ইউ. ইয়াকভলেভ
কোথায় আকাশের শুরু
ছেলেটাকে দেখি বৃষ্টির পর, রাস্তায়। হাঁটছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, ছাল ছড়ে যাওয়া হাঁটুতে রক্ত জমাট বেধেছে সীলমোহরের মতো। জীর্ণ চ্যাপটা স্যান্ডেল জোড়া দেখতে কাছিমের মতো। হাতে ওর একটা দড়ি, ধূসর রঙের একটা ন্যাকড়ার সঙ্গে তা বাঁধা। ভেজা অ্যাসফল্টের ওপর লোটাচ্ছিল ন্যাকড়াটা, বোঝা মুশকিল কোন কাজে ওটা লাগবে।
‘কী করবি এই ন্যাকড়াটা দিয়ে?’ জিজ্ঞেস করলাম ওর কাছে এসে। ‘ন্যাকড়া নয়,’ নিচু গলায় জবাব দিলে ছেলেটা, ‘এটা প্যারাশুট।’
এবার তাড়া করে দেখলাম ন্যাকড়াটা সত্যিই গম্বুজের মতো, দড়িটাও আসলে জড়ানো রশিগুচ্ছ। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম:
‘তা ওটা জলের মধ্যে টানছিস যে?’
‘এমনি…’ অস্পৃষ্টে বলে চোখ তুললে আমার দিকে।
বড়ো বড়ো কালচে তার মণি। নির্মল ঝলক তাতে, বৃষ্টির পর পাতায়, চালে, রাস্তায় যে ধরনেকাজটা দেখা যায়। শাদা অংশটা প্রায় দেখাই যায় না, চোখ ভরে কেবল মণিটা। আমায় চেয়ে চেয়ে দেখছে।
‘ছাদ থেকে ছেড়েছিলি বুঝি?’ ভেজা কাদা-ছিটকানো প্যারাশুটটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘উ’হ’, জানলা থেকে।’
‘আর ভার কী চাপিয়েছিলি?’
‘ভার?’ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে সে চাইলে আমার দিকে, ‘আমি নিজেই… ঝাঁপ দিয়েছি।’
‘প্যারাশুটটা যে তোর পক্ষে খুবই ছোটো।’
‘বড়ো আর পাব কোথায়?’ এবার ও এমন ঠাট্টার দৃষ্টিতে চাইলে আমার দিকে যেন আমি নিতান্তই অবোধ, ‘বিছানার চাদর দিয়ে বানালে পিট্টি খেতে হবে যে। আমি তো এই বালিশের ওয়াড়ের জন্যেই পিট্টি খেয়েছি…’
এবার নজরে পড়ল গম্বুজের ধারগুলোয় ভেজা ভেজা মিহি ফিতে। সত্যিই প্যারাশুটটা ওয়াড় দিয়ে তৈরি, এক সময় সেটা শাদাও ছিল। আমার সমালোচনার দৃষ্টিটা ধরা পড়ল ওর চোখে।
‘ছোটো প্যারাশুটেও ঝাঁপ দেওয়া যায়… শুধু আকাশ থাকা চাই,’ বললে ও নিজের প্যারাশুটটির সমর্থনে।
‘আকাশ?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘আমি যে নিচ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। সেখানে তো আর আকাশ নেই,’
ব্যাখ্যা দিলে সে।
‘আর পাঁচ তলায় আকাশ পাওয়া যাবে?’
‘এখনো… পাঁচ তলা থেকে ঝাঁপাই নি।’
জমাট, লালচে গালার মতো হাঁটুটার দিকে কটাক্ষে চাইতেই আমার গা ছম ছম করে উঠল, অতল গহ্বরের ধারে কি উচু সাঁকোর রেলিঙের কাছে দাঁড়ালে যেমন হয়। মাথায় হাত দিলাম আমি, দেখলাম বড়ো বড়ো গাঢ় মণিদুটো আমার দিকেই চেয়ে আছে।
‘তুমি কখনো প্যারাশুটে ঝাঁপ দাও নি?’ জিজ্ঞেস করলে সে এমনভাবে যেন ও-আমি সমান।
‘উ’হা’ আমিও উত্তর দিলাম সমানে-সমানে। আমার এই ছোটো সহচরের কাছে কেমন যেন লজ্জাই হল। আর ওর চোখে মান আমার যাতে পুরো খোয়া না যায়, তাই বললাম, ‘তোর মতো বয়সে ঝাঁপ দিয়েছি… ছাতা নিয়ে।’
‘আমিও ছাতা নিয়ে দেখেছি। বোদ্ধার মতো মাথা নাড়লে ছেলেটা, ‘উল্টে গেল।’ মনে পড়ল আমার ঝাঁপটার ভাগ্যেও তাই ঘটেছিল এবং আপন মনে খুশি হয়ে উঠলাম।
‘যা বলেছিস! আমায় আবার চাঁটিও খেতে হয়েছিল ছাতাটার জন্যে।’
‘চাঁটি তো সবকিছুর জন্যেই খেতে হয়,’ বলে স্যান্ডেলের খস-খস শব্দ তুললে ছেলেটা।
খানিকক্ষণ আমরা চললাম চুপচাপ। আমার ছোট্ট প্যারাশুটিস্টটির শ্রেষ্ঠত্ব টের পাচ্ছিলাম, ভাবতে লাগলাম সেটা ও পাচ্ছে কোথেকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যত অসংখ্য ভয় মানুষকে পেয়ে বসে তা থেকে ও মুক্ত বলেই কি? বোধ হয় পা চালিয়েছিলাম একটু বেশি তাড়াতাড়ি, কেননা পেছন থেকে শোনা গেল সেই পরিচিত নিচু গলা:
‘অত জোরে যেও না।’
‘কেন, পা ব্যথা করছে?’
‘না, স্যান্ডেল খুলে যাচ্ছে।’
ফিরে চাইলাম আমি। অ্যাসফল্টে দাঁড়িয়ে সে খুলে ফেলছে তার চ্যাপটা ভেজা স্যান্ডেলটা। ছেলেটার হাতে গিয়ে ওটাকে আরো বেশি দেখাল কাছিমের খোলার মতো।
‘পরে নে।’
‘এই বেশ ভালো,’ বলে দ্বিতীয় পাটিটাও সে খুলে নিলে।
ছোঁড়া ছোড়া শাঁর্ণ মেঘের ফাঁক দিয়ে উ’কি দিলে সূর্য’। রোদ উঠল কড়া, অ্যাসফল্টের ওপর ভেসে উঠল তপ্ত নীলাভ ভাপ। ভাপ-ওঠা তপ্ত অ্যাসফল্টের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটা নিশ্চয় খুব আরামের। কিন্তু আমার পায়ে জুতো। আমার ছোট্ট সহচর আগের মতোই টেনে চলেছে ওয়াড়ের প্যারাশুটটা।
‘কী করবি ভাবছিস?’ প্যারাশুটটার দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি।
‘আবার ঝাঁপাব… তবে আকাশে না হলে ওটায় কাজ দেয় না।’
‘কিন্তু কোথায় আকাশ পাওয়া যাবে?’
জবাব দিলে না সে। মাথা তুলে তাকালে ওপরে। গভীর নীল আকাশ। যেন স্রোত বইছে। ছোড়া ছোড়া মেঘ ভেসে যাচ্ছে তাতে। মেঘগুলো দেখতে লাল ছেলেটা, দৃষ্টি ওর বুলিয়ে নিলে উচু উঁচু পাইন গাছের ডগায়, ছাদের চুড়োয়। ক্রমাগত নিচে নামতে নামতে চোখ ওর থেমে গেল ছোট্ট প্যারাশুটটায়। নিচু হয়ে ছেলেটা তুলে নিলে কাদামাখা প্যারাশুটটা। মোচড়ালে সেটাকে, ঘোলাটে জল ঝরে পড়ল অ্যাসফল্টে। নিভড়ালে, যেভাবে লোকে নিগুড়ায় শার্ট কি ইজের। তারপর কাঁধে চাপালে। এতে বোঝা গেল যে সব এখনো খোয়া যায় নি, এখনো কাজ দেবে ওয়াড় দিয়ে বানানো প্যারাশুট।
আসি,’ বলে ও দ্রুত উল্টো পথ ধরলে।
‘ এমন একটা দুঢ় সংকল্প ফুটে উঠেছিল ওর ভাবভঙ্গিতে যে আমার দুশ্চিন্তাই হল: উচু কোনো ছাদে গিয়ে উঠবে না তো? যে-প্যারাশুট কাজ দেয় কেবল আকাশে সেটা আর একবার পরখ করার জন্যে সেখান থেকে লাফ দেবে না তো নিচে?
‘আরে দাঁড়া, দাঁড়া!’ চে’চিয়ে ডাকলাম আমি।
অনিচ্ছায় থামল ও।
‘যাচ্ছিস কোথায়?’
আমার গলার স্বরের উদ্বেগ ও টের পেয়েছিল, কিন্তু কেয়ার করলে নাঃ
‘সময় নেই আমার। ইগরক অপেক্ষা করছে।’
‘আর লাফ দিবি না তো… ছাদ থেকে?’
‘প্যারাশুট যে ভেজা।’
ও টের পেলে যে আমি ভয় পাচ্ছি। ওর মাথায় ঢোকে নি যে আমি ভয় পাচ্ছি ওর জন্যে। ও ধরে নিলে আমি স্রেফ ভীরু। বিদ্রূপে চোখের মণি কাঁচকে গিয়ে তা আরো জ্বল-জ্বল করে উঠল।
হঠাৎ টের পেয়ে গেলাম কোথা থেকে শুরু হয় আকাশ। ছাদের চুড়ো থেকে নয়, মেঘ-ভাসা নীল স্রোতটায় নয়। শুরুটা তার একেবারে মাটির কাছে, নিচ তলার জানলায় কিংবা কাঁধ-সমান উঁচু থেকে। নির্ভীক বুকের মধ্যে শুরু হয়ে তা প্রসারিত হয়ে যায় মেঘ কি নক্ষত্র পর্যন্ত, বুক তাকে যেখানে তুলে দেবে, সেখানে।
‘ইগরক বসে আছে। চলি, কেমন?’
অধীরভাবে ও হাঁটু চুলকালে, কনুই দিয়ে চেপে ধরল স্যান্ডেল জোড়া।
মাথা নাড়লাম আমি। শুকিয়ে-ওঠা ছোপ-ছোপ অ্যাসফল্টের ওপর দিয়ে পা চালাল সে, নীলাভ ভাপ উঠছে যেখানে। নীরবে তার পেছু নিলাম আমি, ভালো করে জেনে নেব কোথায় আকাশের শুরু।
Leave a Reply