মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
মাহমুদুল হক
‘নিজের সঙ্গে সংগ্রাম’ খোকা বললে।
‘আমার মতো!’
‘আপনারও তাই চলছে নাকি?’
‘চলছে তো বটেই, শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না; বল পাচ্ছি না দেহে, মাথা ভার হ’য়ে আছে, নাক-কান বুজে শুধু বিছানায় প’ড়ে থাকতে ইচ্ছে করে।’
নীলাভাবী বললে, ‘শরীর ঠিকই আছে, চিন্তায় চিন্তায় অমন হয়েছে ওনার। দিনকাল খারাপ, ঐ সাত রাজার ধন নিয়ে বাইরে যাবেই বা কিভাবে, বুঝলে না?’
‘তুমি তো বলবেই–‘
‘বলবো না কেন, কথাটা কি মিথ্যে? কবে তোমার শরীর খারাপ করেছে শুনি? দু’ডিগ্রী জ্বর নিয়েও তো বাইরে দৌড়ও, পাগলের ছাঁট আছে মাথায়!’
‘একেবারে পাগল হ’তে পারলে তো ভালোই ছিলো, আধা আধা কোনো কিছুই ভালো না, খোকা কি বলো?’
নীলাভাবী রজ্জুকে নিয়ে অন্য ঘরে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাজীব ভাই কালিপড়া রুগ্ন চোখ তুলে জিগ্যেশ করলে, ‘কি রকম বুঝছো সবকিছু?’
খোকা বললে, ‘মহাদুর্দিন সামনে সবাই বলছে, আমার মাথায় তো কিছুই আসে না। এতসব আলাপ-আলোচনারই বা দরকার কি? এক একবার মনে হচ্ছে সব মিটমাট হ’য়ে যাবে, কখনো মনে হচ্ছে সবটাই একটা ফাঁকি, কোনটাকে ছেড়ে কোনটাকে বিশ্বাস করবো বুঝি না!’
সিগ্রেট ধরিয়ে ঘন ঘন টান মারতে লাগলো রাজীব ভাই। রাজীব ভাইয়ের রুক্ষ চোয়াল বিশ্রীভাবে ঠেলে বেরিয়েছে, দাড়ি না চাঁচায় পাগল পাগল চেহারা। গর্তে বসা চোখ, দুশ্চিন্তার রেখা কপালে।
খোকা বললে, ‘শেষ পরিণতিটা কি, বুঝতে পারছেন কিছু?’
‘আমি কেন, নেতারাও সেকথা পষ্ট ক’রে বলতে পারবে না। বুঝলে না, আমাদের নেতারাও অনেক সময় বুঝতে পারে না, তারা দাবার ঘুটিমাত্র, তাদের চালা হচ্ছে।’
‘আর সাধারণ মানুষ, তারা?’
‘মোটের ওপর তারা অতো ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। যে অর্থে তারা স্টেডিয়ামে চীনা এ্যাক্রোব্যাটদের শো দেখতে যায়, ঠিক সেই অর্থেই কিংবা সেই উদ্দীপনা নিয়েই পল্টনের মাঠে নেতাদের লেকচার শুনতে জড়ো হয়। যদি একদিকে স্বাধিকার আর অপরদিকে সস্তায় দু’গজ লংথ দেওয়া হয়, তাহলে আগে লংক্লথের লাইনেই তারা মারপিট করবে। তবে সাধারণ মানুষ আমূল পরিবর্তন চায়, একথাও সত্যি–‘
খোকা জিগ্যেশ করলে, ‘এ সম্পর্কে তাদের ধারণাটা কি রকম–‘
‘কারো সামনেই কোনো বাস্তব পরিকল্পনা নেই। সকলের দৃষ্টিই ঘোলা, আচ্ছন্ন। হওয়ার কথা তো এই রকমই; একে জানা নেই লেখাপড়া, তার ওপর দিনের পর দিন তারা প্রতারিত হয়েছে, চোখ ফুটবে কোথেকে? রাজনৈতিক দলগুলোর কথা ভেবে দেখ, কেবল নিজেদের প্রয়োজনে তারা জনসাধারণকে ব্যবহার করছে এইমাত্র, আর কোনো দায়দায়িত্ব ছিলো না কারো কখনো–‘
একটু থেমে রাজীব ভাই বললে, ‘এখন যে অবস্থা চলছে তাতে খুব বড় করে এইটুকুই বলা যায় আঁধার হাতড়ে বেড়ানো মানুষজন এখন কিছুটা ঐক্যবদ্ধ; এটা যদি ভেস্তে যায় দেশ অনেক পিছিয়ে যাবে–
‘কিন্তু এর পিছনেও তো দলীয় স্বার্থ রয়ে গেছে!’
Leave a Reply