এগুলোই পৃথিবীতে জীবনের সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ।
স্ট্রোমাটোলাইট এমন এক সময়ের সাক্ষ্য বহন করে, যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ছিল না। এই পাথুরে গঠনগুলোর ভেতর সংরক্ষিত আছে সায়ানোব্যাকটেরিয়ার জীবাশ্ম অবশেষ—এক ধরনের এককোষী অণুজীব, যাকে আমাদের সবার প্রাচীন পূর্বপুরুষ বলা যায়। এই সায়ানোব্যাকটেরিয়াই পৃথিবীর বায়ুতে থাকা অক্সিজেনের বড় একটি অংশ তৈরি করেছিল।
কয়েক বিলিয়ন বছর আগে সায়ানোব্যাকটেরিয়া দল বেঁধে বেড়ে উঠত, অগভীর জলে তৈরি করত আঠালো, জেলির মতো আস্তরণ।
সূর্যালোক ব্যবহার করে আলোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সায়ানোব্যাকটেরিয়া সমুদ্রের জলে দ্রবীভূত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করত, সেটিকে শক্তির জন্য শর্করায় রূপান্তর করত এবং উপজাত হিসেবে অক্সিজেন ছাড়ত। এই জৈব প্রক্রিয়া আশপাশের জলের রাসায়নিক গঠন বদলে দিত। বিশেষ করে জলের পিএইচ বাড়ত এবং এর ফলে ক্যালসিয়াম কার্বনেট বা চুনাপাথর জমে তৈরি হতো কঠিন স্তর।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সায়ানোব্যাকটেরিয়া আজও বিপুল সংখ্যায় পৃথিবীতে টিকে আছে।
এর মানে হলো, এই পাথুরে গঠনগুলো বিশ্লেষণ করে কয়েক বিলিয়ন বছর আগের সামুদ্রিক পরিবেশ ও জোয়ারভাটার সমতলের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এতে ফিরে যাওয়া যায় এমন এক সময়ে, যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল মূলত মিথেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডে ভরা ছিল; যখন প্রাচীনতম মহাদেশগুলো বিশাল মহাসাগরের নিচে ডুবে ছিল; যখন আগ্নেয়গিরির তৎপরতায় আকাশের রং ছিল কমলা; আর যখন ব্যাকটেরিয়া ও আর্কিয়ার মতো এককোষী প্রাণ ছাড়া আর কোনো জীবন ছিল না।

দেশের মাটিতেই লুকিয়ে থাকা সেই রহস্যগুলো কী? এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
২ দশমিক ৬ বিলিয়ন বছর আগে: চিত্রদুর্গ, কর্ণাটক
এখানকার ভূদৃশ্যে আজও প্রাচীন টেকটোনিক পরিবর্তনের চিহ্ন স্পষ্ট। অসমতল ভাঁজ, ফাটল ও চির ধরেছে এমন শিলাস্তর গভীরভাবে পৃথিবীর ভেতরে নেমে গেছে।
চিত্রদুর্গের স্ট্রোমাটোলাইটগুলো দেখতে ধোয়ার গামলার মতো। কোথাও কোথাও এগুলো একটির ওপর আরেকটি জমে স্তম্ভের আকার নিয়েছে।
চিত্রদুর্গের প্রাচীন বাণী বিলাস ও জোলধাল শিলাগঠনের আশপাশে হাঁটলেই চোখে পড়বে এই স্ট্রোমাটোলাইট।
১ দশমিক ৮ বিলিয়ন বছর আগে: ঝামারকোত্রা, রাজস্থান
এই স্ফীত ও পাথুরে জীবাশ্মগুচ্ছের বয়স প্রোটেরোজোয়িক যুগের। তখন ভারতীয় ভূখণ্ড ছিল দক্ষিণের বিশাল সুপারমহাদেশ গন্ডোয়ানার অংশ। পৃথিবীতে অক্সিজেনের পরিমাণ তখনও কম, তবে স্থিতিশীল ছিল।
এখানকার স্ট্রোমাটোলাইটে ইউরেনিয়ামের উপস্থিতি বেশি, যা ইঙ্গিত দেয় গভীর সমুদ্র থেকে উঠে আসা ঠান্ডা জলের স্রোতের কথা। সেই স্রোত অগভীর সামুদ্রিক পরিবেশে নতুন উপাদান এনে প্লাবিত করেছিল। এর আরও প্রমাণ মেলে শঙ্কু আকৃতির খনিজায়িত বুদবুদ কাঠামোতে, যেগুলোকে ডাকনাম দেওয়া হয়েছে ‘কুমিরের চামড়া’।
উদয়পুরের কাছে ঝামারকোত্রার স্ট্রোমাটোলাইট পার্ক একটি স্বীকৃত ভূঐতিহ্য স্থান এবং সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত।
১ দশমিক ৬ বিলিয়ন বছর আগে: চিত্রকূট, মধ্যপ্রদেশ
এই সময়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আজকের তুলনায় মাত্র ১ থেকে ১০ শতাংশ অক্সিজেন ছিল, তবে মহা অক্সিজেনায়ন পর্বের সূচনা হয়ে গেছে।
চিত্রকূটের জীবাশ্মগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে পাওয়া গেছে সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বহুকোষী জীবের প্রমাণ—লাল শৈবাল। এই আবিষ্কারটি হয় ২০১৭ সালে এবং এটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলে, কারণ এর ফলে বহুকোষী জীবের আবির্ভাবের সময়কাল প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর পিছিয়ে যায়।
স্টকহোমের সুইডিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরের গবেষক স্টেফান বেংটসন তাঁর দল নিয়ে এই আবিষ্কার করেন।

এটি কোনো আনুষ্ঠানিক পার্ক না হলেও, চিত্রকূটের স্ট্রোমাটোলাইটগুলো দেখা যায়, বিশেষ করে জনকি কুণ্ড মন্দিরের আশপাশে।
১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বছর আগে: সালখান, উত্তরপ্রদেশ
এই সময়ে পৃথিবী এত দ্রুত ঘুরছিল যে একদিনের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ১৮ ঘণ্টা। এর একটি কারণ ছিল চাঁদের পৃথিবীর অনেক কাছাকাছি অবস্থান, যা পৃথিবীর ঘূর্ণনে প্রভাব ফেলছিল।
অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়তে থাকায় সমুদ্রের উচ্চ লৌহমাত্রার সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটে জল সম্ভবত কালো ও কাদাময় হয়ে উঠেছিল। একই সময়ে সুপারমহাদেশ কলাম্বিয়া ভাঙতে শুরু করে, যা বৈশ্বিক ভূগোল ও জলবায়ুকে প্রভাবিত করেছিল।
এসব ঘটনার ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে সোনভদ্র জীবাশ্ম উদ্যানে, যেখানে অত্যন্ত ভালোভাবে সংরক্ষিত স্ট্রোমাটোলাইট রয়েছে।
১ দশমিক ৪ মিলিয়ন বছর আগে: ছত্তিশগড়
এর মধ্যে কেটে গেছে আরও এক বিলিয়ন বছর। ভূখণ্ড ভেঙে ও সরে গিয়ে তৈরি হয়েছে সমুদ্র ও জলপথের নতুন নতুন পথ।
এই পরিবর্তনের মধ্যেই এখানকার স্ট্রোমাটোলাইটে দেখা যায় বাঁকানো, ঢেউ খেলানো নকশা। একই সময়ে চীন, উত্তর আমেরিকা ও সাইবেরিয়াতেও অনুরূপ গঠন দেখা যায়, যা সমজাতীয় সামুদ্রিক বিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ছত্তিশগড় অববাহিকার স্ট্রোমাটোলাইট জীবাশ্ম সবচেয়ে সহজে দেখা যায় জগদলপুর এলাকায়।
গৌরী এস 


















