“এটা এমন বলা যে, পৃথিবীতে যৌনকর্মীদের সঙ্গে ভয়াবহ কিছু ঘটনা ঘটে, তাই চলুন যৌনতাই নিষিদ্ধ করি। কে তার সুস্থ বিবেচনায় এমন প্রস্তাব দেবে?”
নারীদের নিজেদের শরীর নিয়ে কী করার অধিকার আছে—এ প্রশ্নে রক্ষণশীল নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী ও নারীবাদী অধিকারকর্মীরা খুব কমই একমত হন। একপক্ষ ঐতিহ্যবাহী ভূমিকার পক্ষে সাফাই গায়, অন্যপক্ষ জোর দেয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকারেই। কিন্তু জটিল ও বিতর্কিত সারোগেসি বা গর্ভধারণ-বহন প্রথা নিয়ে এই দুই বিপরীত মেরুর পক্ষই আশ্চর্যজনকভাবে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে—এই প্রথার অবসান হওয়া উচিত।
এই অপ্রত্যাশিত অবস্থানগত মিল প্রকাশ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে অক্টোবরে, যখন নারী ও কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক রীম আলসালেম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক কঠোর প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, পারিশ্রমিকভিত্তিক হোক বা বিনা পারিশ্রমিকে, দেশীয় হোক বা আন্তর্জাতিক—সারোগেসির সব ধরনের চর্চাই সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা উচিত।
আলসালেমের যুক্তি ছিল, এই প্রথা নারীদের ওপর “বহুবিধ সহিংসতা” চাপিয়ে দেয়, গর্ভধারণকে চুক্তিভিত্তিক শ্রমে পরিণত করে এবং নারীর শরীরকে ধনী ও ক্ষমতাবানদের জন্য কেবল সন্তান সরবরাহের যন্ত্রে নামিয়ে আনে। তিনি সারোগেসিকে পতিতাবৃত্তি ও মানবপাচারের সঙ্গে তুলনা করেন এবং বলেন, নারীরা সম্মতি দিলেও এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত তাদের পণ্যে পরিণত করে।
নিউজউইককে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আলসালেম বলেন, “আমি নিষেধাজ্ঞার কথা বলিনি। আমি বলেছি বিলুপ্তির কথা।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই পার্থক্যটি ইচ্ছাকৃত। “‘নিষেধাজ্ঞা’ একটি সীমিত ও আইনি শব্দ—যা বদলানো যায়। কিন্তু ‘বিলুপ্তি’ মানে একটি পুরো ব্যবস্থাকে শিকড়সহ তুলে ফেলা, যার ব্যাপক কাঠামোগত ও সামাজিক প্রভাব থাকে।”

জাতিসংঘে জমা দেওয়া তাঁর প্রতিবেদনে পতিতাবৃত্তি বিলোপবাদী নীতির আদলে একটি পাঁচ দফা আইনি কাঠামো তুলে ধরা হয়। এতে রয়েছে—সারোগেসি কমিশনকারীদের অপরাধী করা, তৃতীয় পক্ষের মুনাফা নিষিদ্ধ করা, বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, জনসচেতনতা কার্যক্রমে বিনিয়োগ এবং গর্ভধারণ বহনকারী নারীদের শাস্তি নয়, সহায়তা দেওয়া।
আলসালেম বলেন, সারোগেসি চুক্তি প্রায়ই নারীদের নিজেদের শরীর, গর্ভাবস্থা ও স্বাস্থ্য নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়। তাঁর মতে, অনেক নারী আর্থিক চাপে এসব চুক্তিতে সই করেন, প্রায়ই আইনি পরামর্শ বা কোনো জটিলতায় প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ ছাড়াই। “একবার তারা সারোগেট মা হয়ে গেলে, তাদের স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন, সারোগেসিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছে শিশুরাই। “এই প্রক্রিয়ায় তাদের কোনো মতামত নেই,” আলসালেম বলেন। “কেউ তাদের সম্মতি চায় না বা তাদের কল্যাণের কথা ভাবে না।”
এই প্রস্তাব দ্রুতই সারোগেসির পক্ষে থাকা সংগঠন, এলজিবিটিকিউ পরিবার গোষ্ঠী ও প্রজনন অধিকারবিষয়ক আইনজীবীদের সমালোচনার মুখে পড়ে। তাদের অভিযোগ, আলসালেম নৈতিক কাঠামো সম্পর্কিত প্রমাণ উপেক্ষা করেছেন এবং যেসব সারোগেট মা নিজেদের অভিজ্ঞতাকে ক্ষমতায়নমূলক বলে মনে করেন, তাদের কণ্ঠ মুছে দিয়েছেন।
কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মতো দেশে আধুনিক সারোগেসি বাস্তবতার সঙ্গে এই প্রতিবেদন সংযোগহীন—এমন মন্তব্য করেন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও শিক্ষাবিদরাও।
“এটা এমন বলা যে, যৌনকর্মীদের সঙ্গে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে বলে যৌনতাই নিষিদ্ধ করা উচিত,” বলেন ‘মেন হ্যাভিং বেবিজ’-এর নির্বাহী পরিচালক রন পুল-ডেয়ান। এলজিবিটিকিউ পরিবারগুলোর জন্য নৈতিক সারোগেসির পক্ষে থাকা এই সংস্থাটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সংগঠন।
২০০১ সালে সারোগেসির মাধ্যমে বাবা হওয়া পুল-ডেয়ানের মতে, আলসালেমের উপস্থাপন আদর্শগতভাবে প্রণোদিত এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বিচ্ছিন্ন। তিনি এমন দেশগুলোর কথা উল্লেখ করেন, যেখানে কঠোর নৈতিক মানদণ্ড রয়েছে—যেমন বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, মানসিক মূল্যায়ন এবং এই গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যে, শিশুর জীবিত জন্মের ওপর পারিশ্রমিক নির্ভরশীল নয়।

পুল-ডেয়ান বলেন, “নৈতিক কাঠামোতে সারোগেট মায়েদের পারিশ্রমিক ফলাফলের সঙ্গে যুক্ত নয়—এটা প্রক্রিয়ার কষ্ট, বিঘ্ন ও ঝুঁকির জন্য। যদি শিশুর জীবিত জন্ম না-ও হয়, তবুও সারোগেট একই বা আরও বেশি পারিশ্রমিক পান। এটাই নৈতিক সারোগেসিকে শিশু কেনাবেচা থেকে আলাদা করে।”
এক বিলিয়ন ডলারের শিল্প
একসময় সীমিত পরিসরের প্রথা হলেও, সারোগেসি এখন একটি ফুলে-ফেঁপে ওঠা বৈশ্বিক শিল্প। সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া কঠিন হলেও ধারণা করা হয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের মাধ্যমে প্রতি বছর সারোগেট মায়েরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় সৃষ্টি করেন। গ্লোবাল মার্কেট ইনসাইটসের গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী সারোগেসি বাজারের মূল্য ছিল ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা ২০৩৪ সালে ২০১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রতিবছর ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার শিশু সারোগেসির মাধ্যমে জন্ম নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে অঙ্গরাজ্যভিত্তিক আইন প্রযোজ্য, একটি সারোগেসি চুক্তির গড় খরচ ১ লাখ থেকে ২ লাখ ডলার বা তারও বেশি হতে পারে। এতে আইনি ফি, চিকিৎসা ব্যয়, এজেন্সির কমিশন ও সারোগেটের পারিশ্রমিক অন্তর্ভুক্ত। কানাডা তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী, যেখানে আইভিএফ ও সারোগেসির মোট খরচ ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলারের মধ্যে।
সমর্থকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলের পার্থক্য কেবল অর্থনৈতিক নয়; বরং অপব্যবহার ঠেকাতে গড়ে ওঠা নিয়ন্ত্রক কাঠামো। যুক্তরাষ্ট্রের বহু কর্মসূচিতে সম্ভাব্য সারোগেটদের বিস্তৃত স্বাস্থ্য ও মানসিক পরীক্ষা দিতে হয়। চুক্তিতে নিশ্চিত করা হয়, শিশুর জন্ম যাই হোক না কেন, সারোগেট পারিশ্রমিক পাবেন। উভয় পক্ষের জন্য আলাদা আইনি প্রতিনিধিও থাকে।
পাঁচবার গর্ভধারণ বহনকারী ক্লেয়ার বলেন, এই কাঠামোবদ্ধ ব্যবস্থাই তাকে সম্মানিত ও সুরক্ষিত বোধ করিয়েছে। “আমি জানতাম কীতে জড়াচ্ছি এবং বুঝতাম, আমি যে শিশুকে বহন করছি তার মা নই,” তিনি বলেন। “আমি অন্য কাউকে সহায়তা করছি।”
যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্যভেদে নিয়ম ভিন্ন হলেও, ক্লেয়ার বলেন স্বাধীন আইনি সহায়তা ও মানসিক মূল্যায়নের মতো সুরক্ষাব্যবস্থা সবাইকে স্পষ্ট ধারণা দেয়। তাঁর মতে, “যেখানে সমস্যা দেখা যায়, সেগুলো সাধারণত নিয়ম এড়িয়ে যাওয়ার ফল।”
আর্থিক দিকটিও কিছু সারোগেটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর্কানসাসের তিনবারের সারোগেট কে.বি. বলেন, পারিশ্রমিক তাঁর পরিবারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে স্থিতিশীল হতে সাহায্য করেছে। “আমি কম পারিশ্রমিকেই করেছি, কারণ টাকার চেয়ে বিষয়টি আমার কাছে অনেক বেশি ছিল,” তিনি বলেন। “কিন্তু একক মা হিসেবে এটি আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা গড়তে সাহায্য করেছে।”

দুজনই অভিজ্ঞতাটিকে জীবনের সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করেন।
প্রজনন পর্যটন
সমালোচকদের মতে, ভালো আইন থাকলেও ক্ষমতার বৈষম্য থেকে যায়। উচ্চ খরচ ও দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে অনেকেই পূর্ব ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকায় যান, যেখানে খরচ কম এবং নিয়ম আরও অস্পষ্ট।
শিশু অধিকারকর্মী নাইজেল ক্যান্টওয়েল বলেন, অর্থের বিনিময়ে শিশু হস্তান্তরের যেকোনো ব্যবস্থা বিক্রির শামিল। ইউরোপে ইতিমধ্যেই সারোগেসিবিরোধী আইন জোরদার হয়েছে। ইতালি, জার্মানি ও স্পেন এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।
কলম্বিয়ায় সারোগেসি এখন একটি উদীয়মান গন্তব্য। তবে সেখানে দরিদ্র নারীদের পর্যাপ্ত তদারকি ছাড়াই নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে। আইনজীবী মারিয়া ক্রিস্টিনা হুরতাদো বলেন, “এটি প্রজনন পর্যটনের একটি বাজার তৈরি করেছে।”
বিলুপ্তি না নিয়ন্ত্রণ
বিস্ময়করভাবে, সারোগেসির বিরোধিতা এখন আদর্শগত সব শিবির থেকেই আসছে। তবে সমর্থকদের মতে, সম্পূর্ণ বিলুপ্তি নয়, বরং শক্তিশালী নৈতিক নিয়ন্ত্রণই সমাধান।
কিন্তু বিলোপবাদীদের কাছে মূল আপত্তি একই—গর্ভধারণকে চুক্তিতে রূপান্তর করা এবং গর্ভাশয়কে ভাড়ার জায়গা বানানো। এই বিতর্ক কেবল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নয়, জীবন ও পরিবারের সংজ্ঞা নিয়েই।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















