শ্রী নিখিলনাথ রায়
সেই সময়ে তাঁহার শোচনীয় অবস্থার কথা স্মরণ করিলে, পাষাণেরও হৃদয় বিগলিত হয়। তাঁহার প্রিয়তম স্বামী এক্ষণে ধরণীগর্ভে শায়িত; অন্যান্য আত্মীয় স্বজনও একে একে অনন্তপথে যাত্রা করিয়াছেন; আজ তিনি এই বিশাল বিশ্বে একাকিনী,-একটিমাত্র বালিকা কন্যা অবলম্বন। এইরূপ অবস্থায় তিনি প্রতিদিন স্বামীর সমাধি পূজা করিতে আসিতেন। রৌপ্য ও স্বর্ণময় পুষ্পখচিত কৃষ্ণবর্ণ বস্ত্রদ্বারা সে সমাধি আচ্ছাদিত ছিল; তিনি তথায় প্রতিনিয়ত দীপ প্রজ্বলিত করিয়া দিতেন এবং উদ্যানের সুগন্ধি কুসুমসকল চয়ন করিয়া, সেই অশ্রুজলসিক্ত কুসুমরাশি প্রিয়পতির সমাধির উপর নিক্ষেপ করিতেন।
সেই সময়ে বক্ষঃস্থলে করাঘাত করিতে করিতে তিনি ভূতলশায়িনী হইয়া পড়িতেন এবং অশেষ প্রকার করুণোদ্দীপক ক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া শোকভারের লঘুতা সম্পাদনার্থ চেষ্টা পাইতেন। এই রূপে স্বামীর সমাধি পূজা করিতে করিতে, অন্তিমকাল উপস্থিত হইলে লুৎফ উন্নেসা স্বামীর চরণে মনোনিবেশ করিয়া, তাঁহারই পদতলে চিরদিনের জন্য সমাহিত হইলেন। আজিও খোসবাগে সিরাজের পদতলে তাঁহার সমাধি বর্তমান রহিয়াছে।
খোসবাগের বৃক্ষরাজির নিবিড় ছায়াতলে প্রকোষ্ঠমধ্যে তাঁহারা অনন্ত বিশ্রাম লাভ করিতেছেন; বিশ্বজননী বসুন্ধরার বিশাল অঙ্গের এক- দেশে তাঁহারা চিরনিদ্রায় অভিভূত। যাঁহারা জীবনে প্রভৃত দুঃখ ও কষ্টে ক্ষতবিক্ষতহৃদয় হইয়া এক্ষণে বিশ্রাম লাভ করিতেছেন, তাঁহাদের সে বিশ্রামে ব্যাঘাত উৎপাদন করা যুক্তিসঙ্গত নহে। অনন্ত বিশ্রামে তাঁহারা চিরশান্তি লাভ করুন।
উপরি লিখিত দুই একটি ঘটনা হইতে সাধারণে লুৎফ উন্নেসার অলোকসামান্য চরিত্রের কথঞ্চিৎ পরিচয় পাইবেন। ইতিহাসে তাঁহার কোনরূপ উজ্জ্বল চিত্র নাই; কিন্তু তাঁহার জীবনের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ঘটনা মিলিত করিলে, আমরা তাহারই মধ্য হইতে সে চিত্রের অনেকটা আভাস বুঝিতে পারি। প্রচলিত ইতিহাসে সিরাজ উদ্দৌলার মহিষীর উজ্জ্বল চিত্র থাকা সম্ভবপর নহে; সুতরাং আমাদের মনে তাহা সুন্দররূপে প্রতিভাত হইলেও, ঘটনাভাবে অধিকতর সুস্পষ্ট করা কঠিন।