা বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধির ইঙ্গিত। গবেষণার সহলেখক অর্থনীতিবিদ অনন্ত সুদর্শন বলেন, শুধু কুকুরই সব অতিরিক্ত মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়; ইঁদুরের সংখ্যা বৃদ্ধি ও পানির মানের অবনতি বড় ভূমিকা রাখে।
১৯৮০-এর দশকের দিল্লির একটি ঝাপসা ছবিতে দেখা যায়, শত শত শকুন একত্রিত হয়েছে একটি মৃতদেহ ফেলার স্থানে। আজ সেখানে পচা জায়গায় কুকুরের দাপট। শকুন মৃতদেহ সামলাতে বিশেষভাবে অভিযোজিত—পরিষ্কার থাকার জন্য টাকমাথা, সংক্রমণ ঠেকাতে অত্যন্ত অম্লীয় পাকস্থলী। তাদের বিকল্পরা ততটা উপযোগী নয়। আমরা কুকুর ও ইঁদুরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলেও, জীবনমানের ক্ষতি চলতেই থাকবে।
শকুন ফেরাতে কিছু উদ্যোগ চলছে। বন বিভাগ ও অন্যান্য গবেষণা সংস্থার সঙ্গে মিলে বিএনএইচএস বন্দী প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করেছে, যার মধ্যে পিঞ্জোরের কেন্দ্রটি সবচেয়ে সফল। চলতি বছরের শুরুতে এখান থেকে ৩৪টি শকুন মহারাষ্ট্রে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু হারালেও প্রকাশ আশাবাদী। তিনি বলেন, শকুন মানিয়ে নিতে পারে, তাদের বিলুপ্তি ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু বিষাক্ত ওষুধ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং নতুন কোনো রাসায়নিক চালুর আগে মৃতভোজী পাখির ওপর পরীক্ষা করা উচিত।
শুরুর গল্পে ফিরলে দেখা যায়, সম্পাতি যে ভাইকে বাঁচায় সে হলো জটায়ু—যে রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে প্রাণ দেয়, এবং যাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া রাম নিজে সম্পন্ন করেন।
আজ তার বংশধরদের দুর্দশা দেখে তিনি কী ভাবতেন, তা ভাবতে ইচ্ছে করে।
লেখক: মৃদুলা রমেশ একজন জলবায়ু-প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী ও লেখক। এখানে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের ব্যক্তিগত
মৃদুলা রমেশ 


















