নগর কৃষিতে আসছে এক নীরব কিন্তু গভীর পরিবর্তন। মানুষের হাতে নয়, এবার শাকসবজি মাছে মানুষের মতো দেখতে বুদ্ধিমান রোবটের তত্ত্বাবধানে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর রোবট প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে উল্লম্ব কৃষিতে নতুন অধ্যায় শুরু করেছে কৃষিপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রোজ ইনকরপোরেশন।
নগর কৃষিতে প্রযুক্তির নতুন যুগ
কুয়ালালামপুরসহ মালয়েশিয়ার শহুরে কৃষিখামারগুলোকে উচ্চপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় নতুনভাবে সাজাতে অ্যাগ্রোজ চালু করেছে অ্যাগ্রোজ রোবোটিক্স। বৈশ্বিক রোবট নির্মাতা ইউবিটেক রোবোটিক্সের সঙ্গে যৌথভাবে নেওয়া এই উদ্যোগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কৃষির রূপ বদলে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। লক্ষ্য একটাই, পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় এবং নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম স্মার্ট খামার গড়ে তোলা।
এই প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দু ইউবিটেকের শিল্পমানের মানবাকৃতির রোবট ওয়াকার এস। এই রোবটকে যুক্ত করা হচ্ছে অ্যাগ্রোজের নিজস্ব খামার পরিচালন ব্যবস্থা অ্যাগ্রোজ ওএসের সঙ্গে। এর মাধ্যমে বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল পর্যবেক্ষণ, সংগ্রহ এবং উৎপাদন উন্নয়ন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ধীরে ধীরে স্বয়ংক্রিয় হবে।
মানুষের বিকল্প নয়, মানুষের সহকারী
অ্যাগ্রোজের প্রধান নির্বাহী জেরার্ড লিম বলছেন, এই উদ্যোগ কৃষিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার পথে বড় মাইলফলক। তাঁর ভাষায়, রোবট মানুষের কাজ কেড়ে নিতে আসেনি। বরং পুনরাবৃত্তিমূলক ও শ্রমঘন কাজ সামলে রোবট কৃষকদের সময় করে দেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা সমাধান এবং গাছের যত্নে মনোযোগ দেওয়ার জন্য।

ওয়াকার এস এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে এটি খামারের ভেতরে হেঁটে হেঁটে গাছ পর্যবেক্ষণ করতে পারে। উন্নত ক্যামেরা ও সেন্সরের মাধ্যমে মানুষের চোখের বাইরে থাকা অবলোহিত ও অতিবেগুনি তথ্যও সংগ্রহ করতে পারবে এই রোবট। ভবিষ্যতে ফসল সংগ্রহ ও গাছ পরিচর্যার মতো জটিল কাজেও এটি সহায়তা করবে, তবে সবকিছুই থাকবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে।
উল্লম্ব কৃষিতে উৎপাদনের লাফ
অ্যাগ্রোজ বর্তমানে কুয়ালালামপুরে একাধিক উল্লম্ব খামার পরিচালনা করছে। এর মধ্যে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত অ্যাগ্রোজ এডু ফার্মও রয়েছে। ঘরের ভেতরের উল্লম্ব কৃষি আর গ্রীনহাউসভিত্তিক নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ একসঙ্গে কাজে লাগিয়ে এসব খামারে একই জায়গায় অনেক বেশি ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
জেরার্ড লিম জানাচ্ছেন, এই পদ্ধতিতে প্রচলিত গ্রীনহাউসের তুলনায় বারো থেকে পনেরো গুণ বেশি ফলন পাওয়া যায়, অথচ পানির ব্যবহার কমে যায় প্রায় বিশ গুণ। এতে কৃষকের আয় বাড়ার পাশাপাশি পরিবেশের ওপর চাপও কমে।
অ্যাগ্রোজ ওএস ব্যবস্থার মাধ্যমে পানি, পুষ্টি ও পরিবেশের প্রতিটি দিক সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাস্তবসময়ের তথ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্লেষণ করে ফসল কাটার সঠিক সময় নির্ধারণ করে দেয়। ফলে সুপারশপ ও খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পায় একই মানের তাজা পণ্য।
খরচ কমানোই বড় চালিকাশক্তি
মানবাকৃতির রোবট ব্যবহারের পেছনে খরচ কমানোও বড় কারণ। জেরার্ড লিমের মতে, রোবটের দাম একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নামলে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই এটি মানবশ্রমের চেয়ে বেশি সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে। কারণ রোবট দিনে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে পারে, ক্লান্ত হয় না এবং ভুলের পরিমাণও কম।
শুরুর দিকে কুয়ালালামপুরে এই রোবট ব্যবস্থার প্রয়োগ শুরু হবে। এরপর জোহর, ইন্দোনেশিয়া এবং ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
নিরাপদ ও টেকসই খাদ্যের প্রতিশ্রুতি
অ্যাগ্রোজের কৃষি মডেল খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্য সুরক্ষা এবং টেকসই উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি মালয়েশিয়ার উত্তম কৃষি অনুশীলন সনদ পেয়েছে। শহরের কাছাকাছি খামার স্থাপন করায় পরিবহন দূষণ কমছে এবং সরবরাহ ব্যবস্থাও হচ্ছে বেশি স্থিতিশীল।

এই খামারগুলোতে পালং শাক, কেল, আরুগুলাসহ নানা ধরনের পাতা শাক ও ভেষজ উৎপাদন হচ্ছে, যা মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমদানিনির্ভরতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় স্থানীয়ভাবে উন্নতমানের খাদ্য উৎপাদনের গুরুত্ব আরও বেড়েছে বলে মনে করছেন অ্যাগ্রোজ কর্তৃপক্ষ।
আগামীর পথে রোবট আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
অ্যাগ্রোজ রোবোটিক্সকে এক দিনের প্রকল্প হিসেবে দেখছে না প্রতিষ্ঠানটি। আগামী এক থেকে দুই বছরে এই প্রযুক্তির আরও উন্নয়ন হবে। ভবিষ্যতে অ্যাগ্রোজ ওএসের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে থেকেই খামার পরিচালনা করবে, আর রোবট সামলাবে শারীরিকভাবে কষ্টসাধ্য কাজ।
জেরার্ড লিমের কথায়, এই পথচলা মানুষের পাশে থেকেই। লক্ষ্য একটাই, কম খরচে বেশি উৎপাদন, পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে শহরের মানুষকে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়া।
#উল্লম্বকৃষি #রোবটপ্রযুক্তি #কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা #নগরকৃষি #খাদ্যনিরাপত্তা #টেকসইকৃষি #মালয়েশিয়া #ভবিষ্যতেরখামার
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















