সন্ন্যাসী ঠাকুর
আমি সেবার বি এ পরীক্ষা দিয়া কুমারখালি যাইয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করিলাম। ইতিমধ্যে তাঁহার একমাত্র ছেলে শ্রীশদার মৃত্যু হইয়াছে। যাইয়া দেখিলাম তাঁহার প্রায়ই ম্যালেরিয়া জ্বর হয়। ইহার উপর এই নিদারুণ পুত্রশোক। রোগে-শোকে তিনি অস্থিচর্মসার হইয়াছেন। এখানে বড় একটা কেহ তাঁহাকে দেখিতে আসে না। মন্ত্র-শিষ্যেরা মাঝে মাঝে যা দু’চার টাকা ডাকযোগে পাঠায় তাই দিয়া তিনি কোনোমতে আহারের সংস্থান করেন। এক বৃদ্ধা মহিলা, আমাদের কৃতান্ত দিদি তাঁহার দেখাশুনা করেন।
এই যে সামান্য অর্থের সংসার তাহা সত্ত্বেও সন্ন্যাসী ঠাকুর প্রায় সের দেড়েকের মতো চাউলের ভাত রাঁধাইয়া প্রতিদিন শিবা-ভোগ দিতেন। সামনের বনের মধ্যে ভাতগুলি রাখিয়া তিনি আয় আয় করিয়া ডাক দিতেন। দশ-বারোটা শেয়াল আসিয়া সেই ভাতগুলি খাইয়া যাইত। মনে মনে ভাবিলাম, মানুষের অকৃতজ্ঞতায় আর ছলনায় বিতৃষ্ণ হইয়া আজ বনের পশুদের সঙ্গে তিনি হয়তো মিতালি পাতাইতে চেষ্টা করিতেছেন।
বিদায়ের সময় কৃতান্ত দিদি বলিলেন, “বাবা চাপলে মাছ আর ফেসা মাছ খাইতে ভালোবাসেন। এদেশে ওসব মাছ পাওয়া যায় না। তুমি আবার যখন আসিবে বাবার জন্য কিছু মাছ লইয়া আসিও।”
এখন আমার কালী-মাতা এবং অন্যান্য দেবদেবীর উপর বিশ্বাস নাই। গুরুবাদেও বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমার বাল্যজীবন হইতে এ পর্যন্ত সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে যে স্নেহ-মমতা পাইয়াছি সেজন্য তাঁহার প্রতি আমার মনে যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার ভাব গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহার এক বিন্দুও ক্ষুণ্ণ হয় নাই।
দেশে আসিয়া কয়েকদিন পরেই কিছু চাপলে মাছ ও ফেঁসা মাছ কিনিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের আশ্রমে আসিলাম। মাছগুলি দেখিয়া তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, “তোমার ভিতর দিয়া আমার শ্রীশকে আবার ফিরিয়া পাইলাম।” আমারও চোখ বাহিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। আহারে। এই সন্ন্যাসী ঠাকুর একদিন কত বড় ঐশ্বর্যের সংসার পদাঘাতে ছাড়িয়া আসিয়াছিলেন। আমাদের শ্মশানঘাটের আশ্রমে কত বড় বড় লোকের খাদ্যসম্ভার তিনি ফিরাইয়া দিতেন। আজ সেই তিনি সামান্য কয়টি মাছ পাইয়া এতটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছেন!
মাছগুলি কিছুটা পচিয়া গিয়াছিল। কৃতান্ত দিদি তাহাই অতি যত্নের সঙ্গে কুটিয়া কিছু ভাজিয়া কিছু ঝোল করিয়া চার-পাঁচ রকমের পদ করিয়া রান্না করিলেন। সন্ন্যাসী ঠাকুর অতি তৃপ্তির সঙ্গে আহার করিলেন।
তখন আমার কিছু কবিখ্যাতি হইয়াছে। প্রবাসী হইতে আরম্ভ করিয়া কয়েকখানা পত্রিকায় আমার কিছু কিছু কবিতা প্রকাশিত হইয়াছে। সন্ধ্যাবেলায় আমার কয়েকটি কবিতা তাঁহাকে পড়িয়া শুনাইলাম। আমার কৃতিত্ব যেন তাঁর নিজেরই। শুনিয়া তিনি বড়ই খুশি হইলেন। বারবার করিয়া আমাকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। তিনি আরও বলিলেন, “আমি তো আগেই তোমার হাত দেখিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলাম, এককালে তুমি খুব বড় হইবে।
চলবে…