খুলনা মহানগরী ক্রমেই ভয়াবহ খুনোখুনির নগরীতে পরিণত হচ্ছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ড নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। প্রকাশ্য আদালত প্রাঙ্গণে জোড়া খুন, একদিনে চারজন নিহত হওয়া এবং রাজনৈতিক সংগঠকের গুলিবিদ্ধ হওয়ার মতো ঘটনাগুলো পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। অপরাধীদের বড় একটি অংশ এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে।
চলতি বছরে হত্যাকাণ্ডের চিত্র
পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খুলনা নগরীতে মোট ৩৬টি হত্যাকাণ্ডের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হলেও ১৩টি মামলার কারণ এখনও অজানা রয়ে গেছে, যা মোট হত্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এই অনিষ্পন্ন ঘটনাগুলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

সাংবাদিক হত্যাসহ আলোচিত ঘটনা
১৮ ডিসেম্বর খুলনায় সাংবাদিক ইমদাদুল হক মিলনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই ঘটনায় একজন চিকিৎসক গুলিবিদ্ধ হন। জনবহুল এলাকায় সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনও উন্মোচন হয়নি। মিলন স্থানীয় সংবাদমাধ্যম পরিচালনার পাশাপাশি প্রেসক্লাবের নেতৃত্বে ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড খুলনার গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যেও গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
হত্যার পেছনের কারণ কী
পুলিশ জানিয়েছে, অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। পারিবারিক কলহ, ব্যবসায়িক লেনদেন, প্রেমঘটিত বিরোধ, জমি সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব, চুরি ও ডাকাতির উদ্দেশ্যে সংঘটিত হত্যাও রয়েছে। কিছু ঘটনায় কারণ এখনও শনাক্ত করা যায়নি।
মাস ও থানাভিত্তিক চিত্র

বছরের বিভিন্ন মাসে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ওঠানামা করেছে। মে, আগস্ট, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে তুলনামূলক বেশি খুন হয়েছে। থানাভিত্তিক হিসাবে সদর ও সোনাডাঙ্গা থানায় হত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করা হলেও অনেকেই এখনও পলাতক।
অপরাধী গোষ্ঠীর সক্রিয়তা
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, খুলনার অপরাধ জগত বর্তমানে একাধিক শক্তিশালী গোষ্ঠীর দখলে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে। সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া কয়েকজন শীর্ষ চরমপন্থীর কারণে অপরাধ জগতে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে নগরীতে অন্তত সাতটি বড় অপরাধী চক্র সক্রিয় রয়েছে।
আদালত প্রাঙ্গণের জোড়া খুন
চলতি বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে দুই শীর্ষ অপরাধীর প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড। ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা পুলিশের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র না থাকায় তারা হস্তক্ষেপ করতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরাধীদের কাছে ছিল আধুনিক অস্ত্র। এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ ও নির্দেশদাতারা এখনও চিহ্নিত হয়নি।

র্যাব ও পুলিশের তদন্ত
র্যাব জানিয়েছে, আদালত এলাকায় সংঘটিত জোড়া হত্যাকাণ্ডে একটি সংগঠিত দল অংশ নেয়। একজনকে গ্রেফতার করে তার স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি অপরাধী গোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিনের কোন্দল ও আধিপত্যের লড়াই থেকেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরও সহিংস হয়ে উঠতে পারে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্তি ও তাদের আত্মগোপনে থাকা খুলনার অপরাধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। নগরীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর নজরদারি ও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















