শ্রী নিখিলনাথ রায়
এইরূপ অবস্থায় তাঁহার হৃদয় কিরূপ অশান্তিকর হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা সহজে অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু, একজন মাত্র তাঁহার সেই দগ্ধহৃদয়ে শান্তিবারি প্রদান করিয়া তাঁহার চঞ্চল চিত্তকে কিয়ৎপরিমাণে স্থিরতর করিতে চেষ্টা পাইতেন, তিনিই লুংফ উন্নেসা। লুৎফ উন্নেসা তাঁহার প্রত্যেক কার্য্যে সমবেদনা প্রকাশ করিয়া, তাঁহার দুশ্চিন্তা দাবদগ্ধ-হৃদয়ে শান্তির স্নিগ্ধবারি সেচন করিতেন।
বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারিগণের কৌশলে, যখন পলাশীর রণক্ষেত্রে * পরাজিত হইয়া, যুদ্ধস্থল হইতে পলায়নপর সিরাজ মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইলেন, তখন তাঁহার সে চিত্র মনে হইলে, করুণরসে’ হৃদয় অভিষিক্ত হইয়া উঠে। তিনি যাহার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন, সেই তাঁহার প্রতি বিমুখ হয়। গভীর রাত্রি, চারিদিকে কেমন একটা বিষাদের ছবি সিরাজের চক্ষের সমক্ষে নাচিয়া বেড়াইতেছে! মুর্শিদাবাদে মীরজাফরের ও পলাশীর পথে ইংরেজ-সৈন্যের সানন্দ-কোলাহল ও বিজয়বাস্থ্য চতুদিক্ প্রতিধ্বনিত করিতেছে; তাহাদের প্রত্যেক আঘাতে সিরাজের মর্ম্মস্থল ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে।
সিরাজ ছিন্নকণ্ঠ কপোতের ন্যায় অত্যন্ত অস্থির হইয়া উঠিলেন; তাঁহার মস্তিষ্ক হইতে বিবেচনাশক্তি যেন চিরবিদায় লইয়াছে বলিয়া বোধ হইতে লাগিল; কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। কোনও কোনও বিশ্বাসী বন্ধুর কথার সিরাজ একবার নগররক্ষা করিতে ইচ্ছা করিলেন; আবার বিশ্বাস- ঘাতকেরা পরামর্শ দিল, পলায়ন কর; নতুবা তোমার নিস্তার নাই। সিরাজ অনন্যোপায় হইয়া তাঁহার অনুগমন করিবার জন্য সকলের পদ- তলে বিলুন্ঠিত হইতে লাগিলেন। যাহারা তাঁহার চরণ স্পর্শ করিবারও উপযোগী নহে, আজ সিরাজ তাহাদেরও কৃপার ভিখারী।
কিন্তু কেহই তাঁহার সেই কাতরোক্তিতে কর্ণপাত করিল না। এমন কি, তাঁহার শ্বশুর পর্যন্ত তাঁহার সহিত একপদ গমন করিতে স্বীকৃত হইলেন না। যতই বিপক্ষগণের বিজয়ধ্বনি শুনিতে পান, ততই সিরাজের প্রাণ কম্পিত হইতে থাকে। তখন তিনি স্বীয় প্রিয়তমা লুৎফ উন্নেসার নিকট ভগ্নহৃদয়ে উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে সঙ্গে লইতে ইচ্ছা করিলেন। লুৎফ উন্নেসা বাক্যব্যয় না করিয়া দুই এক জন দাসীর সহিত স্বামীর পশ্চাদ্বর্তিনী হইলেন।
Leave a Reply