বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১০ অপরাহ্ন

জীবন আমার বোন (পর্ব-৯৪)

  • Update Time : শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

বাধা দিয়ে নীলাভাবী বললে, ‘তোমারও বাতিক কম নয়, পাগলকে সাঁকো নাড়া দেয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো। এক্ষুণি ওষুধ গেলানোর মতো গালগপ্পো ফেঁদে বসবে।’

‘ঠিক আছে বাবা, এই আমার মুখে তালাচাবি- রাজীব ভাই টুর্মেলিন সুটকেসে তুলে রেখে বললে, ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না?

রঞ্জুর কাঁধে একটা হাত রেখে নীলাভাবী বললে, ‘যা ভালো মেয়ে, এতো ভালো লেগেছে আমার ওকে–

খোকা বললে, ‘বোনটা কার তা দেখতে হবে না।’

‘আকাশ-পাতাল তফাত, এখন বুঝতে পারছি কেন এতোদিন আনোনি। নিজের নাক কাটা যাবার ভয় ছিলো তোমার।’

‘ভালো–‘

‘আমার কি ইচ্ছে করে জানো’ রঞ্জুর একটা হাত ধ’রে নীলাভাবী বললে, ‘আমার ইচ্ছে করে ওকে একরাশ পুতুল কিনে দেই, ও খেলুক, সারাদিন ব’সে ব’সে তাই দেখি।’

খোকা বললে, ‘কিরে নিবি নাকি?’

রঞ্জ মুখ টিপে হেসে বললে, ‘যদি সারাদিন খেলতে হয়!’

‘তবেই বোঝ–‘

‘সত্যি ওকে আমার এতো ভালো লেগেছে–‘

ভিতরে ভিতরে ক্ষেপে ওঠে খোকা। সে মনে মনে বলতে থাকে, কাকেই বা অপছন্দ তোমার! তুমি যদি একটা বাইসন হও রঞ্জ একটা হরিণছানা, তুমি লুলু চৌধুরী সব এক গোয়ালের গরু, মালটানা গাব্দাগোব্দা লেল্যান্ড ট্রাক-বিশেষ, চাকার তলায় পড়লে খেল খতম, গনফট্।

‘এবার থেকে সবসময় ওকে নিয়ে আসবে–‘

তা না হলে সুবিধে হবে কেন, ওর মাথাটি ভালো মতন চিবিয়ে খেতে হবে না, পারলে বলেই ফেলতো খোকা, কিন্তু রঞ্জু থাকায় সে বিজ্ঞের মতো নীরবে তাকিয়ে রইলো, কোনো উত্তর দিলো না।

নীলাভাবীর মাথায় গুচ্ছের চুল। রঞ্জু পাটির মতো বিনুনি ক’রে দিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে খোকাকে দেখালো নীলাভাবী। খোকার মনে হ’লো বাড়াবাড়ি, রঞ্জটাও যেন দিনকে দিন ঠুনকো হ’য়ে উঠছে, কিসের এতো মাখামাখি, খোকার কাছে এসব প্লাস্টিকের ফুলের মতো খেলো মনে হয়।

খুব সম্ভব সুযোগ খুঁজছিলো নীলাভাবী। একফাঁকে খোকাকে একা পেয়ে ভুরু তুলে জিগোশ করলে, ‘কি ব্যাপার, কেমন যেন একটু রাগ রাগ ভাব দেখছি তোমার?’

‘তা তো দেখবেই, খুঁটে ঘা করা যাদের অভ্যেস তারা অমন দেখেই।’

‘আমাকে দেখে তুমি বিরক্ত হও–‘

‘তুমি নিজেই একটা বিরক্তি।’

‘নতুন ক’রে কোথাও প্রেমে পড়েছো নাকি?’

‘প্রেম ছাড়া তুমি কি আর কিছু শেখোনি?’

‘বড্ড ঠোঁটকাটা হ’য়ে যাচ্ছো দিনকে দিন, কি হয়েছে কি তোমার? ঘাড়ে নতুন কোনো ভূত ভর করেছে, বুঝতে পারছি। চুলোয় যাক, নিয়ে যাচ্ছো তো? কি ঠিক করলে?’

‘আমি কোথায় নিয়ে যাবো?’

একটা হাত চেপে ধরলো নীলাভাবী। বললে, ‘তুমি ছাড়া আর কে নিয়ে যাবে? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক, যে খেয়ে ফেলবো, না খোঁপার ভিতর সাপ রাখি? এতো ভয় কেন?’

‘আমি কোনো ল্যাঠার ভিতরে নেই।’

‘আমি বুঝি তাই–‘

‘তবে কি! অন্যের ঝক্কি নিজের কাঁধে নিতে যাবো কেন, আমাকে তো আর ভূতে ধরেনি। এ ভারি অন্যায় আবদার!’

‘বড় নিষ্ঠুর তুমি!’

‘সর্বনাশ, এতো অল্পেই তোমার কান্না আসে!’

সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলো নীলাভাবী। কান্নায় বিকৃত হ’য়ে গিয়েছিলো গলার স্বর। চোখ মুছে বললে, ‘কারো উপরেই তোমার শ্রদ্ধা নেই, ভেবেছো এই ক’রে সুখ পাবে জীবনে। কোনোদিন পাবে না। দগ্ধে দগ্ধে কালি হ’য়ে যাবে তোমার অন্তর, কোনোদিন তুমি সুখী হ’তে পারবে না, কক্ষনো না–

খোকা হেসে নরোম ক’রে বললে, ‘ভারি একটা মানুষ আমি, অথচ ভোজালি গুঁজতে হবে কোমরে; ঠিক আছে, চেষ্টা ক’রে দেখবো কোনো ব্যবস্থা হয় কি না!’

‘বিশ্বাস করো,’ নীলাভাবী আকুল হ’য়ে বললে, ‘আমি মরে যাচ্ছি,

বিশ্বাস করো খোকাবাবু, আমি মরে যাচ্ছি, আমি হাঁপিয়ে পড়েছি এই সংসারের ভিতর, আর টানতে পারছি না, ঘেন্না ধ’রে গেছে আমার। এর ভিতরে আর কোন রস নেই, প্রাণ নেই, দিনরাত কবরের ভিতরে প’ড়ে আছি, আঁস্তাকুড়ে প’ড়ে আছি, আর পারছি না এভাবে। আমি তো একটা মানুষ-ই, কতো পারবো আর, শুধু জোড়াতালি, শুধু ভান, এই যে দিনের পর দিন হাবাকালার মতো সংসারের সঙ্গে আঠা হ’য়ে লেগে আছি এর চেয়ে ঘেন্নার আর কিছু নেই; অন্তত কিছুদিনের জন্যে তুমি আমাকে মুক্তি দাও। আমি পাগল হ’য়ে আছি একটু আলো-বাতাসের জন্যে–‘ ‘আমি ভেবেছিলাম অন্য ধাতের মেয়ে তুমি, তোমার গোড়া শক্ত।’

‘শক্তই। শক্ত না হ’লে এতোদিন ঘর করলাম কিভাবে, এখনো ঘানি টানছি কিভাবে? আমার দোষ কি জানো, আমি অভিনয় করে চলতে শিখিনি। কিন্তু এখন এমন একটা অবস্থা ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে তাই করতে হচ্ছে। এ আমি পারবো না। দিনের পর দিন শুধু দণ্ড দিয়ে যাবো, শুধু দণ্ড দিয়ে যাবো, এই চাও বুঝি তোমরা!’

ভিতরে ভিতরে দ’মে গিয়েছিলো খোকা। থলি ঝেড়ে এমন কিছুই সে পেল না যা দিয়ে এই মুহূর্তে তর্ক জুড়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে, ঘাসকুটো ঝেড়ে ফেলতে পারে গায়ের।

সে বললে, ‘সেদিন কিন্তু তুমি অন্যরকম বলেছিলে–‘

‘বলো, তুমি বুঝতে পারোনি–‘

‘কিন্তু কোথায় যেতে চাও?’

‘যেখানে খুশি, যেখানে তুমি নেবে, যেখানে আনন্দ, শুধু এই কবর থেকে আমাকে বের করো। সবকিছু অসহ্য হ’য়ে উঠেছে আমার কাছে, মনে হয় সবকিছু ভেঙে চুরমার ক’রে দেই, তছনছ ক’রে দেই, তারপর

ছুটে বেরিয়ে যাই দু’চোখ যেদিকে যায়–‘

‘দু’দিনের জন্যে হাওয়া বদল ক’রে কি কোন লাভ হবে, হয়তো আরো এলোমেলো হয়ে পড়বে মনের অবস্থা। ফিরে এসে আরো অসহ্য ঠেকবে সবকিছু তখন কি করবে?’

‘সে তখন দেখা যাবে।’

খোকা বললে, ‘কি লাভ, এইভাবে অশান্তি বাড়িয়ে?’

‘লাভ-লোকসানের কথা ভেবে শিকল তুলে ব’সে থাকতে পারবো

না। লাভ করতে নেমেও তো লোকে লোকসান করে। আমাকে নিয়ে তোমার অতো ভাবতে হবে না, তুমি পারবে কি না বলো–

খোকা নিস্পৃহ কণ্ঠে বললে, ‘দেখি, কি করা যায়।’

ক্ষেপে উঠলো নীলাভাবী। বললে, ‘আমি তোমার কাছ থেকে আধো আধো বুলি শুনতে চাইনি, পষ্ট জবাব দিতে হবে তোমাকে।’

খোকা তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে, ‘তাই ব’লে সুবিধে-অসুবিধের কথা ভাবতে দেবে না?’

‘এতো ভাবাভাবির কি আছে, তুমি তো আর আমাকে নিয়ে গা-ঢাকা দিচ্ছো না!’

‘তুমি কি তাই চাও?’

‘এতো বেশি চাওয়া যায় না। যার কাছে চাইবো তার নিজেরও কিছু দেবার ক্ষমতা থাকা চাই।’

খোকা বললে, ‘আমিও তাই বলি, নিজের উপরে আমার কোনো আস্থা নেই। তোমার কাঁধে এখন সৃষ্টিছাড়া নেশা চেপেছে, তুমি ছেলেখেলায় মেতে উঠেছো, পরে পস্তাবে, শুধু কাদা ঘাঁটাই সার হবে!’

‘আমার ভালোমন্দ নিয়ে অতো চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। আমি শুধু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাই। কেন আমি তিল তিল ক’রে নিজেকে এমন কষ্ট দেবো, দেখাই যাক না স্বার্থপর হ’তে পারি কি না। যেভাবে খুশি, যেখানে খুশি, তুমি আমাকে নিয়ে চলো, যেভাবে খুশি আমাকে কিছুদিনের জন্যে রেখে দাও, আমি আমার ভিতকে নড়াতে চাই–‘

খোকা মুমূর্ষু কণ্ঠে বললে, ‘তোমার সংসার?’

‘আগে ভেবেছিলাম ভালবাসার জন্যে মানুষ সংসার করে! চায়ের কাপ থেকে চেয়ার-টেবিল, সুই-সুতো থেকে খাট-পালঙ, কি না নেই সংসারে, শুধু ঐ ভালবাসা বস্তুটি ছাড়া। অথচ সংসারের ভিতরে দাঁড়িয়ে কি অহঙ্কারটাই না আমাদের, দেখে যাও কতো কিছু নিয়ে এই সংসার, কি না নেই এখানে! থুতু দিতে ইচ্ছে করে আমার, ইচ্ছে করে ঝাড়ুর বাড়ি মারি। জানালার কাচ ঝাপসা হ’লে মোছো, ঘরে ঝুলকালি ধরলে সাফ করো, হাঁড়ির তলার কালি মেজেঘষে ওঠাও, নরদমা সাফ করো, শুধু শিকেয় তুলে রাখো মনকে, দেখার দরকার নেই তার গায়ে ঝুলকালি পড়েছে কি না, সিটিয়ে যাচ্ছে কি না। সংসারের তুমি কতোটুকু জানো!

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024