পিওতর মান্তেইফেল
কাস্কীর আর কাঙ্ক্ষীরকা
মস্কোর চিড়িয়াখানায় আসে অল্পবয়সী দুটি নেকড়ে। দুটিতে ভাই-বোন, নাম কাঙ্ক্ষীর আর কাঙ্ক্ষীরকা, কাজাখ ভাষায় যার অর্থ ‘নেকড়ে’ আর ‘নেকড়ী’। আনা হয় তা আরল সাগরের উত্তর-পশ্চিমের ‘বড়ো বারসুকি’ মরুভূমি থেকে।
চিড়িয়াখানার খাঁচায় দিন কাটিয়ে গেছে অনেক নেকড়েই, তাদের ভেতরে তফাৎও খুব আছে: কেউ সহজেই বশ মানে, যদিও ধরা পড়ার সময় ছিল বেশ বয়স্কই। ছোটোতেই কারো কারো মধ্যে দেখা দেয় শ্বাপদের হিংস্রতা। কাঙ্ক্ষীর আর কাঙ্ক্ষীরকা প্রথম দিন থেকেই ছিল অসাধারণ শান্ত, চট করেই তারা একেবারে পোষ মেনে গেল।
শ্রমিকদের ক্লাবে, লাল ফৌজী ইউনিটে, স্কুলে বক্তৃতা দেবার সময় আমি তাদের নিয়ে যেতে শুরু করলাম। অল্প দিনের মধ্যে জীবন্ত প্রদর্শন-দ্রব্যের ভূমিকা রপ্ত করে নিলে দু’জনেই, সাগ্রহেই লাফিয়ে উঠত মোটরে, বক্তার সামনের টেবিলে বাধ্যের মতো বসে থাকত, মন দিয়ে তাকে আর শ্রোতাদের দেখত।
চিড়িয়াখানার বড়ো একটা জনবহুল প্রেক্ষাগৃহে আমি গৃহপালিত কুকুরের উৎপত্তির কথা বলছিলাম, আর উইঙ্গের পেছনে চর্মরজ্জতে বাঁধা কাঙ্ক্ষীরকা বসে বসে অপেক্ষা করছিল কখন মঞ্চে যাবার ডাক পড়বে। যখন নেকড়ীকে দেখাবার সময় হল, তাকে স্বস্থানে পাওয়া গেল না। একা একা বসে থাকতে বিরক্তি ধরে যাওয়ায় সে বগলস খুলে উধাও হয়েছে।
আমরা প্রমাদ গণলাম: সে সময় চিড়িয়াখানা যে লোকে লোকারণ্য। কিন্তু কাঙ্ক্ষীরকার স্বভাব খুব নিরীহ। দর্শকদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে সে শান্তভাবে ছুটে যায় তার নিজের খাঁচার দিকে। পলাতকাকে আমরা পাই সেখানেই। ঠিক দুয়োরের সামনে বসে বসে সে ভেতরে ঢোকার জন্যে মিনতি করছিল।
আরেকবার জামো ভোরেচিয়ে’তে বক্তৃতার সময় পালিয়ে গিয়ে কাঙ্ক্ষীরকা আমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আরো বেশি। কিন্তু এবারেও আমাদের আতঙ্কটা দেখা গেল অনাবশ্যক। বক্তৃতাস্থলে মোটরে করে এলেও সে ঠিক পথ খুঁজে পৌঁছয় চিড়িয়াখানায়। কারো ক্ষতি করে না।
বোঝা যাচ্ছে, রাস্তায় কেউ নেকড়ের দিকে নজর করে নি, কারো চোখে পড়লে ভেবেছে বড়ো একটা অ্যালসেশিয়ান।
যাদেরকে ভালো চিনত, তাদের প্রতি কাঙ্ক্ষীর আর কাঙ্ক্ষীরকা ছিল অসাধারণ সোহাগী। নেকড়ের নেকনজরে থাকা লোকেদের ওপর ‘আক্রমণের’ অভিনয় করে দেখেছি আমরা, মুহূর্তের মধ্যে তারা হিংস্র ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত।
কোনো রকম প্রাথমিক হুঁশিয়ারি না দিয়ে তারা চেষ্টা করত তক্ষুনি কামড়ে ধরতে। এইসব কল্পিত শত্রুদের ওরা অনেকদিন ভুলত না। ‘আক্রমণকারী’ পরে খাঁচার সামনে দেখা দিলেই তারা খেঁকিয়ে উঠত, ভাঙতে চাইত লোহার শিক।
পরে বড়ো হয় কাঙ্ক্ষীর আর কাঙ্ক্ষীরকা, একেবারে ঝুনো নেকড়ে। তাহলেও চেন না বেধে অবাধে তাদের নিয়ে ঘোরা যেত শহরের বাইরে। ‘নেকড়েকে যতই পোষো, নজর তার বনের দিকে’ এই লোকবচনের বিপরীতে কাঙ্ক্ষীর আর কাঙ্ক্ষীরকা কখনো মানুষের সঙ্গ ছেড়ে যেতে চায় নি।
নেকড়েদের জীবন ও চালচলন অনুধাবন করলে সত্যিসত্যিই নিঃসন্দেহ হতে হয় যে পরে প্রচুর সংখ্যক নানা জাতের গৃহপালিত কুকুর গড়ে উঠেছে যা থেকে, সেই বশীকরণ ও গৃহপালন একদা, মোটামুটি বিশ হাজার বছর আগে শুরু হয়েছিল এই জন্তুগুলো দিয়েই।
চিড়িয়াখানায় যারা প্রায়ই নেকড়েদের লক্ষ্য করেছে, তাদের চোখে পড়বে যে বাইরের চেহারায় তাদের একটা সাধারণ মিল থাকলেও নানান গুণের দিক দিয়ে তারা খুবই পৃথক। সুদূর অতীতে এই পার্থক্য থেকেই মানুষ কৃত্রিম বাছাই চালিয়ে বংশগত পরিবর্তন মারফত বিভিন্ন জাতের কুকুর পায়। প্রসঙ্গত, একেবারে সাধারণ নেকড়েকেও তালিম দিয়ে স্লেজে জোতার কাজে লাগানো যায়। চূড়ান্ত উত্তরাঞ্চলে এ কাজে কোনো কুকুরই নেকড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না, কেননা শক্তি ও সহাগুণে সবাই তারা হার মানে নেকড়ের কাছে।
পোষমানানো, গৃহপালিত নেকড়ে থেকেই এসেছে মানববন্ধ, ঘরোয়া কুকুর। এটা অতীত কালে নেকড়ের সদর্থক ভূমিকা। কিন্তু এখন পশুপালন ও প্রয়োজনীয় আরণ্যক পশুর যে ক্ষতি বুনো নেকড়ে করে তা সইবার নয়।
Leave a Reply