যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে চীনের অফশোর ইউয়ান আরও শক্তিশালী হয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সীমা সাতের নিচে নেমে এসেছে। বৃহস্পতিবার ডলারের বিপরীতে ইউয়ানের দর সাতের নিচে নামা সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রাটির ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির আরেকটি স্পষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর আগের দিন বুধবার সন্ধ্যাতেও স্বল্প সময়ের জন্য একই সীমা অতিক্রম করেছিল ইউয়ান।
দীর্ঘ ১৫ মাস পর গুরুত্বপূর্ণ সীমা অতিক্রম
সাম্প্রতিক এই ওঠানামা গত ১৫ মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইউয়ানের বড় মানসিক সীমা অতিক্রম করার ঘটনা। এতে বাজারের মনোভাব বদলানোর ইঙ্গিত মিলছে এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও অর্থনীতিবিদদের সেই যুক্তিকে আরও জোরালো করছে যে ইউয়ান দীর্ঘদিন ধরেই তুলনামূলকভাবে কম মূল্যায়িত ছিল।

বাজার তথ্য অনুযায়ী ইউয়ানের অবস্থান
চীনের আর্থিক তথ্য সরবরাহকারী উইন্ডের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকালে অফশোর ইউয়ানের বিনিময় হার সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৯৯৬০-এ পৌঁছায়। এর আগের দিন বুধবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হার ছিল ৬ দশমিক ৯৯৯৯। একই সময়ে অনশোর ইউয়ান বৃহস্পতিবার ডলারের বিপরীতে ৭ দশমিক ০১-এ পৌঁছায়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের পর এই প্রথম উভয় হারের এমন অবস্থান দেখা গেল।
ইউয়ান নিয়ে বাজারে আশাবাদ
চীনা মুদ্রা নিয়ে বাজারে আশাবাদ বাড়ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, সামনে ইউয়ানের মূল্য আরও বাড়তে পারে। তবে শক্তিশালী ইউয়ানের কারণে ছোট ও মাঝারি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে।
ডলার দুর্বলতা ও বৈদেশিক মুদ্রা চাহিদা
বিশ্লেষকদের মতে, ইউয়ানের সাম্প্রতিক শক্তিশালী অবস্থানের পেছনে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের দুর্বলতা, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ও চাহিদার পরিবর্তন ভূমিকা রেখেছে। ধারাবাহিক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং কোম্পানিগুলোর কেন্দ্রীভূত বৈদেশিক মুদ্রা নিষ্পত্তির ফলে সাময়িকভাবে ইউয়ানের চাহিদা বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণের টেকসইতা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক বার্তা
বৃহস্পতিবার চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়না ডলারের বিপরীতে দৈনিক মধ্যম হার নির্ধারণ করে ৭ দশমিক ০৩৯২। গত এক মাসে অনশোর ইউয়ান ডলারের বিপরীতে এক শতাংশের বেশি শক্তিশালী হয়েছে। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটি বিনিময় হারে অতিরিক্ত ওঠানামার ঝুঁকি কমানো এবং যুক্তিসংগত ও ভারসাম্যপূর্ণ পর্যায়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর জোর দেয়।
ইউয়ান নিয়ে নীতিগত ইঙ্গিত
গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাষায় কখনো স্থিতিস্থাপকতা, কখনো নমনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালী ইউয়ান চাইলেও দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি এড়াতে সতর্ক থাকতে চায়।
রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ

চীন ইতোমধ্যে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অর্জন করেছে। শেনওয়ান হংইউয়ান সিকিউরিটিজের প্রধান অর্থনীতিবিদ ঝাও ওয়েই বলেছেন, চলতি বছরে বৈদেশিক মুদ্রা নিষ্পত্তির চাহিদা বেড়েছে এবং আর্থিক খাতের বাইরে থাকা কোম্পানিগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা জমা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তবে কিছু রপ্তানিমুখী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, ইউয়ানের ধারাবাহিক শক্তিশালী অবস্থান তাদের কার্যক্রমে চাপ সৃষ্টি করছে। গুয়াংডং প্রদেশের এক আলোকসজ্জা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক তান জিয়ান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক ভিডিওতে বলেছেন, ইউয়ানের মূল্যবৃদ্ধি থামানো যাবে না, কিন্তু এতে কাঁচামাল কেনা, অর্ডারের দাম নির্ধারণ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে ছোট ও মাঝারি রপ্তানিকারকদের ঝুঁকি বাড়ছে।
বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক বদল
ডলার দুর্বল হওয়ার ফলে চীনের অনেক ব্যক্তি বিনিয়োগকারীও ডলার থেকে সরে এসে অন্যান্য সম্পদে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। গুয়াংজুর এক অনুবাদক ইউকি সু জানিয়েছেন, আগের দুই বছরে তিনি নিয়মিত ডলার বদল করলেও এ বছর তা বন্ধ করেছেন এবং সোনা ও রুপার তহবিলে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন।

দীর্ঘমেয়াদি মূল্যবৃদ্ধির পূর্বাভাস
অনেক অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকের মতে, ইউয়ান এখন দীর্ঘমেয়াদি মূল্যবৃদ্ধির এক ধাপে প্রবেশ করছে। ইয়িংদা সিকিউরিটিজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৬ এবং সম্ভাব্যভাবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত ইউয়ান ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে পারে এবং ডলারের বিপরীতে হার নেমে আসতে পারে ৬ দশমিক ২০ থেকে ৬ দশমিক ৩০-এর মধ্যে। প্রতিবেদনে চীনের শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি, দুই দেশের সুদের হারের ব্যবধান কমে আসা এবং ডলার সূচকের ওপর চাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চংকিংয়ের সাবেক মেয়র ও বর্তমানে জ্যেষ্ঠ সরকারি উপদেষ্টা হুয়াং ছিফানও বলেছেন, আগামী এক দশকে ইউয়ান ধীরে ধীরে ডলারের বিপরীতে প্রায় ৬-এর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















