০৪:১২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

রূপের ডালি খেলা (পর্ব-১০)

  • Sarakhon Report
  • ০৪:০০:১০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ জুলাই ২০২৪
  • 4

ইউ. ইয়াকভলেভ

আমার বোলতাটি

আমার গোলাঘরে বাসা নিয়েছে এক বোলতা। কাছ দিয়ে গেলেই কানে আসে গাঢ় ভন-ভন আর হালকা আওয়াজ। মনে হবে যেন বোলতাটা খুব আড্ডাবাজ, একদল ইয়ার-বোলতা নিয়ে ফুর্তি লুটছে। আসলে মোটেই কোনো ইয়ার-দল নেই। নেহাৎ গরম দিনটার পর বোলতা তার ছোট্ট ফ্যানটা খুলে দিয়ে বাড়িটায় হাওয়া খেলায়। আর তার ক্ষিপ্র-চলা পাখা থেকে ওঠে অবিরাম এক জমজমে গুঞ্জন:

দেখা গেল বোলতাটা খুবই মার্জিত রুচির বাসিন্দা: আমার পায়ের শব্দ শোনামাত্র সে তার ফ্যান বন্ধ করে দেয়, যাতে ওর শব্দে আমার অসুবিধা না হয়। ঘরে হাওয়া খেলাতে সে শুরু, করে কেবল আমি চলে যাবার পরে। সাধারণতই সে আমার চোখে না পড়ার চেষ্টা করে। তাই বোলতাটা দেখতে কেমন সেটা কল্পনা করার জন্যে আমায় স্মৃতি ঘাঁটতে হয়।

ছেলেবেলায় আমার এক বন্ধ ছিল ফেলিয়া। নানা ধরনের গুবরে, ফড়িং, ভোমরা সংগ্রহ করা ছিল তার শখ। বোলতাও ছিল তার সংগ্রহে। বড়ো একটা বিচির মতো দেখতে, বাঘের মতো ডোরাকাটা, ঢিপ-ঢিপ চোখ-ওয়ালা কালচে মাথা। বোতলের ছিপিতে ওটা গাঁথা ছিল পিন দিয়ে; তলে লেখা: ‘বোলতা মৌমাছি’। মাটিবাসী ওর বইয়ের ব্যাগটা খসিয়ে নিই। ফেলিয়া আমায় চিমটি কাটে। আমি তাকে তখন ফেলিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক’টা হয়ে দাঁড়ায় অদ্ভুত। একবার ইশকুলের করিডরে ধাক্কা দিই। ফেলিয়া গিয়ে ঠোকর খায় দেয়ালে আর আমায় দাঁড়াতে হয় মাস্টারদের ঘরে।

‘তুই মেরেছিস ওকে?’ জিজ্ঞেস করলেন ইতিহাসের শিক্ষিকা রিমা ইলিনিচনা, দেখতে ছোটোখাটো, তড়বড়ে।

আমি চুপ করে রইলাম।

‘তুই মেরেছিস ওকে?’ ফের জিজ্ঞেস করলেন, জোর দিলেন ‘মেরেছিস’

কথাটায়।

‘ধাক্কা দিয়েছি,’ অস্ফুটে বললাম আমি। ‘আর তুই জানিস যে ও রুগ্‌ণ?’

সেটা জানতাম না।

‘খেয়াল করিস নি কখনো যে ওর চোখের কোলে কালশিটে?’

আমি ভাবতাম নিশ্চয় কালি লেগে গেছে কেমন করে।

চেয়ার ক্যাঁচকে’চিয়ে উঠল। রিমা ইলিনিচনা উঠে দাঁড়ালেন।

‘এর ফল কী হতে পারে তা জানিস?’ আমার কাছে এসে চোখ বড়ো বড়ো করলেন তিনি, ‘যে-কোনো মুহূর্তে ও মারা যেতে পারে। তুই ধাক্কা দিলি, ও ওদিকে মরে গেল।’

দিশেহারা হয়ে উঠলাম আমি।

‘আমি শুধু একবার… ধাক্কা দিয়েছি।’

‘একবারেই যথেষ্ট।’

আমার একেবারে হয়ে এল। ভয় লাগল আমার। মনশ্চক্ষে ফেলিয়াকে দেখলাম… মরা। কফিনে। পরনে ইশকুলের উর্দি’। পায়ে নোংরা তোবড়ানো জুতো। পেটের ওপর বইয়ের ব্যাগ… করিডরে ফিরে প্রথমেই ছুটলাম ফেলিয়ার সন্ধানে। বে’চে আছে! জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সসেজের স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। ফাঁড়া কাটল।

ফেলিয়ার মুখখানা রোগা, লম্বাটে, লাল লাল কান। এমন কান যেন তৈরিই হয় কেবল চশমার আংটা ধারণের জন্যে। আর চশমায় তার মোটা-মোটা কাঁচ, তার ভেতর দিয়ে চোখ ঠাহরই হয় না। টলমল করে চোখ। পরিণত হয় দুটো ধূসর রঙের মাছে, ভেসে বেড়ায় যেন গোল-গোল অ্যাকুয়ারিয়মে। সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেই চক্ষু-রূপী মাছ কোথায় পালিয়ে যায়… এই ধরনের। চোখে জিনিসগুলো বড়ো দেখায় না, ছোট্ট হয়ে যায়। সবকিছু, বড়োই দেখায় ছোটো-ছোটো।

শিক্ষিকার সঙ্গে ওই আলাপটার পর থেকে আমি ফেলিয়াকে ভয় পেতাম। ভয় পেতাম যেন একটা চাঁনেমাটির ফুলদানি, এই বুঝি হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে চুর-চুর হয়ে যাবে। ফেলিয়াকে এড়িয়ে আমি দূরে থাকতাম যাতে দৈবাৎ ওর সঙ্গে ধাক্কা লেগে না যায়। ওভারকোট রাখার ঘরে যখন হুড়োহুড়ি বাধত, আমি তখন ওকে আড়াল করার চেষ্টা করতাম, বাঁচাতাম মৃত্যুর বিপদ থেকে।

ক্রমশ ক্লাসে ওর অবস্থা দাঁড়াল আলাদা রকমের। শরীরচর্চা থেকে ওর ছিল বরাবরের ছুটি, আমরা যখন লাফালাফি করতাম, বৈঠক দিতাম, মইয়ে চাপতাম, ও তখন ওভারকোট রাখার ঘরে বসে মোটা-মোটা বই পড়ত।

ওর ছিল সাতখুন মাপ। ইশকুল কামাই করলে কেউ জিজ্ঞেসও করত না, কেন। সাংঘাতিক অসুখটাই যে তার কারণ সেটা সবাই জানত।

হয়ত ব্ল‍্যাকবোর্ডে’র কাছে গিয়ে দাঁড়াবার ডাক পড়েছে ওর, অথচ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না।

‘জানিস না?’ চুপি-চুপি জিজ্ঞেস করেন শিক্ষয়িত্রী।

ও চুপ করে থাকে।

‘পড়া করিস নি?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার লম্বা-লম্বা সর্ আঙুলগুলো টান করে দাঁড়ায় ফেলিয়া।

ভাবখানা এমন যেন বলতে চাইছে: হ্যাঁ, পড়া করি নি, কেননা ওই রহস্যময় ব্যাধিটায় ভুগছি। অপরাধীর মতো চোখ নামিয়ে নেন শিক্ষয়িত্রী।

‘যাক গে, তাতে কী হয়েছে, পরের বার উত্তর দিস। যা, বস গে… অস্থির হস নে।’

ফেলিয়ার মুখে কিন্তু আনন্দ নেই। কষ্টই ফুটে উঠেছে সেখানে। চুপচাপ হয়ে যায় গোটা ক্লাস।

মাঝে মাঝে ক্লাসে বসে থাকতে বিরক্ত ধরে যেত ফেলিয়ার। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলত:

‘রিমা ইলিনিচনা, আজ্ঞা করুন আমি আজ যাই। হেলমিন্টোলজিস্ট ডাক্তার দেখানোর কথা আছে।’

শোকাভিভূত দৃষ্টিতে রিমা ইলিনিচনা ফেলিয়ার দিকে চেয়ে বলতেন: ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। তুই যেতে পারিস।’

বইয়ের ব্যাগ নিয়ে শিথিল ভঙ্গিতে সে বেরিয়ে যেত দরজা দিয়ে আর উৎকণ্ঠিত হয়ে আমি চেয়ে থাকতাম সেদিকে, যেন এক মহাকীর্তিতে তাকে এগিয়ে দিচ্ছি।

আমার গোলাঘরে বোলতাটা বাসা নিলে বটে, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারতাম না ঠিক কোথায় ও থাকে। পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকতাম যাতে বোলতাটি আর তার পুত্রপরিজন আমার আগমন টের না পায়। চুপ করে ধরতে চাইতাম কোথেকে আসছে ওই গাঢ় গুঞ্জনটা। পরখ করে দেখলাম দেয়ালগুলো। মাটির মেঝে তল্লাস করলাম। আর ক্ষান্তিহীন ‘জ’ অক্ষরটা ধধ্বনিত হয়েই চলল কখনো জোরে, কখনো আন্তে, যেন আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে বোলতা।

একদিন গোলাঘরে এসে পকেট থেকে চাবিটা বার করছি, এমন সময় তালার ফুটো থেকে বেরিয়ে এল বোলতাটা। রঙটা ওর খয়েরী-হলুদ, তাতে কালো কালো ডোরা। আমায় দেখে সে ভয় পেলে না। খুবই সুস্থির হয়েই রইল। আমি ওকে দেখতে লাগলাম, সেও দেখতে লাগল আমায়।

সত্যিই ওটা ফেলিয়ার সংগ্রহের বোলতাটার মতোই দেখাত। ভেসে গেলাম আমি দূর অতীতে, মনে পড়ল ইশকুলের করিডরে পায়চারি করতে করতে অবিরাম আওড়ে যেতাম:

বোলতার রূপে রাজ-নন্দন পাক দিয়ে উড়ে গেল বন-বন।

পুশকিনের লেখা রূপকথাটার এই ছত্রদুটো সারাক্ষণ লেগে থাকত আমার জিবের ডগায়, আর চোখের সামনে ভেসে উঠত মস্তো এক ক্রুদ্ধ বোলতার ছবি, আসলে যে হল যুবরাজ গাভিদন। বোলতা-রূপী গুভিদন তাড়া করে বেড়াচ্ছে বাবারিখা বুড়িকে, আর ক্ষীণদৃষ্টি ফেলিয়া কিনা তাকে ভালো করে নজর না করেই ভাবল বুঝি সাধারণ একটা বোলতা, পিন দিয়ে গে’থে রাখল ছিপিতে।

‘কেন ওকে মারলি?’ সখেদে তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম ফেলিয়াকে। ‘আমি এই জিনিসটা ঢেলে দিয়েছিলাম, তাতে ব্যথা লাগে না…’ কৈফিয়ৎ দিলে ফেলিয়া; কী একটা বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ-ছাড়া তরল পদার্থ দিলে শুঁকতে, কীটপতঙ্গের ওপর ওই জিনিসটা ঢালে সে।

আজো পর্যন্ত গন্ধটা বেশ মনে আছে।

যাই হোক, আমার বর্তমানের বোলতাটি তালার ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এসে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। পরিচয় হল আমাদের। এবার পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা। ফেল্ট-ভরা গরম দোপাট্টা দরজার ভেতর বাসা পেতেছে সে। খড়খড়ে তক্তার ওপর কান রাখলাম গুঞ্জন উঠছে দরজা থেকে। এই কর্কশ পালিশ-না-করা দরজাটা নিজের কামরায় নিয়ে গেলে বেশ হত! খাসা একটি বোলতা আর তার ছেলেপুলেদের সঙ্গে দিন কাটানো ভারি ভালো জিনিস। হয়ত মানুষের মধ্যে মিথ্যেটা ধরতে পারা আর তার চোখের তলে ধিক্কার চিহ্নের রামধনু দেগে দিতে পারার আশ্চর্য ক্ষমতা ধরে সব বোলতাই?

এক সময় অমনি একটি বিশ্বস্ত বোলতার খুবই প্রয়োজন ছিল আমার। লিজাকে যেদিন চুমু খাই, সেদিন সে ছিল অপরিহার্য। জীবনে সেই প্রথম বার। জানি না ওটাকে আদৌ চুমু বলা চলে কিনা। শুধু তার তপ্ত, আশ্চর্য’ রকমের সোহাগভরা গালে ঠোঁট ঠেকিয়েছিলাম…

ভেবেছিলাম আমায় ঠেলে সরিয়ে দেবে নয়ত কড়া কড়া কথা শোনাবে। কিন্তু সরিয়ে দিল না আমায়। শুধু মাথা নুইয়ে কেবল ঠোঁট নেড়ে বললে: ‘কী দরকার?’

আনন্দের বন্যায় আমার বাক-লোপ হয়েছিল। ফুলে ফে’পে কূল ছাপিয়ে উঠল আনন্দ। হয়ত গোটা বিশ্বই ভরে উঠতে পারত তাতে, তবে আমিই ছিলাম তার একমাত্র ধারক, তাই আনন্দে ফেটে পড়ছিলাম। শুধু ভাবনা হচ্ছিল কিছুই যেন না বদলায়, সময় যেন ফিরে না যায়, যেন না দাঁড়ায় যে আমি লিজাকে কখনো চুমুই খাই নি।

সবই যাতে না বদলিয়ে থাকে, তাই তাড়াতাড়ি চলে গেলাম।

আত্মহারার মতো চললাম রাস্তা দিয়ে। লাফাচ্ছিলাম এক ঠ্যাঙে। একবার হাতে ভর দিয়ে ডিগবাজিও খেয়ে নিলাম। এই সময় দেখা হল ফেলিয়ার সঙ্গে। সে সময় সে বড়ো হয়ে উঠেছে, ভালো পড়ুয়া ছেলে বলে নাম ছড়িয়েছে, নিজের প্রাধান্য জাহির করতেও কখনো ভুলত না। কিন্তু রাস্তায় যখন তার সঙ্গে দেখা হল, তখন ওতে কিছু এসে যায় না। ওকে পেয়ে আমি এমনই খুশি হয়ে উঠেছিলাম যে ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে:

‘তোর হয়েছেটা কী? মদ খেয়েছিস নাকি?’

একেবারে খাঁটি মরদের মতো আলাপ, আর মদ কখনো চেখে না দেখলেও আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল:

‘আরে হ্যাঁ, হয়ে গেল রে… বন্ধুবান্ধবে মিলে এক পাত্র করে টানলাম।’ বিস্ময়ে লম্বা হয়ে গেল ফেলিয়ার মুখ আর ‘যে-কোনো মুহূর্তে সে যে মারা

যেতে পারে’ তা ভুলে আমি তার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগলাম।

‘ঝাঁকানি থামা তো!’ রেগে, নাকের ডগায় নেমে-আসা চশমাটা ঠিক করে ফেলিয়া বললে, ‘হলটা কী?’

খুশির হাতুড়ি পিটছিল আমার মাথায়। ফেলিয়ার কাছ ঘে’ষে এসে তাকালাম তার চশমায়।

‘দিব্যি দিয়ে বল, কাউকে বলবি না,’ বললাম গোপনীয়তার সুর ফুটিয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই দিব্যি দিতে রাজী হয়ে গেল ফেলিয়া। বললে:

‘বেশ, বল তোর গোপন কথা।’

বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল সে, লম্বা লম্বা আঙুলে হুশ-চিহ্ন দিলে পেটে।

‘কসম খা!’ জেদ ধরলাম আমি।

‘বেশ, কসম!’

ওর কনুই ধরে আস্তে করে বললাম:

‘জানিস চুমু ওকে।’

মুয়েলস ফেলিয়া, চুমু খেয়েছি কপিল না। ভাবলাম, ফেলিয়া আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারে নি, তাই আমার হাতে ঝাঁকুনি না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

বললাম:

‘লিজাকে আমি ভালোবাসি রে ফেলিয়া, লিজাও আমায় ভালোবাসে। আমাদের মধ্যে প্রেম হয়েছে।’

ঐন্দ্রজালিক এই কথাটি বলে চাইলাম ফেলিয়ার দিকে। ঠিক করলাম, আনন্দে ও যে চে’চিয়ে উঠল না তার কারণ একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। মনে হল, দুনিয়ায় ওর মতো ভালো লোক আর হয় না। চে’চিয়ে উঠলাম:

‘ফেলিয়া, তুই এখন থেকে আমার সেরা বন্ধ! তোকেও আমি ভালোবাসি।’ এই সময় থেকে ফেলিয়া শুধু ফেলিয়া নয়, হয়ে উঠল আমার অমূল্য রহস্যের রক্ষাপাত্র।

ওহ, বিজ্ঞ একটা বোলতার কী অভাবেই না সেদিন আমায় ভুগতে হয়েছিল, এমন বোলতা যে লোকের মিথ্যেটা ধরতে পারে, কথায় বিষ ঝরাতে দেয় না, অস্পৃশ্য দুরাত্মাদের নীল চোখের নিচে দেগে দিতে পারে তার ক্ষমাহীন রায়। সে সময় যদি ফেলিয়ার চশমার ভেতর থেকে চোখে পড়ত বোলতার রায় লালচে-সবজে- বেগুনী ধনুক, তাহলে মুখ খুলতাম না। রহস্য রক্ষার অন্য পাত্র খাঁজে নিতাম। আরো বিশ্বস্ত।

পরের দিন লিজা নীরবে চলে গেল আমার পাশ দিয়ে।

‘লিজা, নমস্কার! লিজা…’

গতি বাড়াল লিজা। আনন্দ আমার দ্রুত কমতে লাগল। কেমন যেন ককেড়ে গেল, মিইয়ে গেল।

এগিয়ে গিয়ে লিজার সঙ্গ ধরলাম। হাত টেনে নিলাম তার। ও হাত ছাড়িয়ে কেমন বিজাতীয় গলায় বললে:

‘জানতাম না তুমি অমন একটা তুচ্ছ বড়াইবাগীশ। তোমায় আমি বিশ্বাস করেছিলাম, আর তুমি দেখছি একেবারে উচ্ছা।”

‘লিজা, কী বলছ?!”

‘যা বলছি, জেনে শুনেই বলছি। খুবই গুখোরি করেছি। বড়াই করার লোক পেয়েছেন ভালো ফেলিয়া!’

নিবে গেল আলো। উলটে গেল দুনিয়া। ঠিক করলাম, ফেলিয়াকে খুন করব। ভুলে গেলাম ও রুগ্‌ণ, অসুস্থ, শরীরচর্চা ওর মানা। করিডরে ওকে পাকড়াও করে জামা ধরে ঠেসে ধরলাম দেয়ালের সঙ্গে। গোল অ্যাকুয়ারিয়মে হুটোপুটি করছে দুটি ছেয়ে রঙের মাছ। আমার দৃষ্টি থেকে তারা পিছলে যাচ্ছে।

ও-ই কথা বললে প্রথম:

‘তুই কী চাস, বল তো? আমি তো সত্যি কথাই বলেছি।’

ওর কথায় থ মেরে গেলাম।

‘সত্যি মানে?!’

‘কেন, সত্যি নয়? তুই যা বলেছিলি তাই বলেছি। নাকি চাস যে মিথ্যা বলব?’ প্রাণপণে ঠেসে ধরেছিলাম ফেলিয়াকে, ওর জামাটা পর্যন্ত ছি’ড়ে গেল, তাহলেও আমার হাত থেকে খসে যাচ্ছিল সে।

‘তুই যে কসম খেয়েছিলি কাউকে ফাঁস করবি না!’ মরিয়ার মতো চে’চালাম আমি, টের পাচ্ছিলাম মুঠো আমার আলগা হয়ে আসছে, ফেলিয়াকে ধরে রাখতে

পারছি না।

ওর কাছে তো এটা গোপন নয়।’

‘ আমার হাত ছাড়িয়ে নিলে ও। দেবদূতের মতো ও অকলঙ্ক, আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম থুতু-খাওয়া, কাদামাখা। নিরস্ত্র, পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কিছুই করার নেই আমার। ফেলিয়ার দিকে সশঙ্কে তাকিয়ে আমি চলে গেলাম।

বোলতার উপকারিতা নিয়ে লোকে ভাবে কত কম। প্রক্ষেপই করে না, নয়ত তাড়িয়ে দেয়, যেন কারিতা নিয়ে চলোকের বিপদ সম্পকে হংশিয়ারি দেবার জন্যে বোলতার খুবই দরকার।

বহু, বছর পরে আমার ফের দেখা হয় ফেলিয়ার সঙ্গে। বুদ্ধিমান, গুরুত্বমনা লোকেদের যাতায়াত কামনাকোর করিডর দিয়ে, ভাগ্যক্রমে সেখানেই। বদলে গেছে ফেলিয়া। নেই আর সেই রুগ্‌ণ মুখ, চোখের নিচে কালি। হয়ে উঠেছে নিটোল, চিকন, চোপমানেয়ার সেই রে উঠেছে চর্বিতে। যে কাঁধে আগে সবকিছুই ঢল-ঢল করত, তা হয়ে উঠেছে গোলালো, শার্ট কোটের পক্ষে যুতসই। আর সাইকেলের পাম্প দিয়ে পাম্প করার মতো ফোলানো পেটটিতে তার চেহারায় লেগেছে বেশ একটা কায়েমী পাট্টার ভাব। লোকেও তাকে ডাকে এখন ফেলিয়া বলে নয়, ফেলিক্স। দাঁড়িয়েছিল আমার দিকে একপেশে হয়ে, দেখতে পাচ্ছিলাম শুধু তার একটা চোখ। পিছলে যাওয়া ছাইরঙের মাছটা ভাসছিল গোল অ্যাকুয়ারিয়মে। বাঁকাভাবে ছাঁটা পাঁশুটে চুলের ঝাটি এসে পড়ছিল কপালে, ধাঁরে সুস্থে তা কায়দা করে ফের যথাস্থানে সরিয়ে দিচ্ছিল সে।

ভেবেছিলাম পাশ কাটিয়ে যাব, কিন্তু আমায় দেখে সে হাত বাড়িয়ে দিলে, আর মহানন্দে আমি দেখলাম তার দ্বিতীয় চোখটি ফুলে উঠেছে, চারপাশে তার ভারি চমৎকার এক রামধনু।

‘কোথায় এটি জোটালি?’ জিজ্ঞেস করলাম ফেলিয়াকে, টের পাচ্ছিলাম হাসতে শুরু করেছি।

‘মানে, শহরের বাইরে গিয়েছিলাম আর কি… নেমন্তন্ন ছিল। সেখানে একটা বোলতা… দিলে কামড়ে,’ বিব্রতের মতো বলে ফেলিয়াও হাসতে শুরু করলে। ওর হাসিটা শোনাল কাসির মতো।

মনে হল, ‘আচ্ছা! স্পষ্টবক্তা বোলতার অভাব তাহলে এখনো হয় নি। আমার ফেলিয়াটিকে বোলতা ঠিকই চিনতে পেরেছে দেখছি।’

হাসা আমার উচিত নয়, কিন্তু কিছুতেই পারলাম না, আকর্ণবিস্তৃত চাপা

হাসিতে আমার ঠোঁটের কোণে ব্যথা করে উঠল।

‘হাস্যকর ব্যাপার, তাই না?’ তেতো মুখে জিজ্ঞেস করলে ফেলিক্স।

‘আরে না,’ বললাম জোর দিয়ে, ‘তুই বুঝতে পারছিস না কী চমৎকার হয়েছে। কী আশ্চর্য রঙ, কী সুক্ষর ঝিলিমিলি! একেবারে ওস্তাদের কাজ।’

হাসি বন্ধ হয়ে গেল ফেলিয়ার। লম্বা হয়ে গেল মুখখানা:

‘কী বলতে চাইছিস তুই?’

‘আরে না, কিছু না। দেখা যাচ্ছে, খুবই বুদ্ধিমান বোলতা। তুই মেরেছিস

ওটাকে ?’

‘তাতে আর লাভ কী?’

বুঝলাম, ফেলিয়া ওটাকে মারে নি। বললাম:

‘জানিস, আমার একটা বোলতা আছে। থাকে গোলাঘরে। দরজার ফোকরে। ঢোকে তালার ফুটো দিয়ে….

এমনি লাল হয়ে উঠল ফেলিয়া যে তার জলজ্বলে রামধনুটাও লান দেখাল, কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল সে। আমি কিন্তু তখনো কেবল মন খুলে আনন্দে হেসে যাচ্ছি।

‘কাঁ ব্যাপার গো, এত খুশি যে?’ জিজ্ঞেস করলে নীল ওভার-অল পরা এক বুড়ি, ‘লটারিতে মোটরগাড়ি পেয়েছ বুঝি?’

বললাম, ‘উ’হ’, আরো বেশি, লড়াইয়ে জিতেছি।’

সভয়ে আমার দিকে চেয়ে বুড়ি জুতো খসখসিয়ে চলে গেল করিডর দিয়ে।

সন্ধ্যায় এলাম গোলাঘরে চুপি-চুপি, আমার ডানা-ওয়ালা বাসিন্দারা যাতে ভয় না পায়। দরজায় কান পেতে শুনতে লাগলাম। অবিরাম খুশির গুঞ্জন আসছিল সেখান থেকে। মনে হচ্ছিল যেন খুব জমজমাট একটা আলাপ। নিশ্চয় আমার পরিচিত বোলতাটি বলছিল কেমন নিখুঁতভাবে সে হল ফুটিয়েছে ফেলিয়ার চোখে। অন্য বোলতারা তার এই কীর্তি আলোচনা করে খুবই তারিফ করছে, যা প্রকাশ পাচ্ছে শুধু একটানা বোঁ-বোঁ করা একটা অক্ষরে….জজজ-জজজ-জজজ……

রূপের ডালি খেলা (পর্ব-১০)

০৪:০০:১০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ জুলাই ২০২৪

ইউ. ইয়াকভলেভ

আমার বোলতাটি

আমার গোলাঘরে বাসা নিয়েছে এক বোলতা। কাছ দিয়ে গেলেই কানে আসে গাঢ় ভন-ভন আর হালকা আওয়াজ। মনে হবে যেন বোলতাটা খুব আড্ডাবাজ, একদল ইয়ার-বোলতা নিয়ে ফুর্তি লুটছে। আসলে মোটেই কোনো ইয়ার-দল নেই। নেহাৎ গরম দিনটার পর বোলতা তার ছোট্ট ফ্যানটা খুলে দিয়ে বাড়িটায় হাওয়া খেলায়। আর তার ক্ষিপ্র-চলা পাখা থেকে ওঠে অবিরাম এক জমজমে গুঞ্জন:

দেখা গেল বোলতাটা খুবই মার্জিত রুচির বাসিন্দা: আমার পায়ের শব্দ শোনামাত্র সে তার ফ্যান বন্ধ করে দেয়, যাতে ওর শব্দে আমার অসুবিধা না হয়। ঘরে হাওয়া খেলাতে সে শুরু, করে কেবল আমি চলে যাবার পরে। সাধারণতই সে আমার চোখে না পড়ার চেষ্টা করে। তাই বোলতাটা দেখতে কেমন সেটা কল্পনা করার জন্যে আমায় স্মৃতি ঘাঁটতে হয়।

ছেলেবেলায় আমার এক বন্ধ ছিল ফেলিয়া। নানা ধরনের গুবরে, ফড়িং, ভোমরা সংগ্রহ করা ছিল তার শখ। বোলতাও ছিল তার সংগ্রহে। বড়ো একটা বিচির মতো দেখতে, বাঘের মতো ডোরাকাটা, ঢিপ-ঢিপ চোখ-ওয়ালা কালচে মাথা। বোতলের ছিপিতে ওটা গাঁথা ছিল পিন দিয়ে; তলে লেখা: ‘বোলতা মৌমাছি’। মাটিবাসী ওর বইয়ের ব্যাগটা খসিয়ে নিই। ফেলিয়া আমায় চিমটি কাটে। আমি তাকে তখন ফেলিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক’টা হয়ে দাঁড়ায় অদ্ভুত। একবার ইশকুলের করিডরে ধাক্কা দিই। ফেলিয়া গিয়ে ঠোকর খায় দেয়ালে আর আমায় দাঁড়াতে হয় মাস্টারদের ঘরে।

‘তুই মেরেছিস ওকে?’ জিজ্ঞেস করলেন ইতিহাসের শিক্ষিকা রিমা ইলিনিচনা, দেখতে ছোটোখাটো, তড়বড়ে।

আমি চুপ করে রইলাম।

‘তুই মেরেছিস ওকে?’ ফের জিজ্ঞেস করলেন, জোর দিলেন ‘মেরেছিস’

কথাটায়।

‘ধাক্কা দিয়েছি,’ অস্ফুটে বললাম আমি। ‘আর তুই জানিস যে ও রুগ্‌ণ?’

সেটা জানতাম না।

‘খেয়াল করিস নি কখনো যে ওর চোখের কোলে কালশিটে?’

আমি ভাবতাম নিশ্চয় কালি লেগে গেছে কেমন করে।

চেয়ার ক্যাঁচকে’চিয়ে উঠল। রিমা ইলিনিচনা উঠে দাঁড়ালেন।

‘এর ফল কী হতে পারে তা জানিস?’ আমার কাছে এসে চোখ বড়ো বড়ো করলেন তিনি, ‘যে-কোনো মুহূর্তে ও মারা যেতে পারে। তুই ধাক্কা দিলি, ও ওদিকে মরে গেল।’

দিশেহারা হয়ে উঠলাম আমি।

‘আমি শুধু একবার… ধাক্কা দিয়েছি।’

‘একবারেই যথেষ্ট।’

আমার একেবারে হয়ে এল। ভয় লাগল আমার। মনশ্চক্ষে ফেলিয়াকে দেখলাম… মরা। কফিনে। পরনে ইশকুলের উর্দি’। পায়ে নোংরা তোবড়ানো জুতো। পেটের ওপর বইয়ের ব্যাগ… করিডরে ফিরে প্রথমেই ছুটলাম ফেলিয়ার সন্ধানে। বে’চে আছে! জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সসেজের স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। ফাঁড়া কাটল।

ফেলিয়ার মুখখানা রোগা, লম্বাটে, লাল লাল কান। এমন কান যেন তৈরিই হয় কেবল চশমার আংটা ধারণের জন্যে। আর চশমায় তার মোটা-মোটা কাঁচ, তার ভেতর দিয়ে চোখ ঠাহরই হয় না। টলমল করে চোখ। পরিণত হয় দুটো ধূসর রঙের মাছে, ভেসে বেড়ায় যেন গোল-গোল অ্যাকুয়ারিয়মে। সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেই চক্ষু-রূপী মাছ কোথায় পালিয়ে যায়… এই ধরনের। চোখে জিনিসগুলো বড়ো দেখায় না, ছোট্ট হয়ে যায়। সবকিছু, বড়োই দেখায় ছোটো-ছোটো।

শিক্ষিকার সঙ্গে ওই আলাপটার পর থেকে আমি ফেলিয়াকে ভয় পেতাম। ভয় পেতাম যেন একটা চাঁনেমাটির ফুলদানি, এই বুঝি হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে চুর-চুর হয়ে যাবে। ফেলিয়াকে এড়িয়ে আমি দূরে থাকতাম যাতে দৈবাৎ ওর সঙ্গে ধাক্কা লেগে না যায়। ওভারকোট রাখার ঘরে যখন হুড়োহুড়ি বাধত, আমি তখন ওকে আড়াল করার চেষ্টা করতাম, বাঁচাতাম মৃত্যুর বিপদ থেকে।

ক্রমশ ক্লাসে ওর অবস্থা দাঁড়াল আলাদা রকমের। শরীরচর্চা থেকে ওর ছিল বরাবরের ছুটি, আমরা যখন লাফালাফি করতাম, বৈঠক দিতাম, মইয়ে চাপতাম, ও তখন ওভারকোট রাখার ঘরে বসে মোটা-মোটা বই পড়ত।

ওর ছিল সাতখুন মাপ। ইশকুল কামাই করলে কেউ জিজ্ঞেসও করত না, কেন। সাংঘাতিক অসুখটাই যে তার কারণ সেটা সবাই জানত।

হয়ত ব্ল‍্যাকবোর্ডে’র কাছে গিয়ে দাঁড়াবার ডাক পড়েছে ওর, অথচ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না।

‘জানিস না?’ চুপি-চুপি জিজ্ঞেস করেন শিক্ষয়িত্রী।

ও চুপ করে থাকে।

‘পড়া করিস নি?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার লম্বা-লম্বা সর্ আঙুলগুলো টান করে দাঁড়ায় ফেলিয়া।

ভাবখানা এমন যেন বলতে চাইছে: হ্যাঁ, পড়া করি নি, কেননা ওই রহস্যময় ব্যাধিটায় ভুগছি। অপরাধীর মতো চোখ নামিয়ে নেন শিক্ষয়িত্রী।

‘যাক গে, তাতে কী হয়েছে, পরের বার উত্তর দিস। যা, বস গে… অস্থির হস নে।’

ফেলিয়ার মুখে কিন্তু আনন্দ নেই। কষ্টই ফুটে উঠেছে সেখানে। চুপচাপ হয়ে যায় গোটা ক্লাস।

মাঝে মাঝে ক্লাসে বসে থাকতে বিরক্ত ধরে যেত ফেলিয়ার। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলত:

‘রিমা ইলিনিচনা, আজ্ঞা করুন আমি আজ যাই। হেলমিন্টোলজিস্ট ডাক্তার দেখানোর কথা আছে।’

শোকাভিভূত দৃষ্টিতে রিমা ইলিনিচনা ফেলিয়ার দিকে চেয়ে বলতেন: ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। তুই যেতে পারিস।’

বইয়ের ব্যাগ নিয়ে শিথিল ভঙ্গিতে সে বেরিয়ে যেত দরজা দিয়ে আর উৎকণ্ঠিত হয়ে আমি চেয়ে থাকতাম সেদিকে, যেন এক মহাকীর্তিতে তাকে এগিয়ে দিচ্ছি।

আমার গোলাঘরে বোলতাটা বাসা নিলে বটে, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারতাম না ঠিক কোথায় ও থাকে। পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকতাম যাতে বোলতাটি আর তার পুত্রপরিজন আমার আগমন টের না পায়। চুপ করে ধরতে চাইতাম কোথেকে আসছে ওই গাঢ় গুঞ্জনটা। পরখ করে দেখলাম দেয়ালগুলো। মাটির মেঝে তল্লাস করলাম। আর ক্ষান্তিহীন ‘জ’ অক্ষরটা ধধ্বনিত হয়েই চলল কখনো জোরে, কখনো আন্তে, যেন আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে বোলতা।

একদিন গোলাঘরে এসে পকেট থেকে চাবিটা বার করছি, এমন সময় তালার ফুটো থেকে বেরিয়ে এল বোলতাটা। রঙটা ওর খয়েরী-হলুদ, তাতে কালো কালো ডোরা। আমায় দেখে সে ভয় পেলে না। খুবই সুস্থির হয়েই রইল। আমি ওকে দেখতে লাগলাম, সেও দেখতে লাগল আমায়।

সত্যিই ওটা ফেলিয়ার সংগ্রহের বোলতাটার মতোই দেখাত। ভেসে গেলাম আমি দূর অতীতে, মনে পড়ল ইশকুলের করিডরে পায়চারি করতে করতে অবিরাম আওড়ে যেতাম:

বোলতার রূপে রাজ-নন্দন পাক দিয়ে উড়ে গেল বন-বন।

পুশকিনের লেখা রূপকথাটার এই ছত্রদুটো সারাক্ষণ লেগে থাকত আমার জিবের ডগায়, আর চোখের সামনে ভেসে উঠত মস্তো এক ক্রুদ্ধ বোলতার ছবি, আসলে যে হল যুবরাজ গাভিদন। বোলতা-রূপী গুভিদন তাড়া করে বেড়াচ্ছে বাবারিখা বুড়িকে, আর ক্ষীণদৃষ্টি ফেলিয়া কিনা তাকে ভালো করে নজর না করেই ভাবল বুঝি সাধারণ একটা বোলতা, পিন দিয়ে গে’থে রাখল ছিপিতে।

‘কেন ওকে মারলি?’ সখেদে তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম ফেলিয়াকে। ‘আমি এই জিনিসটা ঢেলে দিয়েছিলাম, তাতে ব্যথা লাগে না…’ কৈফিয়ৎ দিলে ফেলিয়া; কী একটা বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ-ছাড়া তরল পদার্থ দিলে শুঁকতে, কীটপতঙ্গের ওপর ওই জিনিসটা ঢালে সে।

আজো পর্যন্ত গন্ধটা বেশ মনে আছে।

যাই হোক, আমার বর্তমানের বোলতাটি তালার ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এসে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। পরিচয় হল আমাদের। এবার পরিষ্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা। ফেল্ট-ভরা গরম দোপাট্টা দরজার ভেতর বাসা পেতেছে সে। খড়খড়ে তক্তার ওপর কান রাখলাম গুঞ্জন উঠছে দরজা থেকে। এই কর্কশ পালিশ-না-করা দরজাটা নিজের কামরায় নিয়ে গেলে বেশ হত! খাসা একটি বোলতা আর তার ছেলেপুলেদের সঙ্গে দিন কাটানো ভারি ভালো জিনিস। হয়ত মানুষের মধ্যে মিথ্যেটা ধরতে পারা আর তার চোখের তলে ধিক্কার চিহ্নের রামধনু দেগে দিতে পারার আশ্চর্য ক্ষমতা ধরে সব বোলতাই?

এক সময় অমনি একটি বিশ্বস্ত বোলতার খুবই প্রয়োজন ছিল আমার। লিজাকে যেদিন চুমু খাই, সেদিন সে ছিল অপরিহার্য। জীবনে সেই প্রথম বার। জানি না ওটাকে আদৌ চুমু বলা চলে কিনা। শুধু তার তপ্ত, আশ্চর্য’ রকমের সোহাগভরা গালে ঠোঁট ঠেকিয়েছিলাম…

ভেবেছিলাম আমায় ঠেলে সরিয়ে দেবে নয়ত কড়া কড়া কথা শোনাবে। কিন্তু সরিয়ে দিল না আমায়। শুধু মাথা নুইয়ে কেবল ঠোঁট নেড়ে বললে: ‘কী দরকার?’

আনন্দের বন্যায় আমার বাক-লোপ হয়েছিল। ফুলে ফে’পে কূল ছাপিয়ে উঠল আনন্দ। হয়ত গোটা বিশ্বই ভরে উঠতে পারত তাতে, তবে আমিই ছিলাম তার একমাত্র ধারক, তাই আনন্দে ফেটে পড়ছিলাম। শুধু ভাবনা হচ্ছিল কিছুই যেন না বদলায়, সময় যেন ফিরে না যায়, যেন না দাঁড়ায় যে আমি লিজাকে কখনো চুমুই খাই নি।

সবই যাতে না বদলিয়ে থাকে, তাই তাড়াতাড়ি চলে গেলাম।

আত্মহারার মতো চললাম রাস্তা দিয়ে। লাফাচ্ছিলাম এক ঠ্যাঙে। একবার হাতে ভর দিয়ে ডিগবাজিও খেয়ে নিলাম। এই সময় দেখা হল ফেলিয়ার সঙ্গে। সে সময় সে বড়ো হয়ে উঠেছে, ভালো পড়ুয়া ছেলে বলে নাম ছড়িয়েছে, নিজের প্রাধান্য জাহির করতেও কখনো ভুলত না। কিন্তু রাস্তায় যখন তার সঙ্গে দেখা হল, তখন ওতে কিছু এসে যায় না। ওকে পেয়ে আমি এমনই খুশি হয়ে উঠেছিলাম যে ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে:

‘তোর হয়েছেটা কী? মদ খেয়েছিস নাকি?’

একেবারে খাঁটি মরদের মতো আলাপ, আর মদ কখনো চেখে না দেখলেও আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল:

‘আরে হ্যাঁ, হয়ে গেল রে… বন্ধুবান্ধবে মিলে এক পাত্র করে টানলাম।’ বিস্ময়ে লম্বা হয়ে গেল ফেলিয়ার মুখ আর ‘যে-কোনো মুহূর্তে সে যে মারা

যেতে পারে’ তা ভুলে আমি তার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগলাম।

‘ঝাঁকানি থামা তো!’ রেগে, নাকের ডগায় নেমে-আসা চশমাটা ঠিক করে ফেলিয়া বললে, ‘হলটা কী?’

খুশির হাতুড়ি পিটছিল আমার মাথায়। ফেলিয়ার কাছ ঘে’ষে এসে তাকালাম তার চশমায়।

‘দিব্যি দিয়ে বল, কাউকে বলবি না,’ বললাম গোপনীয়তার সুর ফুটিয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই দিব্যি দিতে রাজী হয়ে গেল ফেলিয়া। বললে:

‘বেশ, বল তোর গোপন কথা।’

বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল সে, লম্বা লম্বা আঙুলে হুশ-চিহ্ন দিলে পেটে।

‘কসম খা!’ জেদ ধরলাম আমি।

‘বেশ, কসম!’

ওর কনুই ধরে আস্তে করে বললাম:

‘জানিস চুমু ওকে।’

মুয়েলস ফেলিয়া, চুমু খেয়েছি কপিল না। ভাবলাম, ফেলিয়া আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারে নি, তাই আমার হাতে ঝাঁকুনি না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

বললাম:

‘লিজাকে আমি ভালোবাসি রে ফেলিয়া, লিজাও আমায় ভালোবাসে। আমাদের মধ্যে প্রেম হয়েছে।’

ঐন্দ্রজালিক এই কথাটি বলে চাইলাম ফেলিয়ার দিকে। ঠিক করলাম, আনন্দে ও যে চে’চিয়ে উঠল না তার কারণ একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। মনে হল, দুনিয়ায় ওর মতো ভালো লোক আর হয় না। চে’চিয়ে উঠলাম:

‘ফেলিয়া, তুই এখন থেকে আমার সেরা বন্ধ! তোকেও আমি ভালোবাসি।’ এই সময় থেকে ফেলিয়া শুধু ফেলিয়া নয়, হয়ে উঠল আমার অমূল্য রহস্যের রক্ষাপাত্র।

ওহ, বিজ্ঞ একটা বোলতার কী অভাবেই না সেদিন আমায় ভুগতে হয়েছিল, এমন বোলতা যে লোকের মিথ্যেটা ধরতে পারে, কথায় বিষ ঝরাতে দেয় না, অস্পৃশ্য দুরাত্মাদের নীল চোখের নিচে দেগে দিতে পারে তার ক্ষমাহীন রায়। সে সময় যদি ফেলিয়ার চশমার ভেতর থেকে চোখে পড়ত বোলতার রায় লালচে-সবজে- বেগুনী ধনুক, তাহলে মুখ খুলতাম না। রহস্য রক্ষার অন্য পাত্র খাঁজে নিতাম। আরো বিশ্বস্ত।

পরের দিন লিজা নীরবে চলে গেল আমার পাশ দিয়ে।

‘লিজা, নমস্কার! লিজা…’

গতি বাড়াল লিজা। আনন্দ আমার দ্রুত কমতে লাগল। কেমন যেন ককেড়ে গেল, মিইয়ে গেল।

এগিয়ে গিয়ে লিজার সঙ্গ ধরলাম। হাত টেনে নিলাম তার। ও হাত ছাড়িয়ে কেমন বিজাতীয় গলায় বললে:

‘জানতাম না তুমি অমন একটা তুচ্ছ বড়াইবাগীশ। তোমায় আমি বিশ্বাস করেছিলাম, আর তুমি দেখছি একেবারে উচ্ছা।”

‘লিজা, কী বলছ?!”

‘যা বলছি, জেনে শুনেই বলছি। খুবই গুখোরি করেছি। বড়াই করার লোক পেয়েছেন ভালো ফেলিয়া!’

নিবে গেল আলো। উলটে গেল দুনিয়া। ঠিক করলাম, ফেলিয়াকে খুন করব। ভুলে গেলাম ও রুগ্‌ণ, অসুস্থ, শরীরচর্চা ওর মানা। করিডরে ওকে পাকড়াও করে জামা ধরে ঠেসে ধরলাম দেয়ালের সঙ্গে। গোল অ্যাকুয়ারিয়মে হুটোপুটি করছে দুটি ছেয়ে রঙের মাছ। আমার দৃষ্টি থেকে তারা পিছলে যাচ্ছে।

ও-ই কথা বললে প্রথম:

‘তুই কী চাস, বল তো? আমি তো সত্যি কথাই বলেছি।’

ওর কথায় থ মেরে গেলাম।

‘সত্যি মানে?!’

‘কেন, সত্যি নয়? তুই যা বলেছিলি তাই বলেছি। নাকি চাস যে মিথ্যা বলব?’ প্রাণপণে ঠেসে ধরেছিলাম ফেলিয়াকে, ওর জামাটা পর্যন্ত ছি’ড়ে গেল, তাহলেও আমার হাত থেকে খসে যাচ্ছিল সে।

‘তুই যে কসম খেয়েছিলি কাউকে ফাঁস করবি না!’ মরিয়ার মতো চে’চালাম আমি, টের পাচ্ছিলাম মুঠো আমার আলগা হয়ে আসছে, ফেলিয়াকে ধরে রাখতে

পারছি না।

ওর কাছে তো এটা গোপন নয়।’

‘ আমার হাত ছাড়িয়ে নিলে ও। দেবদূতের মতো ও অকলঙ্ক, আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম থুতু-খাওয়া, কাদামাখা। নিরস্ত্র, পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কিছুই করার নেই আমার। ফেলিয়ার দিকে সশঙ্কে তাকিয়ে আমি চলে গেলাম।

বোলতার উপকারিতা নিয়ে লোকে ভাবে কত কম। প্রক্ষেপই করে না, নয়ত তাড়িয়ে দেয়, যেন কারিতা নিয়ে চলোকের বিপদ সম্পকে হংশিয়ারি দেবার জন্যে বোলতার খুবই দরকার।

বহু, বছর পরে আমার ফের দেখা হয় ফেলিয়ার সঙ্গে। বুদ্ধিমান, গুরুত্বমনা লোকেদের যাতায়াত কামনাকোর করিডর দিয়ে, ভাগ্যক্রমে সেখানেই। বদলে গেছে ফেলিয়া। নেই আর সেই রুগ্‌ণ মুখ, চোখের নিচে কালি। হয়ে উঠেছে নিটোল, চিকন, চোপমানেয়ার সেই রে উঠেছে চর্বিতে। যে কাঁধে আগে সবকিছুই ঢল-ঢল করত, তা হয়ে উঠেছে গোলালো, শার্ট কোটের পক্ষে যুতসই। আর সাইকেলের পাম্প দিয়ে পাম্প করার মতো ফোলানো পেটটিতে তার চেহারায় লেগেছে বেশ একটা কায়েমী পাট্টার ভাব। লোকেও তাকে ডাকে এখন ফেলিয়া বলে নয়, ফেলিক্স। দাঁড়িয়েছিল আমার দিকে একপেশে হয়ে, দেখতে পাচ্ছিলাম শুধু তার একটা চোখ। পিছলে যাওয়া ছাইরঙের মাছটা ভাসছিল গোল অ্যাকুয়ারিয়মে। বাঁকাভাবে ছাঁটা পাঁশুটে চুলের ঝাটি এসে পড়ছিল কপালে, ধাঁরে সুস্থে তা কায়দা করে ফের যথাস্থানে সরিয়ে দিচ্ছিল সে।

ভেবেছিলাম পাশ কাটিয়ে যাব, কিন্তু আমায় দেখে সে হাত বাড়িয়ে দিলে, আর মহানন্দে আমি দেখলাম তার দ্বিতীয় চোখটি ফুলে উঠেছে, চারপাশে তার ভারি চমৎকার এক রামধনু।

‘কোথায় এটি জোটালি?’ জিজ্ঞেস করলাম ফেলিয়াকে, টের পাচ্ছিলাম হাসতে শুরু করেছি।

‘মানে, শহরের বাইরে গিয়েছিলাম আর কি… নেমন্তন্ন ছিল। সেখানে একটা বোলতা… দিলে কামড়ে,’ বিব্রতের মতো বলে ফেলিয়াও হাসতে শুরু করলে। ওর হাসিটা শোনাল কাসির মতো।

মনে হল, ‘আচ্ছা! স্পষ্টবক্তা বোলতার অভাব তাহলে এখনো হয় নি। আমার ফেলিয়াটিকে বোলতা ঠিকই চিনতে পেরেছে দেখছি।’

হাসা আমার উচিত নয়, কিন্তু কিছুতেই পারলাম না, আকর্ণবিস্তৃত চাপা

হাসিতে আমার ঠোঁটের কোণে ব্যথা করে উঠল।

‘হাস্যকর ব্যাপার, তাই না?’ তেতো মুখে জিজ্ঞেস করলে ফেলিক্স।

‘আরে না,’ বললাম জোর দিয়ে, ‘তুই বুঝতে পারছিস না কী চমৎকার হয়েছে। কী আশ্চর্য রঙ, কী সুক্ষর ঝিলিমিলি! একেবারে ওস্তাদের কাজ।’

হাসি বন্ধ হয়ে গেল ফেলিয়ার। লম্বা হয়ে গেল মুখখানা:

‘কী বলতে চাইছিস তুই?’

‘আরে না, কিছু না। দেখা যাচ্ছে, খুবই বুদ্ধিমান বোলতা। তুই মেরেছিস

ওটাকে ?’

‘তাতে আর লাভ কী?’

বুঝলাম, ফেলিয়া ওটাকে মারে নি। বললাম:

‘জানিস, আমার একটা বোলতা আছে। থাকে গোলাঘরে। দরজার ফোকরে। ঢোকে তালার ফুটো দিয়ে….

এমনি লাল হয়ে উঠল ফেলিয়া যে তার জলজ্বলে রামধনুটাও লান দেখাল, কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল সে। আমি কিন্তু তখনো কেবল মন খুলে আনন্দে হেসে যাচ্ছি।

‘কাঁ ব্যাপার গো, এত খুশি যে?’ জিজ্ঞেস করলে নীল ওভার-অল পরা এক বুড়ি, ‘লটারিতে মোটরগাড়ি পেয়েছ বুঝি?’

বললাম, ‘উ’হ’, আরো বেশি, লড়াইয়ে জিতেছি।’

সভয়ে আমার দিকে চেয়ে বুড়ি জুতো খসখসিয়ে চলে গেল করিডর দিয়ে।

সন্ধ্যায় এলাম গোলাঘরে চুপি-চুপি, আমার ডানা-ওয়ালা বাসিন্দারা যাতে ভয় না পায়। দরজায় কান পেতে শুনতে লাগলাম। অবিরাম খুশির গুঞ্জন আসছিল সেখান থেকে। মনে হচ্ছিল যেন খুব জমজমাট একটা আলাপ। নিশ্চয় আমার পরিচিত বোলতাটি বলছিল কেমন নিখুঁতভাবে সে হল ফুটিয়েছে ফেলিয়ার চোখে। অন্য বোলতারা তার এই কীর্তি আলোচনা করে খুবই তারিফ করছে, যা প্রকাশ পাচ্ছে শুধু একটানা বোঁ-বোঁ করা একটা অক্ষরে….জজজ-জজজ-জজজ……