বিশ্বের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চলতি বছর ডলারের অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। বছরের শেষ প্রান্তে এসে মার্কিন ডলার এমন এক পতনের মুখে, যা দুই হাজার সতেরোর পর সবচেয়ে খারাপ বার্ষিক পারফরম্যান্স হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। বিনিয়োগকারীদের বড় অংশের ধারণা, আগামী বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে সুদহার আরও কমানোর সুযোগ থাকবে, অথচ বিশ্বের বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পথে আর এগোতে আগ্রহী নয়। এই বৈপরীত্যই ডলারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
ডলারের দুর্বলতা কেন বাড়ছে
চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত তথ্য তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হলেও বাজারে সুদহার নিয়ে প্রত্যাশায় বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। বিনিয়োগকারীরা এখনো ধরে নিচ্ছেন, দুই হাজার ছাব্বিশ সালে আরও অন্তত দুই দফা সুদহার কমাতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রাস্ফীতি ধীরগতির হওয়ায় সেই সম্ভাবনা আরও জোরালো হচ্ছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
ডলারের সূচক ইতিমধ্যে আড়াই মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। পুরো বছরজুড়ে হিসাব করলে ডলারের দর প্রায় দশ শতাংশ কমে যেতে পারে, যা দুই হাজার সতেরোর পর সবচেয়ে বড় বার্ষিক পতন হবে। বছরের শেষ কয়েক দিনে আরও চাপ বাড়লে এই পতন দুই হাজার তিন সালের পর সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছাতে পারে।

রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণের প্রভাব
চলতি বছর ডলারের জন্য ছিল অস্থিরতায় ভরা। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি নিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বড় ধাক্কা দেয়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগও ডলারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে। এসব কারণে মার্কিন সম্পদে বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিধা বেড়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে মুদ্রাবাজারে।
ইউরো ও পাউন্ডের উত্থান
ডলারের বিপরীতে ইউরো ও ব্রিটিশ পাউন্ড শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ইউরোর দাম তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে এসেছে এবং চলতি বছরে এর মূল্যবৃদ্ধি প্রায় চৌদ্দ শতাংশের কাছাকাছি। এটি দুই হাজার তিন সালের পর ইউরোর সেরা বার্ষিক পারফরম্যান্স হতে পারে। ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার অপরিবর্তিত রেখে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি পূর্বাভাস বাড়িয়েছে, ফলে নিকট ভবিষ্যতে সুদহার কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
একইভাবে পাউন্ডও বছরের হিসাবে আট শতাংশের বেশি শক্তিশালী হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা ধারণা করছেন, আগামী বছরের প্রথমার্ধে ব্রিটেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্তত এক দফা সুদহার কমাতে পারে।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় মুদ্রার গতি
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মুদ্রাও শক্তিশালী হয়েছে। এই অঞ্চলে ভবিষ্যতে সুদহার বাড়তে পারে এমন প্রত্যাশা মুদ্রাগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে। অস্ট্রেলীয় মুদ্রা তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, আর নিউজিল্যান্ডের মুদ্রাও আড়াই মাসের শীর্ষে উঠেছে।

ইয়েন নিয়ে জাপানের সতর্কতা
বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে এখন সবচেয়ে বেশি নজর জাপানের মুদ্রার দিকে। ইয়েনের দরপতন ঠেকাতে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছে দেশটির সরকার। জাপানের অর্থমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, অতিরিক্ত অস্থিরতা মোকাবিলায় তাদের হাতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। এই মন্তব্যের পর ইয়েনের দরপতন কিছুটা থেমেছে। যদিও সম্প্রতি জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে, তবু বাজার প্রত্যাশার তুলনায় নীতিগত বার্তা ছিল কিছুটা নরম, যা ইয়েনকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেনি।
স্বর্ণের বিপরীতে মুদ্রার চাপ
চলতি বছরে অনেক মুদ্রাই মূল্যবান ধাতু স্বর্ণের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে। স্বর্ণের দাম নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে, ফলে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে মুদ্রার বদলে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছে। ইউরোপের ছোট দেশগুলোর কিছু মুদ্রা তুলনামূলক ভালো করলেও সামগ্রিকভাবে ডলারের আধিপত্য দুর্বল হওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট।
#ডলার #মুদ্রাবাজার #ইউরো #পাউন্ড #ইয়েন #বৈশ্বিকঅর্থনীতি #সুদহার #স্বর্ণ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















