পিওতর মান্তেইফেল
চিহ্ন আর তাড়া
বাচ্চা দিয়েই খরগোস চটপট তার ছানাদের গা চেটে দেয়, ছানারাও তাড়াতাড়ি করে মাই খোঁজে। ভরপেট দুধ খেয়ে, খানিকটা জিরিয়ে তারা নানান দিকে ছুটে যায়, তারপর দুই, তিন, এমনকি চার দিন পর্যন্ত ঘাসের মধ্যে বসে থাকে নিশ্চল হয়ে। এ দিনগুলোয় তারা কিছু খায় না, কেননা প্রথম বার খাওয়ার পর তাদের পেটে ঘন মাতৃস্তন্য থাকে প্রচুর, গরুর দুধের তুলনায় চবি’ তাতে ছ’গুণ বেশি। ছানাগুলো জায়গা না ছেড়ে যতক্ষণ নিশ্চল হয়ে বসে থাকছে, ততক্ষণ মা-ও তাদের খুঁজে পায় না। কেন? জিজ্ঞেস করবেন পাঠকেরা।
ওদের একটা বৈশিষ্ট্যের ফলে শত্রুর অনুসরণ থেকে ওরা বে’চে যায়।
খরগোসের গায়ের চামড়ায় ঘামের গ্ল্যান্ড নেই। সেটা থাকে কেবল তাদের থাবার তলে। লাফিয়ে লাফিয়ে যাবার সময় অনিবার্য’ই সে গন্ধের চিহ্ন রেখে যায়, তা অনুসরণ করে সহজেই তাকে আবিষ্কার করে হিংস্র পশু। কিন্তু মাটিতে থাবা চেপে যদি বসে থাকে খরগোস, তাহলে কুকুর বা কোনো বন্য শ্বাপদই তার অস্তিত্ব টের পাবে না। আবার খরগোসকে কুকুর যত বেশিক্ষণ ধরে তাড়া করবে, ততই বেশি ঘাম বেরয় খরগোসের গ্ল্যান্ড থেকে আর চিহ্নের গন্ধ হয়ে ওঠে ততই জোরালো।
সেইজন্যেই বহুক্ষণ আগে জোরে ছুটে যাওয়া খরগোসের পেছনে কুকুর তাড়া করে অমন একরোখা, অথচ গুপ্তস্থান থেকে সদ্য পালিয়ে যাওয়া অন্য খরগোসদের দিকে নজরও দেয় না। গুপ্তস্থানে খরগোস-ছানাদের গন্ধ আরো ক্ষীণ হয় এইজন্যে যে প্রথম দিন কোনো মলত্যাগ করে না তারা, তাদের দেহযন্ত্র দুধটা প্রায় পুরোপুরি আত্মস্থ করে, আর চর্বি ফুরিয়ে গিয়ে যে উদ্বৃত্ত জলটা থাকে সেটা খরচা হয় শ্বাসক্রিয়ায়। চিড়িয়াখানায় আমরা ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে-থাকা খরগোসদের খুব কাছ দিয়ে নিয়ে যাই চেন-বাঁধা একটা পোষা শেয়ালকে। তীক্ষ ঘ্রাণশক্তি থাকলেও শেয়াল কিন্তু একবারও টের পায় নি। এই একই শেয়াল খরগোসের চিহ্ন পেতেই তৎক্ষণাৎ উত্তেজিত হয়ে ছুটে যেতে চেয়েছিল সামনে।
খরগোসের থাবার গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত চর্বি-ঘাম যদি-বা হিংস্র পশুর কাছে তাকে ধরিয়ে দেয়, তাহলেও তাড়াতাড়ি যাবার সময় তাই আবার সাহায্য করে তাকে, এতে ঘন লোমে ঢাকা পায়ের পাতায় কাদা বা তুষার লেপটে যায় না, দ্রুত ছুটতে সুবিধা হয় তার ফলে।
এইখানে শেয়ালের চিহ্ন নিয়েও কয়েকটা কথা বলা যাক। প্রত্যেক শিকারীই জানে যে কুকুর আর শেয়ালের পায়ের চিহ্ন খুবই পৃথক। তুষারের ওপর কুকুরের পায়ের চিহ্ন পড়ে খুব সুস্পষ্ট, পায়ের ন্যাড়া তলি আর আঙুলের চড়া দাগ থাকে তাতে। শেয়ালের পায়ের ছাপ কিন্তু অনেক আবছা। তার কারণ, শেয়ালের পায়ের পাতা লম্বা লম্বা ঘন লোমে ঢাকা, তার ফলে শীতকালে সে যায় যেন ফেল্ট-বুট পরে।
এই বৈশিষ্ট্যের ফলে শেয়ালের থাবা জখম হয় না কখনো, এমনকি কড়া তুষারের চাঙড়ে ঠোকর খেলেও হয় না। কিন্তু একই মাঠে কুকুর দৌড়ে গেলেই তাদের পায়ের দাগে রক্ত দেখা যাবে। তবে শেয়ালের জীবনেও দুঃসময় আসে বৈকি। অগস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরে লোম পাল্টাবার সময় তার পায়ের তলির লোম উঠে যায়, এবং তার স্বাভাবিক ক্ষিপ্রতা হারায় সে। তারপর লোম উঠতে শুরু করে পায়ের তলিতে। প্রথমটা তা হয় খোঁচা খোঁচা, কড়া। তখন শেয়াল হাঁটে যেন পেরেকের ওপর দিয়ে, শিকারীরা যা বলে, ‘তার থাবা বাঁচিয়ে চলে’। এ সময় বেশিক্ষণ দৌড়তে পারে না শেয়াল, এমনকি বেজাত কুকুর তাকে ধরে ফেলতে পারে।
এর দিন ত্রিশেক পর পায়ের তলিতে লোম বেড়ে ওঠে, বে’কে গিয়ে তা ঢেকে ফেলে থাবাকে, তখন শেয়ালের বিপদের দিন শেষ।
Leave a Reply