সন্ন্যাসী ঠাকুর
ইহার পরে যখনই অবসর পাইয়াছি দিদির সঙ্গে দেখা করিয়াছি। দিদি আমাকে কোনোদিনই কিছু-না-কিছু না খাওয়াইয়া ছাড়েন নাই। আমি যখন আমার আসনে বসিয়া ধ্যান করিতাম সন্ন্যাসী ঠাকুরের পাশে দিদির সুন্দর স্নেহময় হাসি মুখখানি আমার মনে ভাসিয়া উঠিত। মনে মনে ভাবিতাম, দিদি কেন আমাকে কোনো কঠিন কাজের ভার দেন না? ধ্যান করিতে করিতে নিজেরই অজ্ঞাতে কাহিনীর জাল মেলিয়া ধরিতাম। দিদির খুব অসুখ করিয়াছে। ডাক্তার কবিরাজ কেহই সারাইতে পারিতেছে না। সন্ন্যাসী ঠাকুর বলিলেন, শত মাইল দূরের পাহাড় হইতে কেহ যদি অমুক গাছের পাতা আনিয়া দিতে পারে, তবে রানীদিদি ভালো হইয়া উঠিবেন। আমি মন্ত্রবলে সেই পাহাড়ে যাইয়া উপস্থিত হইলাম।
সেখানে বাঘ ভালুক কত হিংস্র জানোয়ার। সবাই ঘুমাইয়া আছে। আমি পা টিপিয়া টিপিয়া অতি সাবধানে সেই গাছের কয়েকটি পাতা লইয়া আবার মন্ত্রবলে ফিরিয়া আসিলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুর সেই পাতা ছেঁচিয়া দিদিকে খাওয়াইয়া দিলেন। দিদি তৎক্ষণাৎ ভালো হইয়া উঠিলেন। সবাই আমাকে ধন্য ধন্য করিতে লাগিল। তাহাতে আমার মনে এতটুকুও আনন্দ হইল না। দিদি যখন স্নেহের সঙ্গে বলিলেন, “ভাই! আমার কাছে আসিয়া বস,” তখনই মনে হইল আমার সকল পরিশ্রম সার্থক হইল।
কিন্তু দুঃখের বিষয় কতদিন যে কতবার দিদির সঙ্গে দেখা হইয়াছে, কোনোদিনই দিদিকে এতটুকু অসুখে পড়িতে দেখিলাম না।
দিদি যখন আমার সঙ্গে গল্প করিতেন তখন দিদির ছোট জাও আসিয়া দিদির পাশে বসিতেন। তাঁহার চেহারা দিদির মতো অত সুন্দর নয়। কিন্তু দিদির চাইতে বয়সে অনেক ছোট। তিনিও মাঝে মাঝে এটা-ওটা আনিয়া আমাকে খাইতে দিতেন। তখনকার দিনে এই জাহ্মণবাড়ির রান্নাঘরে বসিয়া কেহ যদি পেঁয়াজ এই কথাটি উচ্চারণ করিত, তবে রান্নাঘরের সকল হাঁড়ি-কুড়ি ফেলিয়া দেওয়া হইত। পরবর্তীকালে দেখিয়াছি এই বাড়ির ছেলেরা মুসলমান বন্ধুদের বাড়িতে আসিয়া পোলাও মাংস খাইত। দিদির দেবর-পুত্র সুধীরলাল সঙ্গীত-জগতে বিখ্যাত হইয়া একটি মুসলমান মেয়েকে বিবাহ করিয়াছিল। ত্রিশ বৎসরের ময্যেই হিন্দুসমাজে এতটা পরিবর্তন আসিয়াছে। অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় সুধীরলালের। সুকণ্ঠ হইতে বঙ্গদেশ বঞ্চিত হইল। রানীদিদির বাসায় গেলে সন্ন্যাসী ঠাকুর কোনদিন কি গল্প বলেন তাহা দিদিকে বলিতে হইত।
সেই গল্প শুনিবার জন্য দিদির দুই জা, সুধীরলালের মা, রতনের মা আসিয়া বসিতেন। সামনের দুইটি হাঁটু ভাঙিয়া পিঁড়ি পাতিয়া তাঁহারা বসিতেন। তিনজনের তিনজোড়া পা আলতার রঙে রঙিন হইয়া লাল টুকটুক করিত। এই তিনজোড়া সুন্দর পায়ের কাছে আমি আমার গল্পের অঞ্জলি নিবেদন করিতাম। সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে গল্পটি যেমন শুনিতাম তার উপরে এই তিনজোড়া চরণের আলতার রং কিছু মাখাইয়া গল্পটিকে আরও একটু বাড়াইয়া লইতাম। একদিনের একটি গল্প মনে আছে। সন্ন্যাসী ঠাকুর যখন মানস-সরোবরের পথে হিমালয়ের অনেক উপরে উঠিয়াছেন, তখন তাঁহার বেদম জ্বর হইল। সেই জ্বরের জন্য তিনি নিচে নামিয়া আসিলেন। আর তিনি পথ চলিতে পারেন না। একটি পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরে কম্বল মুড়ি দিয়া তিনি প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া রহিলেন। এমন সময় শিয়রে কাহার পায়ের মলের শব্দ শুনিতে পাইলেন, চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া দেখেন, কাহাদের যেন একটি কালো মেয়ে সামনে দাঁড়াইয়া আছে। মুখখানি বড়ই লাবণ্যমাখা। সন্ন্যাসী ঠাকুরের কপালে হাত দিয়া মেয়েটি বলিল, “বাবা! তোমার তো বেশ জ্বর হইয়াছে। আহা! তোমাকে দেখিবার তো কেহ নাই। কোনো চিন্তা করিও না। আমিই তোমাকে দেখাশোনা করিব। এই দুধটুকু খাইয়া ফেল।” এই বলিয়া মেয়েটি একবাটি দুধ সন্ন্যাসী ঠাকুরের মুখের কাছে তুলিয়া ধরিল। তারপর সারারাত্র বসিয়া মেয়েটি সন্ন্যাসী ঠাকুরের মাথায় জলপট্টি দিল। গায়ে-মুখে হাত বুলাইতে লাগিল। এমনি করিয়া সাত-আট দিন সামনে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়া মেয়েটি সন্ন্যাসী ঠাকুরের সেবাযত্ন করিতে লাগিল। মাঝে মাঝে সে অল্প সময়ের জন্য কোথায় উধাও হইয়া যাইত। তারপর কোথা হইতে দুধ লইয়া আসিত-ফলমূল লইয়া আসিত। সন্ন্যাসী ঠাকুর টেরও পাইতেন না। যখন তিনি অসুখের ঘোরে আহা-উহু করিতেছিলেন মেয়েটি সস্নেহে বলিত, “বাবা, তোমার কোনো চিন্তা নাই। অল্পদিনেই ভালো হইয়া যাইবে।” একদিন সন্ন্যাসী ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা! তুমি আমার কে? আমার জন্য তুমি এত করিতেছ কেন?”
চলবে…