পিওতর মান্তেইফেল
জিন-দাউ
মস্কোর চিড়িয়াখানায় ভারতীয় মাদী হাতি জিন-দাউ কাটায় বারো বছর। চিড়িয়াখানায় আসার আগে সে বড়ো বড়ো রোলার টেনে দুরমুশ করে বেরিয়েছে বোখারার রাস্তা, গাছ উপড়েছে। গৃহযুদ্ধের সময় কামান টেনেছে জিন-দাউ।
বোখারায় হাতিটা ছিল খোলা। খুব গরম পড়লে তাকে দেখা যেত বাগানে, গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে ঢুলত।
পরে মস্কো চিড়িয়াখানা উপহার পায় জিন-দাউকে। তখন সমস্যা দেখা দেয়: কি করে এই বিপুল জীবটিকে আনা যায় রাজধানীতে? মাল-ট্রেনের কোনো গাড়িতেই সে আঁটবে না, আর খোলা প্ল্যাটফর্মে চাপিয়ে আনাটা আমাদের মনে হয়েছিল বিপজ্জনক। শেষ পর্যন্ত চার অক্ষের বড়ো একটা প্ল্যাটফর্মের ওপর জিন- দাউ’এর জন্যে ঠাঁই বানানো ঠিক হল।
জিনিসটা বানাবার পর হাতিটাকে তাতে তোলার পালা। ওঠার আগে অনেকখন সে শুড় আর পা দিয়ে তার ‘কুপে’র মজবুতি পরখ করে।
তাহলেও সে উঠল তাতে, বন্ধ হল তার চলমান খোঁয়াড়ের দরজা।
ইজিন লাগল। সন্তর্পণে ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ল ধীরে ধীরে। কিন্তু স্থানান্তর গমনের অনভ্যন্ত এই পদ্ধতিটায় তক্ষুনি অশান্ত হয়ে উঠল জিন-দাউ। অস্থির হয়ে সে তার জন্যে অমন মজবুত করে বানানো জিনিসটা কয়েক মিনিটেই ভন্ডুল করে দিলে। শান্ত হল সে মাথার ওপর খোলা আকাশ দেখে। তাই খোলা প্ল্যাটফর্মে চাপিয়েই তাকে আনতে হল মস্কোয়।
পথে সে ভালোই চলেছিল। রেলপথের ওপর দিয়ে সেতুর খিলান দেখলে সে বসে পড়ত পা গুটিয়ে, আর উল্টো দিক থেকে ট্রেন এলে আমাদের গুরুতন ‘সহযাত্রিনী’ প্ল্যাটফর্মের বিপরীত দিকে ঘে’ষে যেত।
অমন অস্বাভাবিক একটা মাল যাচ্ছে ট্রেনে, এ খবর ছড়িয়ে পড়েছিল, ইঞ্জিনের গতির চেয়েও তাড়াতাড়ি, ভিড় জমত স্টেশনে। জিন-দাউ নিশ্চিন্তে শুড় বাড়িয়ে দিত তাদের দিকে, ভালো-মন্দ খাবার চাইত। অকাতরে লোকেরা দিত রুটি, তরমুজ, বাঙি।
একটা স্টেশনে জিন-দাউ হঠাৎ গর্জন করে শুড় দিয়ে একটা ঢেঙা ছোকরাকে তুলে নিয়ে ভিড়ের মাথার ওপর দিয়ে তাকে ছুড়ে ফেলে রাস্তার পাশের ঝোপের ভেতর। ভাগ্যি ভালো ছোকরা অল্পেই পার পায়। তক্ষুনি সে কবুল করে যে হাতির শুড়ে পিন ফুটিয়ে দিয়েছিল…
শেষ পর্যন্ত ১৯২৪ সালের ৭ই জুলাই ট্রেন পৌঁছল মস্কোয়। স্টেশন থেকে চিড়িয়াখানার উদ্দেশে জিন-দাউ রওনা দিলে রাত তিনটেয়। বিরাট পশুটার ঘাড়ের ওপর বসলে মাহত।
অত রাত সত্ত্বেও প্রচুর লোক হাতিটার সঙ্গে সঙ্গে আসে চিড়িয়াখানার দেউড়ি পর্যন্ত।
অসম্ভব জোর ছিল জিন-দাউ’এর। বেরিয়ে বেড়াবার বাসনায় সে ধীরেসুস্থে বেকিয়ে দেয় পার্টিশনের জগদ্দল লোহার থাম। একবার তার ঘরের ভারি দরজাটার রোলার সরে গিয়ে সেটা তার রেলের খাঁজ থেকে পড়ে যায়। একদল লোক শাবল ডান্ডা নিয়ে সেটাকে নড়াতে পারে না।
নানা রকম হাতলের সাহায্যে লোকেরা বিশমনী লোহার পাতটাকে স্বস্থানে বসাবার চেষ্টা করে ঘণ্টাখানেক ধরে, কিন্তু হয় না কিছুই। তখন রসিকতা করে কে একজন ডাকে জিন-দাউকে। তক্ষুনি সে আসে, সন্তর্পণে লোকেদের সরিয়ে দেয় কাছ থেকে, শড়ে দিয়ে হ্যাঁচকা টান দিলে দরজায়। অমনি সেটা উঠে গেল রেলের খাঁজে।
ঘুমবার সময় হাতিটা কাত হয়ে শুয়ে পা টান করে দিত। গোটা বাড়িটা ভরে উঠত তার নাক-ডাকায়। কিন্তু একটু উদ্বেগের কারণ ঘটলেই সে এমন ক্ষিপ্রতা ও লঘুতায় খাড়া হয়ে উঠত যা অমন সুবিশাল, বেঢপ দেখতে একটা পশুর ক্ষেত্রে আদৌ কল্পনা করা যায় না।
হাতিরা যখন বনে থাকে, তখন তাদের নখ আর পায়ের তলাকার চামড়া আপনা থেকে পাথরে লেগে বন্ধুর মাটিতে ঘষা খেয়ে ক্ষয়ে যায়। কিন্তু আটকা থাকলে তা বেড়ে ওঠে, তাই কেটে ফেলতে হয় তা। অস্ত্রোপচারটা কখনো কখনো যন্ত্রণাকর, কিন্তু জিন-দাউ তা সহ্য করত বেশ শান্তভাবেই। কিন্তু অসহ্য হয়ে উঠলে রেগে শশুড় দিয়ে ঘা মারত মেঝেতে, যেন খানিকটা বিরাম দিতে বলছে।
একবার এই কাজটা যখন চলছে, তখন বারকয়েক জোরে জোরে তার শুড় আছড়ানো, এমনকি ভীতিপ্রদ কর্ণভেদী ডাকেও লোকটা কান দেয় নি। উখো দিয়ে সে ঘষেই চলছিল তার নখ। জিন-দাউ তখন সাবধানে লোকটার ঘাড় ধরে তুলে বাতাসে কয়েকবার ঝাঁকিয়ে নিজের ডেরা থেকে ছাঁড়ে দেয় দুটো লোহার থাম্বার মাঝখানে…
চিড়িয়াখানায় থাকার শেষ দুই বছরে ভারি স্থবির হয়ে পড়ে জিন-দাউ। বারকয়েক বেশ ভুগল সে, দ্রুত জরার লক্ষণ ফুটে উঠতে লাগল পরিষ্কার। বয়স তখন তার বাহান্নের মতো। প্রায়ই শুয়ে থাকত সে, হাঁটত পা ছে’চড়ে ছে’চড়ে।
জায়গাটা পুনর্নির্মাণের সময় হাতিদের স্থানান্তরিত করা হয় হরিণ এলাকায়। সেখানে তাদের বিশেষ সুবিধা লাগছিল না। এমনকি ঘুমোবার জন্যেও শুতে চাইত না জিন-দাউ। মোটা জালি-বেড়ায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমত সে। ফলে সেটা ভয়ানক বে’কে যায়।
১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে শুল হাতিটা, তারপর আর ওঠে নি। তার বান্ধবী, তরুণী হস্তিনী মানুকা হয়ে উঠল উদ্বিগ্ন। শড় দিয়ে সে মুছে দিতে লাগল জিন- দাউ’এর বুড়ো পা, চেষ্টা করল তাকে তুলতে, কিন্তু সবই বৃথা!
দু’দিন পরে (২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৩৬) মারা গেল জিন-দাউ।
শব-ব্যবচ্ছেদ করে দেখা গেল তার কশের প্রকান্ড প্রকান্ড চারটে দাঁত ভয়ানক ক্ষয়ে গিয়েছিল।
শেষ বয়সে জিন-দাউ আর খাবার চিবাতে পারত না, তা গিয়ে পড়ত দাঁতের ফুটোয়, মাড়ি আর দাঁতের মাঝখানগুলো ভরে তুলত। বিশাল হাতিটার প্রত্যেকটা প্রত্যঙ্গই হয়ে গিয়েছিল ভারি জীর্ণ আর জরাগ্রস্ত।
আর তাদের আয়তন আর ওজন অবাক করার মতো। যেমন, এক-একটা কিডনির ওজন ১৬ কিলোগ্রাম করে, পিলে ২ মিটার লম্বা, শ্বাসনালীর ব্যাস ৭ সেপ্টিমিটার। অন্ধের মোট দৈর্ঘ্য ৩০ মিটারের বেশি।
ফুসফুসের ওজন ১০০ কিলোগ্রাম! আরেকটা ব্যাপার, জিন-দাউ’এর মাথার খিল, ৪৪২০ গ্রাম, সাধারণ মানের চেয়ে প্রায় দেড় কিলোগ্রাম বেশি।
আমরা যখন বলতাম যে জিন-দাউ বার্ধক্যে মারা গেছে, তখন হতভম্ব হয়ে অনেকে জিজ্ঞেস করেছে: ‘বার্ধক্য কোথায়? ওর তো পঞ্চান্নও হয় নি, কিন্তু শোনা যায় হাতি বাঁচে দু’শ বছর!’
কিন্তু কথায় বলে, যা ঘটনা তা ঘটনাই। বাস্তবে ও গুজবটা সমর্থিত হয় নি। ফুউয়েরের তথ্য অনুসারে ইউরোপের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় চুয়াল্লিশটি ভারতীয় হাতির মধ্যে কেবল একটা মর্দা বাঁচে বড়ো জোর চল্লিশ বছর, শুধু তিনটে মাদী টিকে থাকে পঞ্চাশ-একান্ন বৎসর পর্যন্ত।
সাধারণত, এই যেসব জন্তুর সবকিছু নির্ভর করে তাদের দাঁতের ওপর, তাদের আয়ু আরো বেশি হবে সেটা অনুমান করা কঠিন। হাতির কশের দাঁত মাত্র চারটে:
দুটো ওপরের চোয়ালে, দুটো নিচে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড এই দাঁত দিয়ে সে যাঁতার মতো মোটা মোটা ডালও গগুড়িয়ে দেয়। ক্রমে ক্ষয়ে যায় দাঁত, আবার নতুন দাঁত ওঠে (জীবৎ-কালে ছয় বার)। শেষ দাঁত ওঠে চল্লিশ বছর বয়সে, তারপর বছর দশেকের মধ্যে তা খুবই ক্ষয়ে যায়। জিন-দাউ’এর শেষ বারের দাঁত ওঠে মৃত্যুর দশ-এগারো বছর আগে। তাই অকালমৃত্যু তার হয় নি, বরং অনেক স্বগোত্রের চেয়ে বেশিই বে’চে ছিল সে।
Leave a Reply