মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
মাহমুদুল হক
রাজীব ভাই বললে, ‘তুমি অন্যদিকে যাচ্ছো। আমি যা বলছিলাম, বাইরে থেকে সামরিক শাসন যতো ভারী জগদ্দল পাথরই মনে হোক না কেন, তার ভিতরের সীমাহীন দুর্বলতার কথা এক ধাক্কায় জেনে গিয়েছে মানুষজন; বিচার করতে হবে এইভাবে–
খোকা বললে, ‘যারা এখানে পাহাড়প্রমাণ পুঁজি খাটিয়েছে, কিংবা যারা নিয়ন্ত্রিত পন্থায় বাজার হিশেবে পেতে চায় দেশটাকে, তাদের ভূমিকার কথা আপনাকে ভাবতে হবে। দেশের লোকটোক সব ফালতু কথা, তাদের কাঁউমাউ চিল্লাচিল্লিতে সত্যিই কিছু যায় আসে না, তা না হ’লে গোটা ব্যাপারটার সামনে এভাবে অনিশ্চয়তা ঝুলে থাকতো না–
‘তারাই বা কি করবে–‘ রাজীব ভাই বললে, ‘বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এতোদিন সুবিধাবাদীদের ম্যাজিক দেখতে দেখতে দেশের লোক কুঁজোব্যাকাবোবাহাবাকালা হ’য়ে গেছে; তা না হ’লে বৃটিশ সিংহকে খেদাবার পরও নতুন ক’রে আবার এই সাত তাড়াতাড়ি রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক মুক্তির দরকার হ’য়ে পড়বে কেন?’
‘মুক্তিটুক্তির কথা যে বলছেন, এ সম্পর্কে তাদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা আছে, কোনো প্রোগ্রাম আছে? অর্থনৈতিক মুক্তি ছেলের হাতের মোয়া নয়। খেলাকথা আর কি, বোবা-ব্যাঁকা-হাবা-কালা বেঁড়েদের ঐক্য আবার ঐক্য!’
‘কি আর করবে, সত্যিকার চেতনা আকাশ থেকে পড়ে না। রাষ্ট্রব্যবস্থার যাঁতাকলে মানুষজনকে এ যাবৎ শুধু পেষা হয়েছে, মাড়াই করা হয়েছে–‘
খোকা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললে, ‘অর্থনৈতিক মুক্তিটুক্তি ওসব হাফসোল দেওয়া কথা, বার্নিশ করা কথা, যে যার স্বার্থের কথা ভেবে পাগলা হ’য়ে উঠছে, সবাই ভাবছে যার যার নিজের হাতে চাঁদ পাবে। পোকাপড়া মুখ, পেট বোঝাই হিংসা, নিজেদের বলতে যাদের সম্বল শুধু এইটুকুই তাদের জড়িয়ে খোয়াব দেখার কোনো মানে হয় না। মাথায় বেঁড়ে, চিন্তায় বেঁড়ে, নিজেদের সম্পর্কে কতোগুলো আজগুবি গালগপ্পো সৃষ্টি ক’রে বুক ফুলিয়ে রেখেছে-‘
‘যতো কথাই বলো, এবারের ব্যাপার কিন্তু অন্যরকম।’
খোকা বললে, ‘যে রকমই হোক, আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি ভাবছি আমাদের কি হবে।’
‘তাহলে দেখ, তোমাকেও ভাবতে হচ্ছে–‘ রাজীব ভাই হেসে বললে, ‘সকলের যা হবে আমাদেরও তাই, রক্ত দেবার জন্যে সারা দেশের লোক পাগল হ’য়ে আছে–‘
‘গ্রামে পালাচ্ছে কারা?’
‘এক একজন এক একভাবে রক্ত দেয়। পুশকিনের মতো লোকদের ডুয়েলে রক্ত দিতে হয়; কেননা তাদের শরীরে কোনো হ্যানিবলের রক্ত, আবার মারার মতো লোকেরা গরম পানির চৌবাচ্চায় শরীর জুবড়ে রক্ত দেয়, তাদের শরীর ভরা চর্মরোগ–‘
একটু ভেবে খোকা বললে, ‘খেয়াল ক’রে দেখেছেন, সারারাত কিভাবে কুকুর কাঁদে?’
Leave a Reply