পিওতর মান্তেইফেল
একটি ভাল্লুক পরিবারের কাহিনী
মর্দা ভল্লুক তার আশেপাশে নবজাতক বাচ্চাদের সইতে পারে না। সেইজন্যে মাদী ভালুক বসন্তে তার বাচ্চাদের নিয়ে এমন জায়গায় চলে যায় যেখানে মর্দা নেই, আর শরতে বাচ্চা সমেত গুহায় গিয়ে ঢোকে সারা শীত কাটাবার জন্যে (ভালুক বাচ্চা দেয় দু’বছরে একবার)।
বছর কয়েক আগে আমরা ঠিক করি, মর্দা ভালুককে বাচ্চাদের সঙ্গে অভ্যন্ত করিয়ে নেব। মস্কো চিড়িয়াখানায় প্রকাণ্ড ভালুক ‘বরেৎস্ (যোদ্ধা)- কে রাখা হয় ভল্লুকী ‘প্লাক্সা’ (ছি’চকাঁদুনী)-র সঙ্গে একই খোঁয়াড়ে। সেখানে শীতকালে বাচ্চা হল প্লাক্সার তিনটি ভল্লুক-শিশু। বাচ্চাদের দিকে খুবই আক্রোশে চাইলে বরেৎস্, বার কয়েক চুপিচুপি এগুবারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু মা ছিল খুবই সজাগ। বাপ একটু কাছে ঘেষতে গেলেই প্লাক্সা এগিয়ে গিয়ে তার দেহ দিয়ে আড়াল করত তখনো চোখ-না ফোটা বাচ্চাদের। চেহারায় বরেৎস্ ছিল প্লাক্সার দ্বিগুণ, গায়েও তার জোর অনেক। কিন্তু রাগ হলে ভল্লুকী-মা ভয়ঙ্করী। প্রচণ্ড আক্রোশে সে ঝাঁপিয়ে পড়ত বরেৎসের ওপর, এমন ঘা মারত যে বরেৎস্ সঙ্গে সঙ্গেই হটে যেত। ভরুকীর চপেটাঘাত থেকে বাঁচত সে পিছিয়ে গিয়ে সামনের খাবা দিয়ে মাথা ঢেকে। একবার তো মারমুখী ভয়ংকীর কাছ থেকে পিছতে গিয়ে পরিখাতেই পড়ে যায় সে।
‘সাংসারিক এই তুলকালাম’ চলে দিনের পর দিন, শেষে বরেৎস্ মেনে নেয় কাছে-পিঠে শিশু-ভালুকদের সহ্য করা প্রয়োজন। প্লাক্সা তাকে এমনই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল যে তার মধ্যে একটা বিশেষ প্রতিবর্ত দেখা দিল: গুহা থেকে বেরিয়ে বাচ্চারা কখনো বাপের কাছাকাছি হলেই সে পড়ি-মরি দৌড় দিত, খাণ্ডারী মায়ের দিকে সশঙ্কে তাকিয়ে বড়ো বড়ো থাবায় বাঁচাত আগে থেকেই।
আমাদের মনে হয়েছিল, বরেৎস্ বোধ হয় তার এই নতুন সাংসারিক অবস্থাটা মেনে নিয়েছে চূড়ান্তভাবেই। কিন্তু সেটা হয় নি।
খোঁয়াড়ের মাঝখানে, ভালুক পরিবারটি যেখানে থাকত, সেখানে ছিল বেশ উচ্চ-মতো একটা কাঠের গুড়ি। দু’জন মানুষেও বেড় পাবে না, এত মোটা। একদিন তার ওপর উঠে রোদ পোয়াচ্ছিল একটা বাচ্চা। প্রাক্সা চুলছিল। বরেৎস্ চুপিচুপি গুড়িটার কাছে গিয়ে এমন জোরে থাবা মারে যে বাচ্চাটা চিৎকার করে ছিটকে যায় কয়েক মিটার পর্যন্ত। তক্ষুনি জেগে ওঠে ভল্লুকী। বাপ-ভল্লুককে গোটা দুই উত্তম- মধ্যম দিতেই সে শান্ত হয়ে আসে, দোষীর মতো ভাব করে চলে যায় কোণটিতে ঘুমাতে।
দিন কয়েক সংসারে শান্তি রইল। নিজের স্বাভাবিক সতর্কতায় ঢিল পড়তে লাগল প্লাক্সার। শান্ত রোদের এক সকালে সে ফের আগের মতোই ঢুলছিল। সেই ফাঁকে একটা বাচ্চা পরিখায় নেমে জলে থাবা ধুতে শুরু করে। বরেৎস্ মন দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে, তারপর চুপিচুপি অন্য পাশ দিয়ে নেমে আস্তে আস্তে এগুতে থাকে বাচ্চাটার দিকে। বিপদ টের না পেয়ে বাচ্চাটা মনের আনন্দে জল ছিটিয়েই চলেছে। হঠাৎ বরেৎস্ দাঁত দিয়ে তার গলা কামড়ে চট করে তাকে জলের ভেতরে ঠেসে ধরে। চে’চাবার চেষ্টা করে বাচ্চাটা, পারে না: হাবুডুবু খেতে থাকে। কিন্তু বরেৎসেরও দম ফুরিয়ে এসেছিল, নিঃশ্বাস নেবার জন্যে এক মুহূর্ত জল থেকে মাথা তুলতে বাধ্য হল সে, অবিশ্যি দাঁত থেকে শিকারকে সে তখনো ছাড়ে নি। ঠিক সেই সময় ‘পশুদ্বীপে’ (মস্কো চিড়িয়াখানার নতুন এলাকার যে অংশে ভালুক থাকে) শোনা গেল ভালুক-ছানার পরিবাহি আর্তনাদ। তন্দ্রা ছুটে গেল মায়ের। দুই লাফে বড়ো আঙিনাটা পেরিয়ে সে মুহূর্তের মধ্যে হাজির হল বিশ্বাসঘাতক বাপের কাছে।
তারপর সে যা কাণ্ড! ক্ষিপ্তের মতো প্রাক্সা ঝাঁপিয়ে পড়ল বরেৎসের ওপর, দম নিতেও দিলে না তাকে। ভয়ঙ্কর মার খেয়ে ভালুকটা কেবল থাবা দিয়ে গা বাঁচিয়ে একরাশ জল ছিটিয়ে পিছিয়ে গেল পরিখার দূর কোণে। ভয় পেয়ে সে ওখানেই বসে ছিল ঘণ্টাখানেকেরও বেশি। আর শঙ্কিতের মতো কেবলি কান পেতে শুনছিল ওপরে তার উত্তেজিতা মাদীর পায়ের শব্দ।
সেই থেকে ভল্লুক পরিবারের রেওয়াজ হয়ে গেল পাকা। বাচ্চাদের খাওয়ানো আর বড়ো করে তোলায় ব্যস্ত প্লাক্সা বরেৎসের দিকে ভ্রক্ষেপও করত না।
বরেৎসের লোম পালটাতে লাগল, বংশধরদের নিয়ে তার আর কোনো আগ্রহ রইল না। এখন চিত হয়ে শুয়ে দু’পাশে থাবা ছড়িয়ে প্রায়ই সে ঘুমোয়।
অলক্ষ্যে এগিয়ে এল শীত। ভালুকরা গভীর গর্ত খুঁড়লে, বেশির ভাগ সময়টা তারা সেখানে কাটাত তন্দ্রার মধ্যে। প্লাক্সা ঘুমোত তার তিন বাচ্চা নিয়ে, আর বরেৎস্ থাকত খোঁয়াড়ের উল্টো দিকে ভিন্ন একটা গুহায়। দিনটা গরম থাকলে বাচ্চাগুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে খেলা করত বরফে। কখনো কখনো তারা নির্ভয়ে এগিয়ে যেত বাপের দিকে, বরেৎস্ তখন চেষ্টা করত গুহায় মায়ের কাছে পালাবার পথটা তাদের আটকাতে। শীতে প্লাক্সার মাতৃস্নেহ কমে যায়, সে তার ‘বাঁকা-থাবা’ ছানাদের রক্ষা করত কেবল যখন তারা থাকত গুহায়। তবে নাবালকরাও তদ্দিনে অনেক স্বাধীন হয়ে উঠেছে, এখন তাদের ধরা অনেক কঠিন। তাহলেও একটা ভালুক- ছানাকে ধরতে পারে বরেৎস্। একমনী বাচ্চাটাকে বাপ এমন মারে যে সে ছিটকে পরে কয়েক মিটার দূরে।
বসন্তে ভল্লুক পরিবারে গুরুতর কোনো অশান্তি দেখা যায় নি। বেশ বড়ো হয়ে উঠল ছানাগুলো, বাপকে এখন আর বিশেষ ভয় পায় না।
একদিন চিড়িয়াখানা দিয়ে যাবার সময় দেখি, ভালুক পরিবারের খোঁয়াড়ের কাছে যেসব দর্শক জড়ো হয়েছে, তারা কলরব করে তাদের উল্লাস প্রকাশ করছে। খোঁয়াড়ে সে সময় সত্যিই একটা মজার নাটক হয়ে গেছে। বরেৎস্ পরিখায় নেমেছিল ওদিকে কিছুদিন আগে যে ছানাটা চপেটাঘাত খেয়েছিল সে ওপর থেকে নজর রাখে তার ওপর। পরিখা থেকে দেয়ালে ওঠার চেষ্টা করছিল ভালুকটা। পেছনের পায়ে খাড়া হয়ে সে নখ দিয়ে দেয়াল আঁকড়ে নিজেকে তুলতে চাইলি। এই সময় ভালুক ছানাটি এসে বাপকে তিনটি চড় কষে পড়ি-মরি ছুটে পালায় মায়ের আশ্রয়ে…..
Leave a Reply