বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৫ অপরাহ্ন

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২)

  • Update Time : শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১১.০০ এএম

জীবনকথা

ইহা ছাড়া বয়স্ক একজন কেহ আমাদের এক-একটি ছোলেকে কাঁধে করিয়া অনেক পানিতে আনিয়া ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া দিত। আমরা সাঁতার কাটিয়া কিনারে আসিতাম। ইহা ছাড়া ডালিয়ায়। রা বুকসাঁতার, এক হাতের সাঁতার, কতরকমের সাঁতারই না জানিতাম। আমার যতদূর মনে পড়ে তখনকার দিনে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পানির মধ্যে সাঁতার কাটিয়াও আমি হয়রান হইতাম না। প্রায় সারাটা দিন পানিতে কাটাইতাম। পানিতে ডুবিয়া ডুবিয়া দুইটি চোখ যখন জবাফুলের মতো লাল হইয়া উঠিত তখন বাড়ি ফিরিতাম। আমার পিতা স্কুলের কাজে দুপুরে বাড়ি হইতে চলিয়া যাইতেন। সুতরাং শাসন করিবার কেহ ছিল না। সাঁতার কাটিয়া যখন বাড়ি ফিরিতাম, মা তাঁর আঁচলে গা হাত মুছাইতে মুছাইতে বকুনি দিতেন। কিন্তু তখন তো সাঁতার কাটা শেষই হইয়াছে। পরদিন আবার যখন নদীতে নামিতাম, নদীর এই রহস্যের কাছে মায়ের বকুনি কোথায় তলাইয়া যাইত।

ছেলেবেলায় আমাকে স্কুলে পাঠাইতে আমার পিতাকে বড়ই বেগ পাইতে হইয়াছিল। গ্রামে কারও বাড়িতে কেহই স্কুলে যাইত না। সমবয়সী সাথীদের নিকট শুনিতাম স্কুলে গেলে মাস্টারের নিকট নানারকমের শান্তি পাইতে হয়। তাই যেদিন বাজান বলিতেন, কাল আমি তোমাকে আর নেহাজদ্দীনকে পাঠশালায় লইয়া যাইব, আমি আর আমার চাচাতো ভাই নেহাজদ্দীন রাতে বসিয়া নানারূপ ফন্দি-ফিকির আঁটিতাম। কি কৌশল করিলে পাঠশালায় যাওয়ার হাত হইতে রেহাই পাইব। হায়! হায়! পাঠশালায় ভর্তি হইলে আর তো সারাদিন নদীতে যাইয়া সাঁতার কাটিতে পারিব না। ডুমকুর গাছে ডুমকুর পাকিবে, গাবগাছে গাব পাকিবে। কাঁদিভরা খেজুর পাকিয়া লাল টুকটুকে হইবে।

অপরে পাড়িয়া লইয়া যাইবে। আমাদের সেই খেলাঘরে অপরে আসিয়া খেলা জমাইবে। পাঠশালার সে কঠিন কারাগারে বসিয়া এই দুঃখ কেমন করিয়া সহ্য করিব। রাত্রে ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিতাম, যমদূতের মতো পাঠশালার মাস্টার তাহার বেত্র উঠাইয়া আমাকে মারিতে উদ্যত হইয়াছে। ভোর না হইতেই আমি আর নেহাজদ্দী বাড়ি হইতে পালাইয়া যাইয়া সামনের আখের ক্ষেতে ঢুকিতাম। সেখানে বসিয়া বসিয়া দুই ভায়ের চোখে পানি আসিত। বাজানকে আমি বড়ই ভালোবাসিতাম। আমার এতটুকু অসুখ করিলে তিনি আমার বিছানার পাশে বসিয়া কত পাখার বাতাস করিতেন। আমাকে খুশি করার জন্য মেলার দিন পুতুল কেনার পয়সা দিতেন। সেই বাজান আজ আমার প্রতি এমনি নিষ্ঠুর হইয়া উঠিলেন।

কোন প্রাণে তিনি আজ তাঁর এত আদরের ছেলেকে নিষ্ঠুর মাস্টারের হাতে সঁপিয়া দিতে যাইতেছেন। পৃথিবীতে ধর্ম বলিয়া কি কোনো বস্তু নাই। যদি থাকিত তবে কি এমন হইতে পারিত। প্রায় অর্ধেক দিন এইভাবে আখের ক্ষেতে কাটাইতাম। দুই পাশের আখ ভাঙিয়া চিবাইতে চিবাইতে মুখে ঘা হইয়া যাইত। তারপর যখন বুঝিতাম, বাজান এখন বাড়ি নাই, স্কুলে চলিয়া গিয়াছেন, আমরা আখের ক্ষেত হইতে বাহির হইয়া বাড়ি ফিরিতাম। এইভাবে আজ পালাই আখের ক্ষেতে কাল পালাই সরষেক্ষেতে। সরষেক্ষেতের তলায় মটরের শিম, খেসারি কলাইয়ের শিম।

সেগুলি খাইয়া অনায়াসে ক্ষুধা নিবৃত্তি করা যায়। কিন্তু কতদিন আর পালাইয়া বাঁচা যায়! নিজের বাপই যার এমন শত্রু তার কপালে কি দুঃখ না থাকিয়া পারে? সেদিন সরষেক্ষেত হইতে বাজান আমাদের দু’ভাইকে ধরিয়া আনিয়া স্কুলে লইয়া চলিলেন। কোরবানির খাসির মতো আমরা দু’ভাই কাঁপিতে কাঁপিতে পাঠশালায় চলিলাম। আমাদের বাড়ির পশ্চিমে শ্মশানঘাটের রাস্তা, সেখান দিয়া হানিফ মোল্লার বাড়ি পারাইয়া ছোট গাঁও। তার উপরে বাঁশের সাঁকো। আমরা যেন পোলজুরাত পার হইতেছি। সেই সাঁকো পার হইয়া সতীনাথ চৌধুরীর বাড়ি। তারই বৈঠকখানায় পাঠশালার ঘর। যাইয়া দেখিলাম মাস্টার মহাশয় বেত হাতে বসিয়া আছেন। বারান্দায় দুই-তিনটি ছেলে নিলডাউন ও হাফ নিলডাউন হইয়া আছে।

 

(চলবে)……..

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024