শ্রী নিখিলনাথ রায়
নিরপেক্ষ ব্যক্তি- মাত্রেই স্বীকার করিয়া থাকেন যে, পলাশীতে প্রকৃত যুদ্ধ ঘটে নাই; ইংরেজেরা একরূপ বিনাযুদ্ধেই পলাশীতে জয়লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু সেই জয়লাভে তাঁহাদিগকে জগতের মধ্যে অজেয় করিয়া তুলিয়াছে। এই বিজয়ের কারণ, কেবল বিশ্বাসঘাতকদিগের ষড়যন্ত্র ও সিরাজ উদ্দৌলার কাপুরুষতা। যদি নবাবের সেনাপতিগণ স্ব স্ব কর্তব্য পালন করিতেন, অথবা মীরমদনের পতনের পর সিরাজ মোহনলালের সহিত নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতেন, তাহা হইলে উত্তালতরঙ্গসঙ্কুল মহাসমুদ্র প্রায় নবাবসৈন্যের নিকট মুষ্টিমেয় ইংরেজ- তৃণগুচ্ছ যে কোথায় ভাসিয়া যাইত, তাহা বলিতে পারা যায় না। কোন নিরপেক্ষ ইংরেজ ঐতিহাসিক এই পলাশীযুদ্ধ সম্বন্ধে নিম্ন- লিখিতরূণ মত প্রকাশ করিয়াছেন।
“বাস্তবিক ফলবিষয়ে পলাশীবিজয়ের ন্যায় বিজয়লাভ আর কখনও হয় নাই। কিন্তু যুদ্ধের কথা ভাবিলে, আমার মতে তাহাতে গৌরবের বিষয় কিছুই নাই। প্রথমতঃ সে যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত হয় নাই। সিরাজ উদ্দৌলার তিন জন প্রধান সেনাপতি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করিত, তাহা হইলে, পলাশীযুদ্ধে- কখনই জয়লাভ হইত না। মীরমদন খাঁর মৃত্যুর পূর্ব্ব পর্যন্ত ইংরেজেরা অগ্রসর হইতে পারেন নাই; প্রত্যুত পশ্চাৎপদ হইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। নবাবসৈন্য যদি বিশ্বস্ত ও রাজভক্ত ব্যক্তিগণের দ্বারা চালিত হইয়া, স্বস্থানে অবস্থিতিমাত্র করিত, তাহা হইলে ইংরেজেরা তাহাদের কিছুই করিতে পারিতেন না। ফরাসী গোলন্দাজদিগের অভিমুখে অগ্রসর হইলেই ইংরেজ সৈন্যের দক্ষিণ পার্শ্ব ৪০ সহস্র বিপক্ষ সেনার সম্মুখে পড়িত।
অতএব সে কথা মনে স্থান পাইবার যোগ্য নহে। কেবল বিশ্বাসঘাতকতার দ্বারাই কার্যসিদ্ধি হইয়াছিল। যখন সেনাপতিগণের বিশ্বাসঘাতকতাবশতঃ নবাব যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিলেন, যখন সেই বিশ্বাসঘাতকতা নবাবসৈন্যগণকে তাহাদের সুরক্ষিত অবস্থান হইতে অপসারিত করিল, তখনই ক্লাইব সসৈন্সে বিধ্বস্ত হইবার আশঙ্কা না করিয়া অগ্রসর হইয়াছিলেন। অতএব পলাশীতে যদিও নিঃসংশয়রূপে বিজয়লাভ হইয়াছিল, তথাপি ইহাকে একটি মহা যুদ্ধ বলা যাইতে পারে না।” তাহার পর, ইংরেজেরা সিরাজের সহিত যেরূপ সাধুজনবিগহিত ব্যবহার করিয়া পলাশীযুদ্ধের অবতারণা করিয়াছেন, তাহাতে পলাশীযুদ্ধের নাম ইতিহাসে চিরকলঙ্কিত হইয়া থাকিবে।
৯ই ফেব্রুয়ারীর সন্ধির পর হইতেই সিরাজ সন্ধিবিরুদ্ধ কোন কাৰ্য্যই করেন নাই। কিন্তু ইংরেজেরা কৌশলপূর্ব্বক পদে পদে সন্ধিভঙ্গ করিয়া, বিশ্বাসঘাতকদিগের সাহায্যে সিরাজের সর্ব্বনাশসাধন করিয়াছেন। কোন ইংরেজ লেখক বলিয়াছেন, ‘যে গরজের জন্য রাজনৈতিক বিষয়ে সমস্ত শপথসন্ধি প্রভৃতি অতিক্রান্ত হয়, সেই গরজবশতঃ ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিনিধিগণ পূর্ব্বকৃত সন্ধির প্রায় তিন মাস পরে ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদে সিরাজ উদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া অপর আর এক জনকে তাহা প্রদান করিবার কৃতসঙ্কল্প হইয়া- ছিলেন।”
Leave a Reply