কঠোর শুল্ক আরোপের মধ্যেও ইলেকট্রনিক পণ্য, পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যে ইতিবাচক চিত্র দেখা যাচ্ছে। এই প্রবৃদ্ধি চলমান বাণিজ্য আলোচনায় নয়াদিল্লিকে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, এই শক্তিশালী পরিসংখ্যানের আড়ালে কিছু কাঠামোগত দুর্বলতাও রয়েছে, যা উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতে চাপ তৈরি হতে পারে।

মার্কিন বাজারে রপ্তানির সাম্প্রতিক চিত্র
ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশের বেশি বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে রপ্তানি নেমে গিয়েছিল প্রায় ৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারে, যা ছিল ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক কার্যকরের পর প্রথম পূর্ণ মাস। এরপর অক্টোবরে রপ্তানি দাঁড়ায় প্রায় ৬ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার এবং নভেম্বরে তা বেড়ে হয় প্রায় ৬ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও অক্টোবরে বছরভিত্তিক হিসাবে রপ্তানি ৯ শতাংশ কমেছিল, নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির হারকেও ছাড়িয়ে যায়।
কোন পণ্যে ভর করে এই বৃদ্ধি
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্কমুক্ত বা তুলনামূলক কম প্রভাবিত পণ্যই এই প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি। স্মার্টফোন, ওষুধ এবং পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের রপ্তানি এতে বড় ভূমিকা রেখেছে। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, এই খাতগুলোই মূলত সাম্প্রতিক উত্থানকে ধরে রেখেছে।

দুর্বল ভিত্তি ও আগাম রপ্তানির প্রভাব
তবে এই বৃদ্ধিকে পুরোপুরি শক্তিশালী বলা যাচ্ছে না। কারণ ২০২৪ সালের নভেম্বরে রপ্তানি নেমে গিয়েছিল প্রায় ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের অনেক মাসের তুলনায় বেশ কম। ফলে চলতি বছরের নভেম্বরে প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি দেখাচ্ছে। পাশাপাশি পূর্ণমাত্রায় শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই অনেক প্রতিষ্ঠান আগাম পণ্য পাঠিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাদ্রাজ স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক এন আর ভানুমূর্তি জানান, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের হিসাব তিন মাস পর্যন্ত ধরে রাখার সুযোগ থাকায় কিছু রপ্তানি এখন রিপোর্ট হচ্ছে।
রুপির অবমূল্যায়ন ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি
রুপির অবমূল্যায়নও রপ্তানি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে রুপির মান প্রায় ৯০-এর কাছাকাছি, যেখানে বছরের শুরুতে ছিল ৮৫ দশমিক ৬৪। এতে শুল্কের আগের দামে ভারতীয় পণ্য তুলনামূলক সস্তা হয়েছে। তবে ভানুমূর্তির মতে, আমদানির খরচ বাড়তে থাকলে এই সুবিধা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নাও হতে পারে। সেই বাড়তি খরচ শেষ পর্যন্ত রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ওপরই চাপ সৃষ্টি করবে এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।

রপ্তানি বৈচিত্র্য ও অন্যান্য বাজার
এদিকে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্য বাজারেও রপ্তানি বাড়ছে। নভেম্বরে চীনে ভারতের রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়ে প্রায় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। সামগ্রিকভাবে গত দশ বছরের মধ্যে নভেম্বর মাসে ভারতের পণ্য রপ্তানি ছিল সর্বোচ্চ। এছাড়া ২০২৫ সালে নিউজিল্যান্ড, ওমান ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করেছে ভারত। এই বৈচিত্র্য ভবিষ্যতে কিছুটা সুরক্ষা দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের প্রকৃত প্রভাব সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার বর্তমান অবস্থা
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। শুরুতে শরৎকাল নাগাদ চুক্তির প্রথম ধাপ সম্পন্ন হওয়ার আশা থাকলেও পরিস্থিতি বদলে যায়। আগস্টের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে এবং পরে রাশিয়া থেকে তেল কেনার জেরে আরও ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হয়। ডিসেম্বরে ভারতের বাণিজ্য সচিব রাজেশ আগরওয়াল জানান, কাঠামোগত একটি সমঝোতার খুব কাছাকাছি দুই দেশ, তবে সময়সীমা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।

আলোচনায় ভারতের অবস্থান কতটা শক্ত
নভেম্বরের রপ্তানি পরিসংখ্যান ভারতের অবস্থান কিছুটা শক্ত করছে বলে মনে হলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে এর ফল নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের ওপর শুল্কজনিত মূল্যবৃদ্ধির চাপ কতটা পড়ছে তার ওপর। এখনো সে প্রভাব স্পষ্ট নয়। তবে ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে, যা অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জোরালো করতে পারে।
অগ্রাধিকার নির্ধারণের পরামর্শ
অজয় শ্রীবাস্তবের মতে, এই রপ্তানি তথ্য ভারতের অবস্থানকে দুর্বল নয়, বরং শক্তিশালী করছে। তবে আলোচনায় দাবি তোলার ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে এগোনো জরুরি। তাঁর মতে, প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত রাশিয়ার তেল কেনার সঙ্গে যুক্ত অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক দ্রুত প্রত্যাহার করানো। এতে রত্ন ও গয়না, বস্ত্র এবং চামড়াজাত পণ্যের মতো শ্রমনির্ভর খাতগুলো তাৎক্ষণিক স্বস্তি পাবে এবং আলোচনা আরও ভারসাম্যপূর্ণ হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















