শশাঙ্ক মণ্ডল
দ্বিতীয় অধ্যায়
ব্রিটিশ পূর্বযুগে গাঙ্গেয় ‘ব’-দ্বীপ অঞ্চলে বিশেষ করে সুন্দরবনের মধ্যে অসংখ্য নদী গঙ্গ এর বিশালধারাকে বিভিন্ন প্রবাহের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে পৌঁছে দিত। সেদিন এই অঞ্চল শস্য- সম্পদে পরিপূর্ণ একটি এলাকা হিসাবে বিদেশী পর্যটকদের কাছে স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছিল। বিখ্যাত নদী-বিজ্ঞানী Lyll গঙ্গার ‘ব’-দ্বীপ এর আলোচনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন- সমুদ্রতীরবর্তী সুন্দরবনাংশে আটটি প্রধান জলধারার মধ্যে দিয়ে বাংলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জল সমুদ্রে পৌঁছে যেত। এর ফলে নদীতে সব সময় ওপরের জলের চাপ থাকত এবং সমুদ্রের জোয়ারের জল দেশের অভ্যন্তরে বেশি দূর এগুতে পারত না। সুন্দরবনের পশ্চিমপ্রান্তে আজকের ২৪ পরগণার দক্ষিণাংশে নদীতে সবসময় মিষ্টি জলের প্রবাহ থাকত এবং সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলিতে চাষবাস সম্ভব হত, তার ফলে সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠতে পেরেছিল।
সুন্দরবনের প্রাচীন সভ্যতার ব্যাখ্যা খোঁজা যেতে পারে এইখানে। এই নদীগুলি মজে যাবার ফলে গঙ্গা-পদ্মার জলের মূল প্রবাহ পূর্বদিকে অন্য নদী দিয়ে বেশি বেশি করে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে এই নদীগুলি প্রয়োজনমত জলের অভাবে অর্ধমৃত হয়ে পড়ল। নদীতে ওপরের জলের চাপ না থাকায় জোয়ারের জল দেশের অভ্যন্তরে বেশি বেশি প্রবেশ করায় কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে গেল। মানুষ জীবিকার সন্ধানে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হল। জঙ্গলের সীমা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল এবং তা ব্রিটিশ আমলের পূর্বে সুন্দরবনে পরিণত হল- তাই বনের অভ্যন্তরে পাওয়া গেল অতীতের সমৃদ্ধ জনপদের অনেক চিহ্ন। (২)
সাড়ে তিনশ’ বছর পূর্বে দামোদর পূর্ববাহিনী হয়ে বেহুলা নদীপথে প্রবাহিত হয়ে ত্রিবেণী থেকে দামোদর গঙ্গার মিলিত প্রবাহ প্রধানত তিনটি পথে সাগরের দিকে এগুত। যমুনা নদী পূর্ববাহিনী হয়ে পরে দক্ষিণ-পূর্ব মুখী হয়ে ইছামতীর সাথে মিলিত হয়ে আরও দক্ষিণে কালিন্দী নাম ধারণ করে রায়মঙ্গল, হাঁড়িভাঙ্গা এর পথে সাগরে মিলিত হত। ইছামতীর এক শাখা যমুনা নামে পরিচিত হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের কালীগঞ্জ এর পাশ দিয়ে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী যশোর ঈশ্বরীপুরের পাশ দিয়ে সমুদ্রে পড়ত। প্রতাপাদিত্যের বিখ্যাত রণতরীগুলি এই যমুনা নদীতে নোঙর করা থাকত। যমুনা নদীতীরবর্তী প্রতাপের দুর্গের ভগ্নাবশেষ বিংশ শতকের শুরুতে যশোর খুলনার ইতিহাস লেখক সতীশ মিত্র লক্ষ করেছেন।
বিদ্যাধরী গঙ্গার একটা প্রধান শাখা হিসাবে সেদিন চিহ্নিত ছিল। ৫ম-৬ষ্ঠ শতকে বিদ্যাধরীকে ভাগীরথী বলা হত এটাই ছিল সে যুগের গঙ্গার মূল ধারা। কমলাকান্ত সার্বভৌম ‘দ্বিগঙ্গা রাজবংশম’, গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- ‘ভাগীরগী তীরে আছে দীর্ঘ গাঙ্গা গ্রাম’ অর্থাৎ আজকের দেগঙ্গা সেদিন ভাগীরথী-তীরের গ্রাম হিসাবে বর্ণিত হচ্ছে। রিবেণীর পরে মূল গঙ্গা থেকে বিদ্যাধরী বেরিয়ে এসে আজকের ২৪ পরগণার মধ্যে হাবড়া, দেগঙ্গা, বেড়াচাঁপা, হাড়োয়ার পাশ দিয়ে আরও দক্ষিণে নেমে মাতলা নদীতে মিলিত হত। শ্রীঠারবেকী মাতলা বিদ্যাধরীর মোহনায় সেদিনের বিখ্যাত পর্তুগিজ কদর তাড়দহের অবস্থান ছিল। সুপ্রাচীনকাল থেকেবিদ্যাধরীর এই প্রবাহ বণিকদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
Leave a Reply