০৯:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১১৪)

  • Sarakhon Report
  • ০২:৩৯:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫
  • 15

অধ্যাপক এস. সি. সেন

তাঁহার নির্দেশ অনুসারে নূতন কবিতা লিখিয়া আনিয়া তাঁহাকে দেখাইতাম। তিনি নিজে কবি ছিলেন না। কিন্তু কবিতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছন্দের ত্রুটি তিনি ধরিয়া দিতে পারিতেন। ইহার পরে আমার একটি কবিতা প্রবাসীতে ছাপা হইল। প্রবাসীর পাতা উলটাইতে উলটাইতে তিনি বলিলেন, “প্রবাসী যখন তোমার কবিতা ছাপাইয়াছে এখন হইতে তুমি কবি বলিয়া স্বীকৃতি পাইলে।”

শশীবাবুর স্ত্রী নির্মলাদি ভালো গান গাহিতে পারিতেন। সেকালে ভদ্রসমাজের মেয়েরা তেমন গান-বাজনায় যোগ দেয় নাই। আমরা ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় যাইতাম নির্মলাদির গান শুনিতে। উপাসনার ফাঁকে ফাঁকে নির্মলাদি রবীন্দ্রনাথের সদ্য-রচিত ধর্ম-সঙ্গীতগুলি গাহিতেন। বারবার শশীবাবুকে কবিতা দেখাইতে যাইয়া নির্মলা দিদির সঙ্গেও পরিচয় হইল। তিনি আমাকে বড়ই স্নেহ করিতেন। শশীবাবু নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করিয়াছেন কিন্তু ইংরেজিতে তাঁহার বিশেষ অধিকার ছিল। সেইজন্য সাহেবরা তাঁহাকে বড়ই পছন্দ করিতেন, সামান্য কেরানির কাজ হইতে উন্নতি করিয়া তিনি সেরেস্তাদার পর্যন্ত হইয়াছিলেন। তিনি সর্বদা ইংরেজদের মতো পোশাক পরিতে ভালোবাসিতেন।

প্রতিদিন Statesman পত্রিকা পড়িতেন। Statesman-এ বিজ্ঞাপন পড়িয়া কলিকাতার Whiteway laidlaw-র বাড়ি হইতে মাঝে মাঝে তিনি এটা-ওটা কিনিয়া আনাইতেন। সেইসব পার্সেল তিনি খুব গৌরবের সঙ্গে খুলিতেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও তিনি বিলাতি বস্ত্র বর্জন করেন নাই। তাঁহাকে যদি কেহ সাহেব বলিত তিনি গৌরব বোধ করিতেন। নির্মলাদির একটি বোন মাঝে মাঝে আসিয়া কিছুদিন তাঁহার সঙ্গে থাকিত। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়েটি। পাতলা ছিপছিপে একহারা চেহারা। আমার সঙ্গে কথা বলিত না। কিন্তু তাহাকে দেখিতে আমার বেশ ভালো লাগিত। শশীবাবু বলিতেন, “জসীম। বড় হইয়া তুমি আমাদের ব্রাহ্ম-ধর্ম গ্রহণ করিও।”

এই মেয়েটিকে অকালে যক্ষ্মা রোগ ধরিল। চিকিৎসার জন্য তাহাকে কলিকাতা লইয়া যাওয়া হইল। একদিন দিদি বলিলেন, “সেখানে তার সেবা-শুশ্রূষার ভালো ব্যবস্থা হইতেছে না।” আমি বলিলাম, “আমি কলিকাতা যাইয়া তাহার সেবা-শুশ্রূষা করিতে প্রস্তুত আছি।” দিদি শশীবাবুর সঙ্গে কি পরামর্শ করিলেন। আমার কলিকাতা যাওয়া হইল না। অল্পদিনের মধ্যেই মেয়েটির মৃত্যু-সংবাদ আসিল।

ব্রাহ্মসমাজের একটি বক্তৃতা লইয়া মিঃ সেনের সঙ্গে শশীবাবুর মতবিরোধ হইল। তখন হইতে মিঃ সেন কয়েকজন লোক লইয়া একটি বাড়িতে প্রতি রবিবারে উপাসনা করিতেন।

আমি নিয়মিত এই উপাসনায় যোগ দিতাম। তখনকার ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা বড়ই সত্যাশ্রয়ী ছিলেন। জীবন গেলেও মিথ্যা কথা কহিতেন না। তাঁহারা যাহাকে যে-কথা বলিতেন প্রাণপণে তাহা রক্ষা করিতেন। হিন্দুসমাজের আচার-ব্যবহার লইয়া ব্রাহ্মরা তীব্র সমালোচনা করিতেন। তাহাদের ছুঁৎমার্গ, জাতিভেদ, ধর্মান্ধতা, পৌত্তলিকতার প্রতি তাঁহারা যুক্তির তীব্র কষাঘাত করিতেন। আমার খুব ভালো লাগিত। ইতিপূর্বে হিন্দু-সমাজের সঙ্গে মিশিতে যাইয়া তাহাদের ধর্মান্ধতা ও ছুঁৎমার্গের জন্য বহুবার মনে আঘাত পাইয়াছি, তাঁহাদের সমালোচনা আমার সেই ক্ষতস্থানে পেলব স্পর্শ মাখাইয়া দিত।

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১১৪)

০২:৩৯:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী ২০২৫

অধ্যাপক এস. সি. সেন

তাঁহার নির্দেশ অনুসারে নূতন কবিতা লিখিয়া আনিয়া তাঁহাকে দেখাইতাম। তিনি নিজে কবি ছিলেন না। কিন্তু কবিতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছন্দের ত্রুটি তিনি ধরিয়া দিতে পারিতেন। ইহার পরে আমার একটি কবিতা প্রবাসীতে ছাপা হইল। প্রবাসীর পাতা উলটাইতে উলটাইতে তিনি বলিলেন, “প্রবাসী যখন তোমার কবিতা ছাপাইয়াছে এখন হইতে তুমি কবি বলিয়া স্বীকৃতি পাইলে।”

শশীবাবুর স্ত্রী নির্মলাদি ভালো গান গাহিতে পারিতেন। সেকালে ভদ্রসমাজের মেয়েরা তেমন গান-বাজনায় যোগ দেয় নাই। আমরা ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় যাইতাম নির্মলাদির গান শুনিতে। উপাসনার ফাঁকে ফাঁকে নির্মলাদি রবীন্দ্রনাথের সদ্য-রচিত ধর্ম-সঙ্গীতগুলি গাহিতেন। বারবার শশীবাবুকে কবিতা দেখাইতে যাইয়া নির্মলা দিদির সঙ্গেও পরিচয় হইল। তিনি আমাকে বড়ই স্নেহ করিতেন। শশীবাবু নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করিয়াছেন কিন্তু ইংরেজিতে তাঁহার বিশেষ অধিকার ছিল। সেইজন্য সাহেবরা তাঁহাকে বড়ই পছন্দ করিতেন, সামান্য কেরানির কাজ হইতে উন্নতি করিয়া তিনি সেরেস্তাদার পর্যন্ত হইয়াছিলেন। তিনি সর্বদা ইংরেজদের মতো পোশাক পরিতে ভালোবাসিতেন।

প্রতিদিন Statesman পত্রিকা পড়িতেন। Statesman-এ বিজ্ঞাপন পড়িয়া কলিকাতার Whiteway laidlaw-র বাড়ি হইতে মাঝে মাঝে তিনি এটা-ওটা কিনিয়া আনাইতেন। সেইসব পার্সেল তিনি খুব গৌরবের সঙ্গে খুলিতেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও তিনি বিলাতি বস্ত্র বর্জন করেন নাই। তাঁহাকে যদি কেহ সাহেব বলিত তিনি গৌরব বোধ করিতেন। নির্মলাদির একটি বোন মাঝে মাঝে আসিয়া কিছুদিন তাঁহার সঙ্গে থাকিত। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়েটি। পাতলা ছিপছিপে একহারা চেহারা। আমার সঙ্গে কথা বলিত না। কিন্তু তাহাকে দেখিতে আমার বেশ ভালো লাগিত। শশীবাবু বলিতেন, “জসীম। বড় হইয়া তুমি আমাদের ব্রাহ্ম-ধর্ম গ্রহণ করিও।”

এই মেয়েটিকে অকালে যক্ষ্মা রোগ ধরিল। চিকিৎসার জন্য তাহাকে কলিকাতা লইয়া যাওয়া হইল। একদিন দিদি বলিলেন, “সেখানে তার সেবা-শুশ্রূষার ভালো ব্যবস্থা হইতেছে না।” আমি বলিলাম, “আমি কলিকাতা যাইয়া তাহার সেবা-শুশ্রূষা করিতে প্রস্তুত আছি।” দিদি শশীবাবুর সঙ্গে কি পরামর্শ করিলেন। আমার কলিকাতা যাওয়া হইল না। অল্পদিনের মধ্যেই মেয়েটির মৃত্যু-সংবাদ আসিল।

ব্রাহ্মসমাজের একটি বক্তৃতা লইয়া মিঃ সেনের সঙ্গে শশীবাবুর মতবিরোধ হইল। তখন হইতে মিঃ সেন কয়েকজন লোক লইয়া একটি বাড়িতে প্রতি রবিবারে উপাসনা করিতেন।

আমি নিয়মিত এই উপাসনায় যোগ দিতাম। তখনকার ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা বড়ই সত্যাশ্রয়ী ছিলেন। জীবন গেলেও মিথ্যা কথা কহিতেন না। তাঁহারা যাহাকে যে-কথা বলিতেন প্রাণপণে তাহা রক্ষা করিতেন। হিন্দুসমাজের আচার-ব্যবহার লইয়া ব্রাহ্মরা তীব্র সমালোচনা করিতেন। তাহাদের ছুঁৎমার্গ, জাতিভেদ, ধর্মান্ধতা, পৌত্তলিকতার প্রতি তাঁহারা যুক্তির তীব্র কষাঘাত করিতেন। আমার খুব ভালো লাগিত। ইতিপূর্বে হিন্দু-সমাজের সঙ্গে মিশিতে যাইয়া তাহাদের ধর্মান্ধতা ও ছুঁৎমার্গের জন্য বহুবার মনে আঘাত পাইয়াছি, তাঁহাদের সমালোচনা আমার সেই ক্ষতস্থানে পেলব স্পর্শ মাখাইয়া দিত।

চলবে…