পিওতর মান্তেইফেল
মরুর জাহাজ
ন্যায্যতই উটের নাম ‘ময়ূর জাহাজ’, শত শত বছর ধরে সে ছিল নির্জলা মরুভূমির আতপ্ত বালি অতিক্রমের একমাত্র উপায়।
আশ্চর্য তার সহ্যশক্তি। পেট পুরে একবার ভালো খাবার পেলে সে তার কাজে প্রচুর চর্বি জমিয়ে রাখে, তারপর জল বা খাবার না খেয়ে সে মরুভূমিতে চলতে পারে দশ দিন কি আরো বেশি। সত্যি, উটের কাজ হল দুই শতাধিক কিলোগ্রাম চর্বি’র ভাঁড়ার।
জলহীন বালি দিয়ে কারাভান চলছে এক সপ্তাহ, উটের খাবার মতো জল নেই কোথাও। উট কিন্তু দিব্যি এগিয়ে যায়, তেষ্টা নেই, কাহিল লাগে না তার। শুধু কাজে তার দিনে দিনে ছোটো হয়ে আসে। কোত্থেকে এই সহ্যশক্তি, লোকে বহুদিন ভেবে পায় নি। অনেক আষাঢ়ে গল্প আছে তাকে নিয়ে। এমনকি এও বলা হত যে উট দীর্ঘ যাত্রা আগে থেকেই টের পায়, তাই কারাভান রওনা দেবার আগে সে অস্বাভাবিক পরিমাণ জল খেয়ে নেয়, তা জমা থাকে তার জটিল পাকস্থলীর প্রথম দুই বিভাগে। বলাই বাহুল্য, এটা নেহাৎ গম্পো। মধ্য এশিয়ার মরুজীবন পর্যবেক্ষণ করার সময় আমরা একাধিকবার উটের দেহ ব্যবচ্ছেদ করেছি, কিন্তু তার পাকস্থলীতে কিছু ঝাঁঝালো দুর্গন্ধী তরল পদার্থ ছাড়া আর কিছু আমরা কখনো দেখি নি, আর পশুদের ক্ষেত্রে যা হয়, তাতে কিলবিল করেছে কেবল ইনফিউজোরিয়া আর বীজাণু।
‘কিন্তু’মর, ভূমির জাহাজ” জল পায় কোত্থেকে?’ জিজ্ঞেস করবেন পাঠকেরা। জল পায় উট তার কজে থেকে। উপোস দেবার সময় তার চর্বি গলে (পুড়ে) গিয়ে যেসব জিনিস তৈরি হয়, তা থেকে আসে জল। আর সে জল হয় তার সঞ্চিত চর্বির চেয়ে ওজনে বেশি। কেননা নিঃশ্বাস নেবার সময় বাতাস থেকে যে অক্সিজেন ফুসফুস হয়ে রক্তে সঞ্চারিত হয়, তাও গিয়ে সংযোজিত হয় তার গলা চর্বির সঙ্গে। সাধারণ গরুর চবি’ যদি ধরি, তাহলে দেখা যায় যে তার ১০০ ভাগ বিশ্লিষ্ট হলে পাওয়া যায় গড়ে প্রায় ১১২ ভাগ জল আর ১৮২ ভাগ কার্বনিক অ্যাসিড। চর্বি’ গলে যাওয়ার ফলে যে শক্তি ছাড়া পায় তাতে তপ্ত বালিতে কারাভানের সঙ্গে যাওয়াতে উটের অসুবিধা হয় না। উটের পাকস্থলীর প্রথম দুই বিভাগের, ‘পকেট’ ও তথাকথিত ‘রূপে’ যে অল্প পরিমাণ শ্লৈষ্মিক তরল পদার্থ’ সর্বদাই পাওয়া যায়, সেটা কোনোক্রমেই উটের দেহযন্ত্রে জলের খরচা পোষাতে পারে না। তাতে থাকে ইনফিউজোরিয়া আর জীবাণু, এক ধরনের খমিরের কাজ করে তারা। খাদ্যের দ্রুত পিণ্ড-পরিণতিতে তা সাহায্য করে, গাঁজিয়ে তোলে খাদ্য। আর ইনফিউজোরিয়া আর জীবাণুরা নিজেরাই বংশবৃদ্ধি করে বিপুল পরিমাণে: ঢেকুর তোলার পর তা জীর্ণ হয়ে যায় তার পাকস্থলীতে (অন্যান্য রোমন্থক প্রাণীর মতো), ফলে পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় দামী আমিষ প্রোটিন।
মরুভূমিতে বহু, সহস্র বছরের জীবনে উটেরা সেখানকার বিশেষ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
যেমন, দেখা যায় উটের পায়ে এবং অন্যান্য জায়গায় বড়ো বড়ো কড়া। বেখাপ জুতো পরলে যে কড়া পড়ে এটা মোটেই তেমন নয়। আসলে মরুভূমিতে রোদে খুবই তেতে ওঠে বালি, তাতে বসলে চামড়া পুড়ে যেতে পারে।
দেহের যেসব অংশে ভর দিয়ে উট শোয়, তা পুড়ে যাবার বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করে এইসব কড়া।
জল আর খাদ্য ছাড়া দুম্বাও মরুভূমি পাড়ি দিতে পারে। সেটা সে পারে তার লেজ আর পাছায় সঞ্চিত চর্বির দৌলতে। কিন্তু মরুভূমিতে জাইরান হরিণ বা বুনো ছাগলও থাকে, যাদের মজুত চর্বি নেই উটের মতো। তাদের জীবন অনেক কষ্টকর। খাদ্য ও জলের অভাব থেকে জাইরানদের বাঁচায় কেবল তাদের পা, এইসব লঘু প্রাণীরা এতই ক্ষিপ্র যে ঝর্ণায় জল খাবার জন্যে তারা দৌড়ে যেতে পারে কয়েক ডজন কিলোমিটার। খাদ্যের সন্ধানে তারা বহুদূর পেরিয়ে উপযুক্ত চারণভূমি বার করে।
Leave a Reply