০৯:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
ঢাকায় উদীচী কার্যালয়ে হামলার পর অগ্নিকাণ্ড প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের তীব্র নিন্দা, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি প্রথম আলোর কারওয়ান বাজার কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় বিচার দাবি নিক্কেই এশিয়া প্রতিবেদন: বাংলাদেশ –ভারত সম্পর্কের অবনতি জামায়াতের আহ্বান সংযম ও ঐক্যের পথে থাকার চীনের স্যাটেলাইট ‘সুপার ফ্যাক্টরি’: স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে বড় পদক্ষেপ চীনের ড্রোন ঝাঁকের সক্ষমতায় বড় অগ্রগতি চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি জাপানের নিরাপত্তায় ‘গুরুতর প্রভাব’ ফেলতে পারে: টোকিওর সতর্কবার্তা নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে ট্রাম্প পরিবারের সমর্থিত মিডিয়া ব্যবসা ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা–নীতি নিয়ে যুক্তি বদলাচ্ছে

সান্তা ক্লজের উৎস: ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শক্তির নরম রাজনীতি

প্রতি বছর ডিসেম্বর এলেই লাল পোশাকের সাদা দাড়িওয়ালা এক চরিত্র যেন কোনো পাসপোর্ট বা অনুমতি ছাড়াই দেশের সীমানা পেরিয়ে হাজির হন। এই চরিত্রকে আমরা চিরন্তন বলে ভাবলেও, সান্তা ক্লজের জন্মকথা আসলে তুলনামূলকভাবে আধুনিক। এর পেছনে আছে অভিবাসন, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তারের কৌশল।

সেন্ট নিকোলাস থেকে সান্তা ক্লজ
সান্তার শিকড় খুঁজলে পৌঁছাতে হয় চতুর্থ শতকের মিরার বিশপ সেন্ট নিকোলাসের কাছে। তিনি ছিলেন উদারতা ও অলৌকিক কাজের জন্য পরিচিত এক খ্রিস্টান ধর্মগুরু। সময়ের সঙ্গে তাঁর গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় উত্তর ইউরোপের শীতকালীন উৎসব ও লোকাচার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ধারাগুলো মিশে গড়ে ওঠে এক নতুন চরিত্র।

ইউরোপীয় ঐতিহ্য ও আমেরিকান রূপান্তর
ব্রিটেনে ফাদার ক্রিসমাস মূলত আনন্দ ও উৎসবের প্রতীক ছিলেন, ধর্মীয় অনুষঙ্গ সেখানে তুলনামূলক কম। নেদারল্যান্ডসে সিন্টারক্লাস ডিসেম্বর মাসে ভালো শিশুদের উপহার দিতেন। ডাচ অভিবাসীরা যখন নিউইয়র্কে বসতি গড়ে তোলেন, তখন এই সব ধারণা একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায়। এর মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে এক বিশেষভাবে আমেরিকান সান্তার জন্ম হয়।

নিউইয়র্কে সান্তার আধুনিক রূপ
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ ও উনিশ শতকের শুরুতে নিউইয়র্কের অভিজাত সমাজ সান্তার ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। ব্যবসায়ী জন পিনটার্ড সেন্ট নিকোলাসকে নিউইয়র্ক হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন, যেখানে তিনি নাগরিক নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার রক্ষক। ১৮০৯ সালে লেখক ওয়াশিংটন আরভিং তাঁর ব্যঙ্গধর্মী ইতিহাস গ্রন্থে সিন্টারক্লাসকে নতুন নামে হাজির করেন, সান্তা ক্লজ। এখানে তাঁকে বিশপের পোশাক থেকে মুক্ত করে এক হাসিখুশি ডাচ ভদ্রলোকে রূপান্তর করা হয়। এটি ছিল নতুন রাষ্ট্রের জন্য অতীতের বদলে ভবিষ্যতমুখী এক উৎসবী প্রতীক গড়ার প্রচেষ্টা।

কবিতা ও কল্পনায় সান্তার চেহারা
উনিশ শতকের শুরুতে কবিতার মাধ্যমে সান্তার চেহারা আরও স্পষ্ট হয়। ১৮২১ সালের একটি কবিতায় প্রথম দেখা যায় স্লেজ ও হরিণের ধারণা। এরপরের বছর প্রকাশিত সেন্ট নিকোলাসের সফর বিষয়ক কবিতায় গড়ে ওঠে আজকের পরিচিত সান্তা, গোলগাল শরীর, চিমনি বেয়ে নামা এবং আটটি নামধারী হরিণ। একই সময়ে জার্মান ঐতিহ্য থেকে আসা ক্রিস ক্রিংল নামটিও প্রচলিত হয়, যা অভিবাসী সংস্কৃতির মিশ্রণের প্রমাণ।

চিত্রকল্প, উত্তর মেরু ও বাণিজ্যিক রূপ
উনিশ শতকের মাঝামাঝি জার্মান বংশোদ্ভূত শিল্পী থমাস ন্যাস্ট সান্তাকে এক স্নেহশীল, লোমশ পোশাক পরা চরিত্র হিসেবে আঁকেন এবং পরে তাঁর বাসস্থান নির্ধারণ করেন উত্তর মেরুতে। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে পানীয় কোম্পানির বিজ্ঞাপন সান্তার লাল-সাদা রঙকে জনপ্রিয় করে তোলে, যদিও এই রঙ তখন আগেই পরিচিত ছিল। এরপর গল্পে যোগ হয় মিসেস ক্লজ ও এলফদের মতো চরিত্র, যা আধুনিক উৎপাদন ও ভোগের সমাজের সঙ্গে মানানসই এক পারিবারিক ও কর্মব্যস্ত পরিবেশ তৈরি করে।

বিশ্বজুড়ে সান্তার নানা রূপ
বর্তমানে বিশ্বের দুই শত কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে বড়দিন পালন করেন, এমন অনেক সমাজেও যেখানে খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু। ফিনল্যান্ডে সান্তার ঠিকানা ল্যাপল্যান্ডে, যেখানে তাঁর নিজস্ব ডাকঘর রয়েছে। কানাডায় তাঁর সরকারি ঠিকানা ও পোস্টাল কোড আছে। রাশিয়ায় নববর্ষে উপহার আনেন দেদ মরোজ। জাপানে বড়দিন ধর্মনিরপেক্ষ ও বাণিজ্যিক উৎসব। আবার ব্রুনেই ও সোমালিয়ার মতো দেশে প্রকাশ্য উদযাপন নিষিদ্ধ। প্রতিটি রূপই দেখায়, কীভাবে বৈশ্বিক ঐতিহ্য স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া হয়।

নরম শক্তির প্রতীক হিসেবে সান্তা
সান্তা ক্লজের যাত্রাপথ আসলে নরম শক্তির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে বাণিজ্য, সাম্রাজ্য ও গণমাধ্যমের পথ ধরে, জোর করে নয়, আকর্ষণের মাধ্যমে। তুরস্কের এক বিশপ থেকে উত্তর ইউরোপের দানশীল চরিত্র, সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক প্রতীক এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বজনীন শুভেচ্ছার প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠা এই যাত্রা মনে করিয়ে দেয়, শক্তি প্রয়োগের চেয়ে গল্প ও সংস্কৃতি অনেক সময় বেশি কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে।

জনপ্রিয় সংবাদ

ঢাকায় উদীচী কার্যালয়ে হামলার পর অগ্নিকাণ্ড

সান্তা ক্লজের উৎস: ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শক্তির নরম রাজনীতি

০৭:২৭:২৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫

প্রতি বছর ডিসেম্বর এলেই লাল পোশাকের সাদা দাড়িওয়ালা এক চরিত্র যেন কোনো পাসপোর্ট বা অনুমতি ছাড়াই দেশের সীমানা পেরিয়ে হাজির হন। এই চরিত্রকে আমরা চিরন্তন বলে ভাবলেও, সান্তা ক্লজের জন্মকথা আসলে তুলনামূলকভাবে আধুনিক। এর পেছনে আছে অভিবাসন, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তারের কৌশল।

সেন্ট নিকোলাস থেকে সান্তা ক্লজ
সান্তার শিকড় খুঁজলে পৌঁছাতে হয় চতুর্থ শতকের মিরার বিশপ সেন্ট নিকোলাসের কাছে। তিনি ছিলেন উদারতা ও অলৌকিক কাজের জন্য পরিচিত এক খ্রিস্টান ধর্মগুরু। সময়ের সঙ্গে তাঁর গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় উত্তর ইউরোপের শীতকালীন উৎসব ও লোকাচার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ধারাগুলো মিশে গড়ে ওঠে এক নতুন চরিত্র।

ইউরোপীয় ঐতিহ্য ও আমেরিকান রূপান্তর
ব্রিটেনে ফাদার ক্রিসমাস মূলত আনন্দ ও উৎসবের প্রতীক ছিলেন, ধর্মীয় অনুষঙ্গ সেখানে তুলনামূলক কম। নেদারল্যান্ডসে সিন্টারক্লাস ডিসেম্বর মাসে ভালো শিশুদের উপহার দিতেন। ডাচ অভিবাসীরা যখন নিউইয়র্কে বসতি গড়ে তোলেন, তখন এই সব ধারণা একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায়। এর মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে এক বিশেষভাবে আমেরিকান সান্তার জন্ম হয়।

নিউইয়র্কে সান্তার আধুনিক রূপ
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ ও উনিশ শতকের শুরুতে নিউইয়র্কের অভিজাত সমাজ সান্তার ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। ব্যবসায়ী জন পিনটার্ড সেন্ট নিকোলাসকে নিউইয়র্ক হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন, যেখানে তিনি নাগরিক নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার রক্ষক। ১৮০৯ সালে লেখক ওয়াশিংটন আরভিং তাঁর ব্যঙ্গধর্মী ইতিহাস গ্রন্থে সিন্টারক্লাসকে নতুন নামে হাজির করেন, সান্তা ক্লজ। এখানে তাঁকে বিশপের পোশাক থেকে মুক্ত করে এক হাসিখুশি ডাচ ভদ্রলোকে রূপান্তর করা হয়। এটি ছিল নতুন রাষ্ট্রের জন্য অতীতের বদলে ভবিষ্যতমুখী এক উৎসবী প্রতীক গড়ার প্রচেষ্টা।

কবিতা ও কল্পনায় সান্তার চেহারা
উনিশ শতকের শুরুতে কবিতার মাধ্যমে সান্তার চেহারা আরও স্পষ্ট হয়। ১৮২১ সালের একটি কবিতায় প্রথম দেখা যায় স্লেজ ও হরিণের ধারণা। এরপরের বছর প্রকাশিত সেন্ট নিকোলাসের সফর বিষয়ক কবিতায় গড়ে ওঠে আজকের পরিচিত সান্তা, গোলগাল শরীর, চিমনি বেয়ে নামা এবং আটটি নামধারী হরিণ। একই সময়ে জার্মান ঐতিহ্য থেকে আসা ক্রিস ক্রিংল নামটিও প্রচলিত হয়, যা অভিবাসী সংস্কৃতির মিশ্রণের প্রমাণ।

চিত্রকল্প, উত্তর মেরু ও বাণিজ্যিক রূপ
উনিশ শতকের মাঝামাঝি জার্মান বংশোদ্ভূত শিল্পী থমাস ন্যাস্ট সান্তাকে এক স্নেহশীল, লোমশ পোশাক পরা চরিত্র হিসেবে আঁকেন এবং পরে তাঁর বাসস্থান নির্ধারণ করেন উত্তর মেরুতে। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে পানীয় কোম্পানির বিজ্ঞাপন সান্তার লাল-সাদা রঙকে জনপ্রিয় করে তোলে, যদিও এই রঙ তখন আগেই পরিচিত ছিল। এরপর গল্পে যোগ হয় মিসেস ক্লজ ও এলফদের মতো চরিত্র, যা আধুনিক উৎপাদন ও ভোগের সমাজের সঙ্গে মানানসই এক পারিবারিক ও কর্মব্যস্ত পরিবেশ তৈরি করে।

বিশ্বজুড়ে সান্তার নানা রূপ
বর্তমানে বিশ্বের দুই শত কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে বড়দিন পালন করেন, এমন অনেক সমাজেও যেখানে খ্রিস্টানরা সংখ্যালঘু। ফিনল্যান্ডে সান্তার ঠিকানা ল্যাপল্যান্ডে, যেখানে তাঁর নিজস্ব ডাকঘর রয়েছে। কানাডায় তাঁর সরকারি ঠিকানা ও পোস্টাল কোড আছে। রাশিয়ায় নববর্ষে উপহার আনেন দেদ মরোজ। জাপানে বড়দিন ধর্মনিরপেক্ষ ও বাণিজ্যিক উৎসব। আবার ব্রুনেই ও সোমালিয়ার মতো দেশে প্রকাশ্য উদযাপন নিষিদ্ধ। প্রতিটি রূপই দেখায়, কীভাবে বৈশ্বিক ঐতিহ্য স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া হয়।

নরম শক্তির প্রতীক হিসেবে সান্তা
সান্তা ক্লজের যাত্রাপথ আসলে নরম শক্তির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে বাণিজ্য, সাম্রাজ্য ও গণমাধ্যমের পথ ধরে, জোর করে নয়, আকর্ষণের মাধ্যমে। তুরস্কের এক বিশপ থেকে উত্তর ইউরোপের দানশীল চরিত্র, সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক প্রতীক এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বজনীন শুভেচ্ছার প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠা এই যাত্রা মনে করিয়ে দেয়, শক্তি প্রয়োগের চেয়ে গল্প ও সংস্কৃতি অনেক সময় বেশি কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে।