১০:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১১৫)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই ২০২৪
  • 19

শ্রী নিখিলনাথ রায়

ভীষণ দ্বিপ্রহর রজনীতে বাঙ্গলা বিহার উড়িষ্যার অধিপতি ও অধীশ্বরী সামান্য যানে আরোহণ করিয়া, রাজধানী পরিত্যাগ করিলেন। নৈশান্ধকার তাঁহাদের মুখে আবরণ প্রদান করিল; মধ্যে মধ্যে শৃগাল ও পেচকের ভীষণ শব্দ তাঁহাদের মনে ভীতির উৎপাদন করিতেছে,- নিকটে কোনও শব্দ শুনিলে মীরজাফরের চর বলিয়া তাঁহারা চমকিত হইয়া উঠিতেছেন, -এইরূপ অবস্থায় ক্রমশঃ তাঁহারা ভগবানগোলার দিকে অগ্রসর হইলেন। সিরাজ যতই গমন করেন, ততই চঞ্চল হইয়া উঠেন; বিশেষতঃ লুৎফ উন্নেসার জন্য তিনি নিরতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিলেন।

কিন্তু সেই দেবহৃদয়া নিজে কিছুমাত্র ক্লান্তি অনুভব না করিয়া প্রাণপণে স্বামীর কষ্ট নিবারণে যন্ত্রবতী হইলেন। রাত্রি প্রভাত হইল। নৈদাষ-তপন স্বীয় প্রচণ্ড কিরণ ছড়াইতে ছড়াইতে দেখা দিলেন; ক্রমে রৌদ্রে ও রৌদ্রতপ্ত ধূলিতে সিরাজের কমনীয় মুখমণ্ডল আরক্ত হইয়া উঠিল; স্বেদজলে ললাট ও গণ্ডস্থল অবিরত সিক্ত হইতে লাগিল। লুৎফ উন্নেসা স্বামীর সেই ক্লেশ নিবারণার্থ অবিরত চেষ্টা করিতে লাগি- লেন। নিজের শরীর সূর্য্যোত্তাপে দপ্ত হইয়া যাইতেছে-ভ্রূক্ষেপ নাই! কিসে স্বামীর ক্লান্তি দূর করিবেন, তজ্জন্য অত্যন্ত চঞ্চলা হইয়া উঠিলেন।

এইরূপে তাঁহারা ভগবানগোলায় উপস্থিত হইয়া তথা হইতে নৌকা- রোহণে রাজমহাল অভিমুখে যাত্রা করিলেন। পদ্মার উত্তাল তরঙ্গমালা দেখিয়া চিরসুখাভ্যস্ত সিরাজের প্রাণ কাঁপিতে লাগিল; কিন্তু সেই দেব- হৃদয়া তাহাতে বিচলিত হইলেন না। তিনি নিজে স্বামীকে সঙ্গে লইয়া সেই ক্ষুদ্রতরণীতে আরোহণপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে তরঙ্গের পশ্চাৎ তরঙ্গ আসিয়া সেই ক্ষীণকলেবরা তরণীকে রসাতলে প্রেরণের উপক্রম করিতে লাগিল।

সিরাজ জীবনের আশা বিসর্জন দিয়া ভীত ও চমকিত হইতে লাগিলেন; কিন্তু লুৎফ উন্নেসা তাঁহাকে শান্ত করিয়া সলিলসিক্ত স্বামীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ মুছাইতে আরম্ভ করিলেন। মধ্যে মধ্যে নিদাঘের বৃষ্টি তাঁহাদিগকে অস্থির করিয়া তুলিতে লাগিল। লুংফ উন্নেসা সিরাজকে আচ্ছাদন করিয়া, তাহা হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিতে যত্নবর্তী হইলেন। সঙ্গে চারি বৎসরের একমাত্র বালিকা কন্যা উম্মত জহুরা। সিরাজ এক একবার তাহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কাঁদিয়া আকুল হন, পাছে তাঁহার সর্ব্বস্বধন পদ্মার তরঙ্গে ভাসিয়া যায়!

 

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১১৫)

১১:০০:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই ২০২৪

শ্রী নিখিলনাথ রায়

ভীষণ দ্বিপ্রহর রজনীতে বাঙ্গলা বিহার উড়িষ্যার অধিপতি ও অধীশ্বরী সামান্য যানে আরোহণ করিয়া, রাজধানী পরিত্যাগ করিলেন। নৈশান্ধকার তাঁহাদের মুখে আবরণ প্রদান করিল; মধ্যে মধ্যে শৃগাল ও পেচকের ভীষণ শব্দ তাঁহাদের মনে ভীতির উৎপাদন করিতেছে,- নিকটে কোনও শব্দ শুনিলে মীরজাফরের চর বলিয়া তাঁহারা চমকিত হইয়া উঠিতেছেন, -এইরূপ অবস্থায় ক্রমশঃ তাঁহারা ভগবানগোলার দিকে অগ্রসর হইলেন। সিরাজ যতই গমন করেন, ততই চঞ্চল হইয়া উঠেন; বিশেষতঃ লুৎফ উন্নেসার জন্য তিনি নিরতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিলেন।

কিন্তু সেই দেবহৃদয়া নিজে কিছুমাত্র ক্লান্তি অনুভব না করিয়া প্রাণপণে স্বামীর কষ্ট নিবারণে যন্ত্রবতী হইলেন। রাত্রি প্রভাত হইল। নৈদাষ-তপন স্বীয় প্রচণ্ড কিরণ ছড়াইতে ছড়াইতে দেখা দিলেন; ক্রমে রৌদ্রে ও রৌদ্রতপ্ত ধূলিতে সিরাজের কমনীয় মুখমণ্ডল আরক্ত হইয়া উঠিল; স্বেদজলে ললাট ও গণ্ডস্থল অবিরত সিক্ত হইতে লাগিল। লুৎফ উন্নেসা স্বামীর সেই ক্লেশ নিবারণার্থ অবিরত চেষ্টা করিতে লাগি- লেন। নিজের শরীর সূর্য্যোত্তাপে দপ্ত হইয়া যাইতেছে-ভ্রূক্ষেপ নাই! কিসে স্বামীর ক্লান্তি দূর করিবেন, তজ্জন্য অত্যন্ত চঞ্চলা হইয়া উঠিলেন।

এইরূপে তাঁহারা ভগবানগোলায় উপস্থিত হইয়া তথা হইতে নৌকা- রোহণে রাজমহাল অভিমুখে যাত্রা করিলেন। পদ্মার উত্তাল তরঙ্গমালা দেখিয়া চিরসুখাভ্যস্ত সিরাজের প্রাণ কাঁপিতে লাগিল; কিন্তু সেই দেব- হৃদয়া তাহাতে বিচলিত হইলেন না। তিনি নিজে স্বামীকে সঙ্গে লইয়া সেই ক্ষুদ্রতরণীতে আরোহণপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে তরঙ্গের পশ্চাৎ তরঙ্গ আসিয়া সেই ক্ষীণকলেবরা তরণীকে রসাতলে প্রেরণের উপক্রম করিতে লাগিল।

সিরাজ জীবনের আশা বিসর্জন দিয়া ভীত ও চমকিত হইতে লাগিলেন; কিন্তু লুৎফ উন্নেসা তাঁহাকে শান্ত করিয়া সলিলসিক্ত স্বামীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ মুছাইতে আরম্ভ করিলেন। মধ্যে মধ্যে নিদাঘের বৃষ্টি তাঁহাদিগকে অস্থির করিয়া তুলিতে লাগিল। লুংফ উন্নেসা সিরাজকে আচ্ছাদন করিয়া, তাহা হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিতে যত্নবর্তী হইলেন। সঙ্গে চারি বৎসরের একমাত্র বালিকা কন্যা উম্মত জহুরা। সিরাজ এক একবার তাহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কাঁদিয়া আকুল হন, পাছে তাঁহার সর্ব্বস্বধন পদ্মার তরঙ্গে ভাসিয়া যায়!