০৮:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
ট্রাম্পের বিপরীতে, প্রাচীন চীন এর শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য রণক্ষেত্রে (পর্ব-৭৭) সমুদ্রের ওপার থেকে নতুন স্বপ্ন: তাইওয়ান তরুণদের ফুচিয়ানে নতুন জীবনগাঁথা ব্যর্থ কলম্বো, গলের লড়াই -এ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ঘরে জয় কেন ? ‘আকাশ হয়ে যাই’ মিউজিক ভিডিতে প্রশংসিত পূর্ণিমা বৃষ্টি সাউথ চায়নান মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন: ইরান আক্রমনে লাভ ক্ষতি ইউক্রেন দাবি করেছে বাংলাদেশের কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিক ইইউ কলকাতার কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রীকে গণধর্ষণ, গ্রেফতার তিন ‘চুরির গম’ আমদানি: বাংলাদেশের ওপর ইইউ নিষেধাজ্ঞা চায় ইউক্রেন চীনের বৃহত্তম গভীর সমুদ্র গ্যাসক্ষেত্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎপাদন শুরু

তবলায় জাকির হুসেন 

  • Sarakhon Report
  • ০৪:১৬:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 14

সারাক্ষণ ডেস্ক

এক স্বর্গীয় সত্তা আমাদের জীবন থেকে চিরবিদায় নিয়েছেআর আমি সেই শূন্যতাকে মেনে নিতে পারছি না। জাকির ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্বতাঁর পরিচয় পাওয়া প্রত্যেকের জন্য এক উষ্ণতায় ভরা আলোকবর্তিকাসেটা পন্ডিত রবিশঙ্করশিবজি (পন্ডিত শিবকুমার শর্মা)আমিকিংবা কম বয়সী শিল্পীছাত্রকনসার্টের আলো ও শব্দ পরিচালনাকারী বা চা পরিবেশনকারী যে-ই হোন না কেনসবাইকেই তিনি একই আন্তরিকতা ও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করতেন।

যখন প্রথম শুনলাম তাঁর অসুস্থতার কথানিজেকে বলেছিলাম, “তিনি আমেরিকায় আছেনআধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সেরা চিকিৎসকদের মধ্যেতিনি ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবেনতিনি তো শক্ত মনের মানুষ…”

এখনওযদিও তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছেআমার মনের একটি অংশ যেন এখনো তাঁর সেই প্রাণখোলা হাসির শব্দ শুনতে চায়। মনে হয় যে কোনও মুহূর্তে তিনি ফোন করে আমার এই ভারাক্রান্ত বুকটা হালকা করে দেবেন।

অনেকেই বলেজাকির তাঁর বিখ্যাত পিতা উস্তাদ আল্লা রাখা খাঁ সাহেবের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিতিনি তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করেছেনতবলা বাজনাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেনযেখানে কেউ আগে কখনও পৌঁছাতে পারেননি। এমনকি একবার তাঁর বাবা নিজেই আমাকে বলেছিলেনযথার্থ গর্বের সঙ্গে: জাকির তবলাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছে যা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনিসে এমন লোকদেরও মোহিত করে যারা সঙ্গীত সম্পর্কে সামান্যই জানে। আমি হয়তো তাকে শিখিয়েছিকিন্তু তাঁর নিজস্ব সিগনেচার স্টাইল সম্পূর্ণ আলাদা। আমি বিস্ময়ে দেখি কীভাবে শিশুবৃদ্ধসকল শ্রোতারা তার প্রতিটি বিটের সঙ্গে মুগ্ধ হয়ে থাকে।

আমিও এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত। জাকিরের বাজনা কেবল টেকনিক বা ধ্রুপদী পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ ছিল নাবরং তা এক গভীরপবিত্র এবং ঐশ্বরিক অনুভূতিকে সকলের কাছে সহজলভ্য করে তুলেছিল। তিনি ঘোড়ার ছুটে চলামোটরসাইকেলের শব্দ বা শিশুর বল নিয়েConcrete-এ লাফিয়ে বেড়ানোর শব্দও বাজাতে পারতেন। কিন্তু যখন তিনি শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতেনতখনই তিনি ধ্রুপদী সুরের দিকে প্রবেশ করতেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভাকে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।

সংগীত জগতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

আমি প্রথম তাঁকে দেখেছিলাম বোম্বে ল্যাব স্টুডিওতেযখন তিনি মাত্র দশ বছরের লাজুক বালক। তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে এসেছিলেনযিনি তখন জগ্গা সিনেমার জন্য রেকর্ডিং করছিলেন। সেখানে প্রায় আশি জন সংগীতশিল্পী এবং বিশাল মোহাম্মদ রফি সাহেব মাইক্রোফোনের সামনে ছিলেন। সেই ভিড়ভরা স্টুডিওতে ছোট্ট জাকিরনিখুঁত ছন্দে মঞ্জিরা বাজাতে বাজাতে ঠিকই চোখে পড়ে গিয়েছিল।

সেই উজ্জ্বলতা খুব শীঘ্রই সংগীত জগতের এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছিল। তিনি প্রায়শই তাঁর বাবার সঙ্গে রেকর্ডিং সেশনে অংশ নিতেনযেমন কিংবদন্তি মদন মোহন বা শঙ্কর-জয়কিষণের মতো সুরকারদের জন্য। আমাদের মতো অন্যান্য অনেক সংগীতশিল্পীর মতোখাঁ সাহেবের জীবনও শিল্পের চারপাশেই আবর্তিত হতোআর তাঁর স্ত্রী সন্তানদের যত্ন নিতেন। যদিও কখনও কখনও জাকির স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে বা ক্রিকেট খেলতে যেতেনতাঁর বাবার স্নেহময় ও উৎসাহব্যঞ্জক শেখানোর ধরন তাঁকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। খাঁ সাহেব তাঁর ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখেছিলেনযা জাকিরকে মনোযোগী ও মাটির মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

এক বিশ্বব্যাপী আইকন হয়ে ওঠার যাত্রা

খাঁ সাহেবকে আমি একবারই সত্যিকারের বিচলিত দেখেছিলামযখন চৌদ্দ বছর বয়সী জাকির ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আমার বাঁ হাতের একটি আঙুল ভেঙে ফেলেছিল। একজন বাঁশিবাদকের জন্য এটা ছিল গুরুতর চোট। আমি মনে করিসেই ঘটনা জাকিরের মনেও দাগ কেটেছিল। এরপর তাঁর বাবার তিরস্কারের পরতিনি তাঁর শিল্পের প্রতি আরও গভীর নিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রতিটি পরিবেশনায় সেই তীব্রতা ফুটে উঠেছিল।

জাকিরের সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। এক সময়যখন বিমানের ভাড়া বহন করার সামর্থ্য ছিল নাআমরা নিউ ইয়র্ক থেকে সান ফ্রান্সিসকো পর্যন্ত গাড়িতে যেতাম। পথে ম্যাকডোনাল্ডসের খাবার আর জীবনের সঙ্গে সংগীতের গভীর আলোচনা আমাদের সঙ্গী ছিল। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন কীভাবে তাঁর বাবা তাঁকে দক্ষিণ বোম্বের অভিজাতদের বাড়ির ব্যক্তিগত মেহফিলগুলোতে নিয়ে যেতেন। যখন আয়োজকরা মদ ও খাবারের মধ্যে ব্যস্ত থাকতেনজাকির এবং অন্যান্য সংগীতশিল্পীরা রান্নাঘরে অপেক্ষা করতেনকখন ডাক পড়বে। অনেক সময়বড় টিফিন ক্যারিয়ারে পড়ে থাকা খাবারই তাঁদের একমাত্র পারিশ্রমিক ছিল। সেই বিনয়ী সূচনা থেকে এক বিশ্বখ্যাত আইকন হয়ে ওঠা পর্যন্ত তাঁর যাত্রা এক অলৌকিক গল্পের মতো।

সাংস্কৃতিক বিভেদ দূর করা

পন্ডিত রবিশঙ্কর এবং জাকিরের মতো শিল্পীরা কেবল সংগীত পরিবেশন করতেন নাতারা এমন শ্রোতা তৈরি করেছিলেনযারা আগে কখনও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের দিকে মনোযোগ দেননি। তাঁদের কাজ আমাদের সংগীত ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল। ১৯৭৩ সালে জন ম্যাকলফলিনএল শঙ্কর এবং বিক্কু বিনায়াকরামের সঙ্গে তাঁর শাক্তি গোষ্ঠীর কাজ সংগীতের বিভিন্ন ধারার মধ্যে বিভেদ দূর করেছিল। কয়েক দশক পররিমেম্বারিং শাক্তি হিসেবে গোষ্ঠীটি পুনরায় একত্রিত হলে তিনি আমাকে অতিথি শিল্পী হিসেবে কয়েকটি কনসার্টে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানান। সেই সময়েও তিনি নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য শিল্পীদের সামনে তুলে ধরার জন্য সবসময় এগিয়ে আসতেনযদিও তখন তিনি নিজেই এক বিশাল তারকা। তাঁর সেই বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিই কার্নাটকহিন্দুস্তানি এবং পাশ্চাত্য সংগীতের বিভেদ ঘুচিয়েছিল।

তরুণ শিল্পীদের প্রতি জাকিরের উৎসাহও তাঁর উদার মনোভাবের প্রমাণ। তিনি আমার ভাইপো রাকেশ চৌরাসিয়াগায়ক দেবকি পন্ডিত এবং রাহুল দেশপান্ডের মতো প্রতিভাদের প্রশংসা করতেন এবং তাঁদের পথপ্রদর্শক হতেন। যদিও তিনি আমেরিকায় বসবাস করতেনভারতীয় সংগীত জগতের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত ছিলেন এবং এখানকার প্রবণতা সম্পর্কে সবসময় সচেতন থাকতেন। প্রতি বছর তিনি মুম্বাইয়ে আসতেনতাঁর বাবার স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠান বা প্রয়াত বন্ধু জেনিফার কাপুরের জন্য পৃথ্বী থিয়েটারের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতে। তাঁকে শেষবার এই জানুয়ারিতে দেখেছিলামযখন তিনি আমার আন্ধেরির গুরুকুল বৃন্দাবনে পারফর্ম করতে এসেছিলেন।

জাকিরের চলে যাওয়ায় আমরা আমাদের সংগীত ঐতিহ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভগুলোর একটিকে হারিয়েছি। তাঁর সেই আলোহাসিপ্রতিভা ছাড়া পৃথিবীটা যেন একটু ম্লান হয়ে গেছে। তাঁর অভাব মেটানো অসম্ভব। সত্যিইএকটি অপরিবর্তনীয় আলো নিভে গেল।

ট্রাম্পের বিপরীতে, প্রাচীন চীন এর শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য

তবলায় জাকির হুসেন 

০৪:১৬:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

সারাক্ষণ ডেস্ক

এক স্বর্গীয় সত্তা আমাদের জীবন থেকে চিরবিদায় নিয়েছেআর আমি সেই শূন্যতাকে মেনে নিতে পারছি না। জাকির ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্বতাঁর পরিচয় পাওয়া প্রত্যেকের জন্য এক উষ্ণতায় ভরা আলোকবর্তিকাসেটা পন্ডিত রবিশঙ্করশিবজি (পন্ডিত শিবকুমার শর্মা)আমিকিংবা কম বয়সী শিল্পীছাত্রকনসার্টের আলো ও শব্দ পরিচালনাকারী বা চা পরিবেশনকারী যে-ই হোন না কেনসবাইকেই তিনি একই আন্তরিকতা ও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করতেন।

যখন প্রথম শুনলাম তাঁর অসুস্থতার কথানিজেকে বলেছিলাম, “তিনি আমেরিকায় আছেনআধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সেরা চিকিৎসকদের মধ্যেতিনি ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবেনতিনি তো শক্ত মনের মানুষ…”

এখনওযদিও তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছেআমার মনের একটি অংশ যেন এখনো তাঁর সেই প্রাণখোলা হাসির শব্দ শুনতে চায়। মনে হয় যে কোনও মুহূর্তে তিনি ফোন করে আমার এই ভারাক্রান্ত বুকটা হালকা করে দেবেন।

অনেকেই বলেজাকির তাঁর বিখ্যাত পিতা উস্তাদ আল্লা রাখা খাঁ সাহেবের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিতিনি তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করেছেনতবলা বাজনাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেনযেখানে কেউ আগে কখনও পৌঁছাতে পারেননি। এমনকি একবার তাঁর বাবা নিজেই আমাকে বলেছিলেনযথার্থ গর্বের সঙ্গে: জাকির তবলাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছে যা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনিসে এমন লোকদেরও মোহিত করে যারা সঙ্গীত সম্পর্কে সামান্যই জানে। আমি হয়তো তাকে শিখিয়েছিকিন্তু তাঁর নিজস্ব সিগনেচার স্টাইল সম্পূর্ণ আলাদা। আমি বিস্ময়ে দেখি কীভাবে শিশুবৃদ্ধসকল শ্রোতারা তার প্রতিটি বিটের সঙ্গে মুগ্ধ হয়ে থাকে।

আমিও এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত। জাকিরের বাজনা কেবল টেকনিক বা ধ্রুপদী পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ ছিল নাবরং তা এক গভীরপবিত্র এবং ঐশ্বরিক অনুভূতিকে সকলের কাছে সহজলভ্য করে তুলেছিল। তিনি ঘোড়ার ছুটে চলামোটরসাইকেলের শব্দ বা শিশুর বল নিয়েConcrete-এ লাফিয়ে বেড়ানোর শব্দও বাজাতে পারতেন। কিন্তু যখন তিনি শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতেনতখনই তিনি ধ্রুপদী সুরের দিকে প্রবেশ করতেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভাকে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।

সংগীত জগতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

আমি প্রথম তাঁকে দেখেছিলাম বোম্বে ল্যাব স্টুডিওতেযখন তিনি মাত্র দশ বছরের লাজুক বালক। তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে এসেছিলেনযিনি তখন জগ্গা সিনেমার জন্য রেকর্ডিং করছিলেন। সেখানে প্রায় আশি জন সংগীতশিল্পী এবং বিশাল মোহাম্মদ রফি সাহেব মাইক্রোফোনের সামনে ছিলেন। সেই ভিড়ভরা স্টুডিওতে ছোট্ট জাকিরনিখুঁত ছন্দে মঞ্জিরা বাজাতে বাজাতে ঠিকই চোখে পড়ে গিয়েছিল।

সেই উজ্জ্বলতা খুব শীঘ্রই সংগীত জগতের এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছিল। তিনি প্রায়শই তাঁর বাবার সঙ্গে রেকর্ডিং সেশনে অংশ নিতেনযেমন কিংবদন্তি মদন মোহন বা শঙ্কর-জয়কিষণের মতো সুরকারদের জন্য। আমাদের মতো অন্যান্য অনেক সংগীতশিল্পীর মতোখাঁ সাহেবের জীবনও শিল্পের চারপাশেই আবর্তিত হতোআর তাঁর স্ত্রী সন্তানদের যত্ন নিতেন। যদিও কখনও কখনও জাকির স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে বা ক্রিকেট খেলতে যেতেনতাঁর বাবার স্নেহময় ও উৎসাহব্যঞ্জক শেখানোর ধরন তাঁকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। খাঁ সাহেব তাঁর ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখেছিলেনযা জাকিরকে মনোযোগী ও মাটির মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিল।

এক বিশ্বব্যাপী আইকন হয়ে ওঠার যাত্রা

খাঁ সাহেবকে আমি একবারই সত্যিকারের বিচলিত দেখেছিলামযখন চৌদ্দ বছর বয়সী জাকির ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আমার বাঁ হাতের একটি আঙুল ভেঙে ফেলেছিল। একজন বাঁশিবাদকের জন্য এটা ছিল গুরুতর চোট। আমি মনে করিসেই ঘটনা জাকিরের মনেও দাগ কেটেছিল। এরপর তাঁর বাবার তিরস্কারের পরতিনি তাঁর শিল্পের প্রতি আরও গভীর নিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রতিটি পরিবেশনায় সেই তীব্রতা ফুটে উঠেছিল।

জাকিরের সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। এক সময়যখন বিমানের ভাড়া বহন করার সামর্থ্য ছিল নাআমরা নিউ ইয়র্ক থেকে সান ফ্রান্সিসকো পর্যন্ত গাড়িতে যেতাম। পথে ম্যাকডোনাল্ডসের খাবার আর জীবনের সঙ্গে সংগীতের গভীর আলোচনা আমাদের সঙ্গী ছিল। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন কীভাবে তাঁর বাবা তাঁকে দক্ষিণ বোম্বের অভিজাতদের বাড়ির ব্যক্তিগত মেহফিলগুলোতে নিয়ে যেতেন। যখন আয়োজকরা মদ ও খাবারের মধ্যে ব্যস্ত থাকতেনজাকির এবং অন্যান্য সংগীতশিল্পীরা রান্নাঘরে অপেক্ষা করতেনকখন ডাক পড়বে। অনেক সময়বড় টিফিন ক্যারিয়ারে পড়ে থাকা খাবারই তাঁদের একমাত্র পারিশ্রমিক ছিল। সেই বিনয়ী সূচনা থেকে এক বিশ্বখ্যাত আইকন হয়ে ওঠা পর্যন্ত তাঁর যাত্রা এক অলৌকিক গল্পের মতো।

সাংস্কৃতিক বিভেদ দূর করা

পন্ডিত রবিশঙ্কর এবং জাকিরের মতো শিল্পীরা কেবল সংগীত পরিবেশন করতেন নাতারা এমন শ্রোতা তৈরি করেছিলেনযারা আগে কখনও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের দিকে মনোযোগ দেননি। তাঁদের কাজ আমাদের সংগীত ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল। ১৯৭৩ সালে জন ম্যাকলফলিনএল শঙ্কর এবং বিক্কু বিনায়াকরামের সঙ্গে তাঁর শাক্তি গোষ্ঠীর কাজ সংগীতের বিভিন্ন ধারার মধ্যে বিভেদ দূর করেছিল। কয়েক দশক পররিমেম্বারিং শাক্তি হিসেবে গোষ্ঠীটি পুনরায় একত্রিত হলে তিনি আমাকে অতিথি শিল্পী হিসেবে কয়েকটি কনসার্টে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানান। সেই সময়েও তিনি নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য শিল্পীদের সামনে তুলে ধরার জন্য সবসময় এগিয়ে আসতেনযদিও তখন তিনি নিজেই এক বিশাল তারকা। তাঁর সেই বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিই কার্নাটকহিন্দুস্তানি এবং পাশ্চাত্য সংগীতের বিভেদ ঘুচিয়েছিল।

তরুণ শিল্পীদের প্রতি জাকিরের উৎসাহও তাঁর উদার মনোভাবের প্রমাণ। তিনি আমার ভাইপো রাকেশ চৌরাসিয়াগায়ক দেবকি পন্ডিত এবং রাহুল দেশপান্ডের মতো প্রতিভাদের প্রশংসা করতেন এবং তাঁদের পথপ্রদর্শক হতেন। যদিও তিনি আমেরিকায় বসবাস করতেনভারতীয় সংগীত জগতের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত ছিলেন এবং এখানকার প্রবণতা সম্পর্কে সবসময় সচেতন থাকতেন। প্রতি বছর তিনি মুম্বাইয়ে আসতেনতাঁর বাবার স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠান বা প্রয়াত বন্ধু জেনিফার কাপুরের জন্য পৃথ্বী থিয়েটারের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতে। তাঁকে শেষবার এই জানুয়ারিতে দেখেছিলামযখন তিনি আমার আন্ধেরির গুরুকুল বৃন্দাবনে পারফর্ম করতে এসেছিলেন।

জাকিরের চলে যাওয়ায় আমরা আমাদের সংগীত ঐতিহ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভগুলোর একটিকে হারিয়েছি। তাঁর সেই আলোহাসিপ্রতিভা ছাড়া পৃথিবীটা যেন একটু ম্লান হয়ে গেছে। তাঁর অভাব মেটানো অসম্ভব। সত্যিইএকটি অপরিবর্তনীয় আলো নিভে গেল।