পিওতর মান্তেইফেল
ট্রেনিং না নিলে
মস্কো চিড়িয়াখানার কিছু পোষ্য তিতির, খরগোস, গাইয়ে পাখি এরা তাদের শৈশব কাটিয়েছে ছোটো ছোটো খাঁচায় বসে। কীভাবে ওরা বাড়ছে সেদিকে অবিরাম নজর রাখতাম আমরা। মনে হল তাদের বাড়ে শঙ্কার কিছু নেই। স্বাভাবিকভাবেই বড়ো হচ্ছে, দানাপানি পাচ্ছে চমৎকার, শুধু খাঁচার আয়তন অনুসারে এদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ।
ক্রমে ক্রমে বাচ্চারা বড়ো হল, যে পরীক্ষাটা শুরু করেছিলাম সেটা শেষ করব ঠিক করলাম। পশুদের বিকাশের ওপর খাঁচার আয়তনের প্রভাব কী, তাই নিয়ে পরীক্ষাটা। শুরু হল খরগোস দিয়ে। বেড়ে উঠেছিল সে ছোট্ট সংকীর্ণ এক খাঁচায়। সেখান থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হল একটা বিস্তীর্ণ ঘাস-জমিতে। বসে তাকিয়ে দেখতে লাগল খরগোসটা। চোখ ধাঁধানো রোদ। এখানে-ওখানে রঙচঙে ফুল, জ্বলজ্বলে গালিচায় ঢাকা জমি। চারিপাশেই একটা অনভ্যস্ত বিস্তার। খরগোসটা একটা চড়া লাফ দিলে, তারপর আরো, আরো। প্রতি মুহূর্তেই যেন সে উদ্দাম হয়ে উঠছে। তারপর ফের পেছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠল শূন্যে এবং পড়ল নিশ্চল হয়ে। কাছে এগিয়ে গেলাম। কী ব্যাপার? মরে গেছে খরগোসটা। লাস কেটে বোঝা গেল হার্টের আকস্মিক পক্ষাঘাতে মৃত্যু।
ছোট্টো একটা খাঁচায় বেড়ে উঠেছিল তিতির পাখি। সারা জীবনেও কখনো সে ওড়ে নি, তার জেরাটা ছিল বড়োই সংকীর্ণ।
একানব্বই দিনের দিন তার লেজে পেখম গজাল, হয়ে উঠল সে কালচে রঙের এক বাহারে পাখি, বয়স্ক তিতিরদের সঙ্গে তার কোনোই তফাৎ নেই রঙে। বসন্তে তাকে ছাড়া হল বড়ো একটা জায়গায়, মাদী তিতিররা থাকত সেখানে। খোলা- মেলায় সেই তার প্রথম ও শেষ দিন। মুক্ত বন্দী তার লেজ মেলে ডেকে উঠল, বকবকম করে গাইলে তার বিয়ের গান। ঘুরপাক খেলে সঙ্গমের সময়ের মত্যে, তারপর হঠাৎ চিৎপাত হয়ে পড়ল, কয়েকবার খিচুনি খেয়ে নিথর হয়ে গেল। ডাক্তারী তদন্তে দেখা গেল মৃত্যু হয়েছে মহাধমনী ফেটে গিয়ে।
এইভাবেই মারা যায় ছোটো খাঁচায় বেড়ে ওঠা নাইটিঙ্গেল। চড়া গলায় প্রথম ডেকে উঠতেই সে ডাল থেকে পড়ে যায় মরা। প্রচণ্ড রক্তস্রাব শুরু হয় তার। এসব পরীক্ষা থেকে কী বোঝা গেল?
বোঝা গেল এই যে প্রাণীদের মুক্ত জীবনের ওড়া, লাফ-ঝাঁপ এবং অন্যান্য দেহচর্চ’। না থাকায় তাদের ভেতরের প্রত্যঙ্গ যথেষ্ট তালিম পায় না। হার্ট আর ধমনীর গা হয় না মজবুত, স্থিতিস্থাপকতা তাদের কম, বর্ধিত রক্তের চাপ সইতে পারে না। এমনকি সদ্য বাসা ছেড়ে উড়ে যাওয়া বাচ্চা পাখিও অনেক সময়, মারা পড়ে হার্টের শক ও আভ্যন্তরীণ রক্তস্রাবে। সাধারণত সেটা ঘটে বাজ বা অন্য কোনো শিকারী পাখি থেকে আত্মরক্ষার সময়। একবার শুনেছিলাম, বাজপাখির তাড়া খেয়ে একঝাঁক স্টার্লিং থেকে অল্পবয়সী কয়েকটা পাখি পড়ে গিয়েছিল মাঠে। শিকারীর আচমকা গুলির শব্দে চকে গিয়ে দ্রুত ডানা নেড়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে তরুণ মরাল মরে পড়েছে, এমন ঘটনাও কম নেই।
‘স্থিতু জীবনে’ সবচেয়ে কষ্ট শশকের। শোনিতবাহী ব্যবস্থার কার্যক্ষমতার তুলনায় তার পেছনের পায়ের পেশী হয় অনেক শক্তিশালী, ছুটে খাবার খেতে যাবার সুযোগ পেলে তাদের বেমজবুত হাড় প্রায়ই ভেঙে যায়। এমনকি সাবালক খরগোসও ২২-২৫ দিন সংকীর্ণ খাঁচায় থাকার পর দৌড়তে গিয়ে তাদের কয়েকটার পেছনের পায়ের হাড় ভেঙেছে; এটা দেখা গেছে সাইবেরিয়ার খরগোসদের ছেড়ে দিয়ে।
ঠিক তিতির, নাইটিঙ্গেল, খরগোসের মতোই চিড়িয়াখানায় মারা যায় দুটো বাদামী ভালুক। প্রথমে তারা ছিল খুব ছোটো জায়গায়, সেখান থেকে তাদের জোর করে নিয়ে আসা হয় নতুন একটা বড়োসড়ো খাঁচায়। গতির অনভ্যন্ত প্রখরতায় তাদের রক্তের চাপ খুব বাড়ে, আভ্যন্তরীণ রক্তস্রাবে মারা যায় তারা। একবার শিকারীর কাছ থেকে সদ্য পাওয়া একটা শাদ। খরগোস খোলা খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে যায়। পরিখাটা লাফিয়ে পেরিয়ে গিয়ে সে পৌঁছয় বাদামী ভালুক বরেৎসের খোঁয়াড়ে। লাফাতে ভালুকটা পেছ নেয় খরগোসের, কিন্তু আশ্চর্য চাতুর্যে খরগোস তাকে লাফাতে এড়িয়ে এড়িয়ে যায়; বরেৎস্ কিছুতেই তাকে ধরতে পারে না। অনূসরকের হাত ফসকে ক্ষিপ্র খরগোস দু’ মিটার লম্বা ঝাঁপ দিয়ে পাশের দেয়ালের কুলুঙ্গিতে পাথরের সঙ্গে সে’টে থাকে ভালুকের নজর এড়িয়ে। সমস্ত আড়াল-আবডাল দেখল ভালুকটা, তারপর পেছনের পায়ে খাড়া হয়ে গন্ধ শুকেতে লাগল। মিনিটখানেক শশুকেই সে মন দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগল দেয়ালের এবড়ো-খেবড়ো জায়গাগুলো, তারপর শেষ পর্যন্ত গন্ধে গন্ধে বার করে ফেললে। ঝাঁকড়া অনুসরক সন্তর্পণে সামনের দুই থাবা প্রসারিত করে গেল দেয়ালের কাছে, কিন্তু খরগোসটা আচমকা লাফ দিল ভালুকের মাথার ওপর দিয়ে। বরেৎস্ তাকে ধরতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে। অনুসরণ চলেছিল এর পরেও। আরো ঘণ্টা দুয়েক ভালুকটা খোঁয়াড় চূড়ে বেড়ায়, এক কোণায় ক্ষিপ্র দৌড়বাজটিকে সে থাবার ঘায়ে মারতে পারে কেবল দৈবাৎ।
এই ছোটাছুটির দরুন দশাসই জানোয়ারটাকে খেসারত দিতে হয় কম নয়: অনভ্যাসের ফলে এমন সে জেরবার হয়ে যায় যে দু’দিন ধরে কিছু মুখে তোলে না, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকত, একটু নড়তে-চড়তে গেলেই ককাত। বছরের পর বছর চিড়িয়াখানায় থাকায় বড়ো রকমের চাপ সহ্য করতে তার পেশী অনভ্যস্ত।
Leave a Reply