চৈত্র-পুজা
বলরে হরগৌরী নাম বি-ভো-র।
এই গুরুগম্ভীর পরিবেশের মধ্যে হাজরা পূজা শেষ হইল। এবার হইবে শ্মশান-পূজা। ওদিক হইতে লক্ষ্মীপুরের দল আসিয়া পড়িল বলিয়া। তাহাদের ঢাকের বাদ্য শোনা যাইতেছে।
সদ্যনির্বাপিত চিতার উপর এই পূজা করিতে হইবে। তাহারা আসিয়া পড়িলে এই লইয়া দুই দলে সংঘর্ষ বাধিতে পারে। এখন শোভারামপুরের ঢাকের বাদ্য আরও জোরে জোরে আরও ভীষণ হইতে ভীষণতর তালে বাজিতে লাগিল। লক্ষ্মীপুরের দলে ঢাক বাদ্য করিতে আসিতেছে মদন ঢুলি। আর শোভারামপুরের দলে আসিয়াছে যাদব আর তার ছোট ভাই জুড়ান। যাদবের উপরে আজ আমাদের গ্রামের মানসম্ভ্রম। যদি মদনের ঢাকবাদ্য শুনিয়া সমবেত লোকেরা যাদবের ঢাকবাদ্যের চাইতে ভালো বলে তবে আমাদের আর মুখ দেখাইবার উপায় থাকিবে না।
আজ গ্রামের মুখরক্ষা করিবে যাদব-আমাদের যাদব-আমার পূর্বপরিচিত যাদব। যাদবও যেন তা জানে। সে-ই একমাত্র ব্যক্তি আজ তার হাতে আমাদের গ্রামের যা কিছু সম্মান নির্ভর করিতেছে। তাই যাদব দুই হাতে ঢাকের কাঠি ধরিয়া কখনও নাচিয়া কখনও খাড়া হইয়া তার সারা জীবনের ঢাকবাদ্যের যত কৌশল জানা আছে, সমস্ত মেলিয়া ধরিতেছে। যাদবের ঢাকের তালে তালে আকাশ-বাতাস কাঁপিতেছে-সেও হয়তো ঢাকের বাদ্যের তালে তালে শূন্য আকাশে উড়িয়া যাইবে।
শ্মশানের উপরে পূজার সামগ্রী বিছাইয়া শোভারামপুরের বালা রামে-রাজ মন্ত্র পড়িতে পড়িতে শোল মাছ পোড়া দিলেন। সন্ন্যাসীরা নদীর মধ্যে খাগড়া ঘাসের জঙ্গলে যাইয়া লুকাইয়া রহিল। এবার ঢাকের বাদ্য আরও ভয়ঙ্কর-আরও তালপ্রধান। এই বাদ্যের তালে তালে কালকে-চণ্ডীর ভক্তেরা আসিয়া শ্মশানপূজার ভোগ খাইয়া যাইবে।
মিঞাভাই আমাকে কাছে লইয়া সাবধান করিয়া দিলেন, একটু পরেই ভূতেরা আসিয়া পূজার ভোগ খাইয়া যাইবে। ভয় করিস না কিন্তু। উহাতে আমার বুকের দুরুদুরু আরও বাড়িয়া গেল। মনে হইল এদিক হইতে ওদিক হইতে শত শত ভূত যেন ঢাকবাদ্যের উপর সোয়ার হইয়া আমার দিকে ছুটিয়া আসিতেছে।
নানারকম মন্ত্র-তন্ত্র শেষ করিয়া রামে-রাজ জোরে জোরে ডাক ছাড়িলেন, পিঙ্গল পিঙ্গল দেবী পিঙ্গল মাথার কেশ পিঙ্গল জটায় দেবীর আন্ধারিল দেশ।
শুনিয়া গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল। এই মন্ত্র শেষ করিয়া বালা ডাক ছাড়িলেন, কোথায় রে মা কালকে-চণ্ডী অমনি সেই খাগড়ার বন হইতে সন্ন্যাসীর দল হি হি হি রবে, বিকট চিৎকার করিয়া পূজার ভোগ কাড়াকাড়ি করিয়া খাইতে লাগিল।
শোভারামপুরের হাজরা পুজা এইভাবে শেষ হইল। তখন দুইজন সন্ন্যাসী ধূপতি-খেলা আরম্ভ করিল। আগুনভরা ধূপতির মধ্যে ধুপের গুঁড়া ছড়াইয়া দিলে দাউদাউ করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠে। সন্ন্যাসীরা সেই আগুন এক হাতে ধাক্কা দিয়া একে অপরের গায়ে ছুড়িয়া দিতেছিল। অপর ব্যক্তি নাচের তালে তালে সরিয়া গিয়া তার প্রতিযোগীর গায়ে আবার ধূপের আগুন ছুড়িয়া মারিতেছিল।
চলবে…