পিওতর মান্তেইফেল
লম্ফবিশারদ চতুষ্পদ
কয়েক বছর আগে মস্কোর চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে যায় সাইবেরীয় ছাগল। ছুটে গিয়ে অনায়াসে সে ডিঙিয়ে যায় তিন মিটার উঁচু বেড়া, দৌড়ে বেড়ায় শহরের রাস্তায়। ছেলেপুলেদের শিস আর লেলানিতে জন্তুটা দৌড়ে, মোটরগাড়িকে হারিয়ে ট্রামগাড়ির একেবারে মুখের ওপর দিয়ে পেরিয়ে যায় রাস্তা। অবিলম্বে আমরা তাকে ধরার তোড়জোড় চালালাম। কিন্তু লোকেদের চেয়ে ছাগলটার দ্রুততা ও ক্ষিপ্রতা অনেক বেশি: মানুষে ছুটছিল ফুটপাথ দিয়ে আর ও যাচ্ছিল বেড়া ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে।
দু’দিন আমরা ফেরারীর কোনো সন্ধানই পেলাম না। তৃতীয় দিন টেলিফোন এল চিড়িয়াখানায়:
থানা থেকে বলছি। আপনাদের বুনো ছাগলটাকে একদল ছেলে তাড়া করে বেড়াচ্ছে গোর্কি’ রাস্তায়। লোক পাঠান।’
চিড়িয়াখানার লোকেদের আর দু’বার বলতে হল না। বলশায়া গুজিনস্কায়া রাস্তায় তারা ছাগলের পথ আটকাল। কিন্তু বড়ো একটা চুল ছাঁটার সেলুনের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে গেল ছাগলটা। সেখানে ঠিক দরজার সামনেই দেয়ালে টাঙানো ছিল আয়না। প্রাণপণে ছাগলটা তাতে ঢং মারল, ঝনঝনিয়ে ছড়িয়ে পড়ল কাচের টুকরো।
দুর্ভাগা আয়নাটার সামনে যে লোকটা বসেছিল ককিয়ে উঠল সে, ‘ওরে বাবা! হতচ্ছাড়া কোথাকার!’
আর নাপিত কেদারাটার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল: মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেছে তার খন্দের, যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। শুধু পরে, সব যখন শান্ত হয়ে আসে, সেলুন থেকে বার করে আনা হয় ছাগলটা, তখন খদ্দেরকে খুঁজে পাওয়া যায় এক কোণে, গা ঢাকবার একগাদা কাপড় আর তোয়ালের মধ্যে…
কিন্তু ছাগলটা চিড়িয়াখানা থেকে পালাতে পারল কী করে?
আসলে, যে তিন মিটার উচু বেড়া এদের বহির্জগৎ থেকে আলাদা করে রাখে, সেটা কেবল একটা আপেক্ষিক বাধা মাত্র। খোঁয়াড়ের অভ্যস্ত পরিবেশে বন্দিশায় যে সাপেক্ষ প্রতিবর্ত’ গড়ে ওঠে, সেইটাই সাধারণত এদের আটকে রাখে, শহরের রাস্তায় অবাধে ঘুরে বেড়াতে দেয় না। চিড়িয়াখানার নতুন এলাকায় যে দাগেস্তানী পাহাড়ী ছাগল আছে, তারা ছুটে এসে তাদের বেড়া ডিঙিয়ে যেতে পারে অনায়াসে, আর এসব বেড়াও হয় সাড়ে তিন মিটার উচু। সমান নৈপুণ্যে এরা লাফিয়ে ওঠে বাড়ির ছাদে, দেয়ালের সামান্য বন্ধুরতাও আঁকড়ে ধরে খুর দিয়ে।
একবার এই রকম একটা ধাড়ী মন্দা ছাগলকে আমরা তার বাসার ভেতরে ঢোকাবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু ছাগলটা হঠাৎ বিরাট এক লাফ দিয়ে বেড়া আর জল-ভরা পরিখা ডিঙিয়ে… গিয়ে পড়ল শ্বেত ভল্লুকদের চত্বরের মাঝখানে।
একটু ঘাপটি মেরে উত্তর মেরুর জানোয়ারগুলো ছাগলটার দিকে ছুটে এল, কিন্তু থেমে গেল হতভম্ব হয়ে: একেবারে ওদের নাকের ডগার সামনে থেকে প্রায় না ছুটে বোঁ করে ছাগলটা লাফিয়ে উঠল ছয় মিটার উচু এবড়ো-খেবড়ো দেয়ালে, মর্ম’র মূর্তি’র মতো স্থির হয়ে রইল তার মাথায়।
কিন্তু ফুটকিদার হরিণ যে লাফ দিতে পারে তার তুলনায় এগুলো মনে হবে কিছুই নয়। অন্যান্য শহরের চিড়িয়াখানায় পাঠাবার জন্যে একবার আমাদের চিড়িয়া- খানায় গোটা কয়েক ফুটকিদার হরিণ ধরার চেষ্টা হচ্ছিল। সঙ্কীর্ণ একটা প্রবেশপথ গিয়েছিল খাঁচা পর্যন্ত; ধীরে ধীরে সেইদিকে হরিণগুলোকে হঠিয়ে নিয়ে আসছিল নীর একসারি লোক। হঠাৎ গোটা পালটা ঘুরে পেছিয়ে গেল। পরের মুহূর্তে একটা হরিণ পেছনের পায়ে সামান্য বসেই লাফ দিয়ে চলে গেল লোকেদের মাথা ডিঙিয়ে। তার পেছ পেছ বাকি ১৪টা হরিণও লাফ দিলে। সে এক বিরল দৃশ্য। দুটো হরিণ ছিল চত্বরের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। লাফ দিলে তারা একই সময়ে। কোনাচে মেরে লাফ দেওয়ায় দ্রুত কাছিয়ে আসতে লাগল তারা। মুহূর্তের মধ্যে শূন্যে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেল বলের মতো। পরের মুহূর্তে যেন কিছুই হয় নি, এমনি ভাব করে তারা গিয়ে দাঁড়াল মাঠটায়, আগের মতোই শঙ্কিত দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগল লোকেদের।
আলগা মাটিতে খুরের যে দাগ পড়েছিল তা থেকে আমরা হরিণদের লাফের দৈর্ঘ্য মাপি। দেখা গেল এই লম্ফবিশারদ চতুষ্পদেরা লাফ দিয়েছে প্রায় এগারো মিটার!
বাঘে যতটা লাফ দিতে পারে বলে শোনা যায়, সেটা খুবই অতিরঞ্জিত। কেউ কেউ এমনও বলেন যে লম্বায় দশ মিটার কি আরো বেশি লাফ দেয় তারা। তবে এমনকি ঢালুর মুখেও এতটা ঝাঁপ বিশ্বাসযোগ্য নয়। চিড়িয়াখানার সমতল চত্বরে বাঘ কখনো ছয় মিটারের বেশি লাফ দেয় নি। তাহলে উসুরি বাঘ ফুটকিদার হরিণ শিকার করতে পারে কেমন করে? কারণ হরিণের দিকে চুপিচুপি ওঁৎ পেতে এগিয়ে এসে বাঘ শুধু লাফই দেয় না, সেইসঙ্গে এমন ভয়ঙ্কর গজ’ন করে যে হরিণ একেবারে অবশ হয়ে যায়। দূর প্রাচ্যের শিকারীরা বহুবার লক্ষ্য করেছে যে হরিণ অনায়াসে লাফ দিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারত, কিন্তু বাঘের বীভৎস গর্জনের পর সে একেবারে জায়গাটার সঙ্গে যেন গেথে যায়, ঘন ঘন এলোমেলো পা নাড়াচাড়া করে শুধু। এইভাবেই নেকড়ের অতর্কিত আক্রমণে মারা পড়ে রো হরিণ, স্লেপের কৃষ্ণসার মুগ, যদিও দ্রুত ছুটে অনায়াসে আত্মরক্ষা করতে পারে তারা।
Leave a Reply